তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

"এমনকি কিছু পতিতা শহরে প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য পর্যন্ত করতো। সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ কলকাতার পুলিশ ধনীদের তৈরি বে^...শ্যালয় গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না। শুধু মাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই তেতাল্লিশটি বে^...শ্যালয়ের মালিক ছিলেন। [ তথ্যসুত্র: সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী, ১৯৬২, পৃ.৩৫৮-৬০]"

আসলে ওই সময় নৈতিকতা নিয়ম কানুন ছিল বলে মনে হয় না কিংবা এমনও হতে পারে ধর্মীয় কোন কারণ আছে। হিন্দুরা মনে করে, বে^...শ্যারা এই সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গা পুজার সময় বে^...শ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। [Maa Durga is considered to be incomplete without the soil from prostitutes door steps.] "দূর্গা পুজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বে^...শ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। [তথ্যসুত্র: কালিকা পুরাণোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭] এবং সানন্দা পত্রিকা ১৮ এপ্রিল ১৯৯১ পৃষ্ঠা ১৯]"।

আসলে নারীদের সবসময় ভোগের পন্যই মনে করা হয়েছে, ইংরেজ আমলেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না।

"বে^...শ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তাঁর একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজে ছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বে^...শ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন মরমি কবি হাসন রাজা, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। [ তথ্যসুত্র: অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা: ড. আবুল আহসান চৌধুরী: শোভা প্রকাশ]" 

যাই হোক এইরকম আরো অনেকেই আছে তাদের কথা আর নাই বা লিখলাম। "শুধু তাই নয় সেই সময় ইংরেজ সৈন্যরা মাত্রাতিরিক্ত পতিতালয়ে যেত। যার ফলে ১৮৬০ সালে ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে ৬০% এর বেশী যৌন রোগে আক্রান্ত হয়ে পরে। তাই ইংরেজ সরকার ১৮৬৪ সালে পাশ করালেন - (Cantonment Act) আইন। সেনা ছাউনি গুলোতে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য তৈরি হল আলাদা বে^...শ্যালয়, সেখানে যেসব বে^...শ্যারা আসতেন তাঁদের রেজিস্ট্রি ভুক্ত করে পরিচয় পত্র দেওয়া হত। যৌন রোগ থেকে তাঁদের মুক্ত রাখার জন্য ‘লক হসপিটাল’ নামে বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হয় প্রধান সেনা ছাউনিতে।

[তথ্যসুত্র: Dr. Ashwini Tambe - "The Elusive Ingenue:A transnational Feminist Analysis of European Prostitution in Colonial Bombay]"

জেমস টেলরের, "A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca" (কোম্পানি আমলে ঢাকা) বইয়ের তথ্য মতে - অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও ঢাকা শহরে সংগঠিত আকারে পতিতা বৃত্তির অস্তিত্ব ছিল। উল্লেখ্য যে জেমস টেলর (১৮২৫ থেকে ১৮৩৫) ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ঢাকায় সিভিল সার্জন হিসেবে নিয়োগ ছিলেন। "১৯০১ সালের, সরকারি হিসাব মতে, ঢাকায় পতিতার সংখ্যা ছিল ২১৬৪ [দৈনিক ডেসটিনি, ৪ জানুয়ারি ২০১০]"

তবে "যশোর শহরে পতিতা বৃত্তির ইতিহাস রয়েছে ৫শ’ বছরের। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকেই যশোর শহরে চলে আসছে পতিতাবৃত্তি। ব্রিটিশ যুগে যশোর শহরের তিনটি স্থানে পতিতালয় ছিল। কলকাতার জমিদার মনমথ নাথ রায় ঘোড়া গাড়ি করে প্রতি শনিবার আসতেন ফূর্তি করতে। আর সে সময়ে তাকে মেয়ে সাপ্লাই দিতো চাঁচড়া রায় পাড়ার ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। [(যশোর ইনফো) এবং বেনজিন খানের লেখা বই 'প্রকাশিত গদ্য'।]"

দেশে বর্তমান যৌনকর্মীর সংখ্যা ৭৪,০০০ (মানব জমিন- ২১ ডিসেম্বর ২০১৪)। যাদের ৫ শতাংশ হোটেলে, ৪১ শতাংশ ভাসমান ও ৫৪ শতাংশ যৌন পল্লীতে অবস্থান করছেন। (বাংলা নিউজ, ২০/১২/২০১৪)। Guardian পত্রিকায় 9 January 2008 এ একটা প্রতিবেদন ছাপা হয় - 'I'm just here for survival' (আমি শুধু বেঁচে থাকার জন্য এখানে আছি) এই শিরোনামে। সেখানে বলা হয় দৌলদিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয় এবং সেখানে ১৬০০ এর অধিক পতিতা আছে, গড়ে প্রতিদিন ৩০০০ পুরুষ সেখানে দৈহিক সম্পর্ক করতে যায়।

তবে চিন্তার বিষয় এই যে, "প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ নারী ও শিশু বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় পাকিস্তানে। অপরদিকে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ প্রতি বছর ভারতে পাচার হচ্ছে। [অপরাধ বিজ্ঞান পরিচিতি, ড. বোরহান উদ্দিন খান,পৃ- ২৭৯]" এবং এইসব পাচারকৃত নারীদের বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তি, অশ্লীল ছবি নির্মাণ ও ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করা হয়।

'আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)' এর তথ্য মতে, এখনও প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশী পাকিস্তানের পতিতালয়ে রয়েছে। আর কলকাতার পতিতালয়ের ১৪% নারী বাংলাদেশী। 'কলকাতার সোনাগাছি পতিতালয়ে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশি মেয়ে রয়েছে। (যায় যায় দিন)।'

আসলে পাচারকৃত মহিলাদের বাধ্য করা হয় পতিতাবৃত্তিতে আর ওই কারণেই ভারতের পতিতালয়ে এতো বাংলাদেশি নারী। 'বর্তমান ভারতে দুই মিলিয়ন পতিতা আছে (BBCnews 10 December 2009)।' যদিও ভারতের আইনে ১৯৫৬ (১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে সংশোধিত) এই আইন অনুসারে দেহব্যবসা ও পতিতালয় পরিচালনা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও প্রকাশ্যে এবং গোপনে পতিতাবৃত্তি চলছে এমনকি বর্তমানে অনেক উচু পদের লোকজন ও জরিত এর সাথে। উদাহরণ হিসেবে - "[ভারতে আয়কর কর্মকর্তার বাড়িতে মিনি পতিতালয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪ জুলাই, ২০১৪]" (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - prostitution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours