দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত অম্বিকা কালনা শহর ভাগীরথীর কোলে অবস্থিত এবং শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলিধন্যা। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুণীজনের পদধূলি শহরটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। প্রত্যেক জায়গারই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে। কোনো জায়গার কোনো উৎসব, পরব, ঝাপান বা পুজো উপলক্ষে মেলা সেই জায়গায় বহু মানুষকে কাছে টানে, আপন করে নেয়। তেমনই কালনা শহরকে আনন্দে ভরিয়ে দেয় এখানকার সরস্বতী পুজোর আড়ম্বর। সেই সময় তো তবু স্কুলে, ক্লাবে এবং ঘরে ঘরে পুজো হয় কিন্তু যে একটি মাত্র পুজো উপলক্ষ করে শুধু কালনাবাসী নয়, আশেপাশের ছোটো বড়ো গ্রাম মেতে ওঠে তা হলো শ্রাবণ মাসে শুক্লপক্ষের সপ্তমী বা পূর্ণিমা তিথিতে মা মহিষমর্দিনীর পুজো। কিন্তু এই পুজোর প্রচলন কবে তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তবে প্রামাণ্য কিছু তথ্য থেকে বাংলা ১২৭০ সালের ১৫ই শ্রাবণ, ইংরেজি ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই, বৃহস্পতিবার এই দিনটিকে চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু হঠাৎ শ্রাবণ মাসে দুর্গা মূর্তিতে পুজো কেন? না, এ মূর্তি সম্পূর্ণ দুর্গার নয়। মা দুর্গা সপরিবার আসেন। মা মহিষমর্দিনী মহিষাসুরমর্দিনী। পাশে দুই সহচরী জয়া এবং বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে বিরাজমানা। তাঁদেরও পুজো আলাদা করে হয়। জয়া ভোগশক্তি বর্ধনকারিণী, ভোজ্য বস্তু প্রদান কারিণী। বিজয়া জ্বালা যন্ত্রণা নিবারণকারিণী। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে তো পাকাতেই হয়! চলে যাই সলতে পাকাতে।
তখন পরাধীন ভারত। কিন্তু বর্ধমান মহারাজের আমল। রাজন্যপ্রথা বিলুপ্ত হয়নি। কালনার রাজবাড়ি তাঁদের বাগান বাড়ি। ভাগীরথীর কোলে এ শহরে ব্যবসা চলে কলকাতার সঙ্গে। কালনার ফেরিঘাট, নয়াগঞ্জে সপ্তাহে সপ্তাহে নৌকা এসে লাগে। নৌকা করে জিনিসপত্র যাতায়াতে একসপ্তাহ সময় লাগে। তাই সে হলো হপ্তাঘাট। পরে অবশ্য 'হরমিলা কোম্পানি'র স্টিমার চালু হয়, তখন কলকাতা থেকে রাতে ছাড়া স্টিমার কালনা ঘাটে সকালে আসত; আর সকাল বেলা কালনা থেকে ছাড়া স্টিমার সন্ধ্যায় কলকাতায় নাকি পৌঁছে যেত। 'নাকি' বললাম। কারণ এককালের ঘটনা আজ গল্প। যেমন আজকের কথাও একদিন গল্প হয়ে যাবে!
যাইহোক, সেই হপ্তাঘাট সংলগ্ন এলাকা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। একজন আড়তদার ঈশ্বরীপ্রসাদ পাল চৌধুরী স্বপ্ন দেখেন রাণাঘাটের পালচৌধুরীদের মা মহিষমর্দিনীর পাটাতন হপ্তাঘাটে ভেসে আসছে। উনি যেন তা তুলে নিয়ে পুজো শুরু করেন। সকালে গঙ্গাস্নানে গিয়ে উনি সত্যিই একটি কাঠের পাটাতন পান এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সকল কথা জানান। নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, বেলপুকুর, বৈদ্যপুরের সকল পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে সকল ব্যবসায়ীর উদ্যোগে বাংলা ১২৭০ সালের ১৫ই শ্রাবণ পূজারম্ভ হয়। সভাপতি হন স্বর্গীয় ঈশ্বরী প্রসাদ পাল চৌধুরী। প্রথমদিকে রাণাঘাটের পাল চৌধুরীদের তরফ থেকে পুজো নিয়ে আসা হতো এবং সংকল্প ওনাদের নামে হতো। সাংসদ ইলা পালচৌধুরীর দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে সে প্রথা অবলুপ্ত হয়। সেই থেকে এ পুজো কালনা বাসীর একান্ত আপনার। যদিও আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক সমাগম হয়েই থাকে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, বর্ধমান মহারাজার শাসনাধীন হলেও এই পুজোর জন্য কোনদিন বর্ধমান মহারাজার কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেওয়া হতো না।
১২৭০ সাল থেকে ১৩০০ সাল পর্যন্ত তাল পাতা দিয়ে ছাওয়া মণ্ডপ শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তো, জল জমে যেত চারপাশে। ১৩০১ সাল থেকে ১৩৫০, ইংরেজি - ১৮৯৪—১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সভাপতি কালিপদ সরকার এবং সম্পাদক সচ্চিদানন্দ সাহার সময়ে স্থায়ী মণ্ডপ স্থাপন, ট্রাস্ট গঠন, মায়ের গয়নার ব্যবস্থা, এককথায় সামগ্রিক উৎকর্ষ সাধিত হয়।
সর্বশ্রী ব্রজগোপাল নন্দী, বেণীমাধবসাহা, কালিপদ সরকার, সচ্চিদানন্দ সাহা, রবীন্দ্রনাথ সাহা, দীনবন্ধু সাহা, পঞ্চানন সাবুই, পাঁচুগোপাল পান, শম্ভুচরণ মল্লিক, নারায়ণ সাবুই, বিশ্বনাথ সাহা, সুশীল মিশ্র, শঙ্কর পান এবং বিজন শেঠ বিভিন্ন সময়ে পূজাকমিটির সভাপতি ও সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেছেন এবং করছেন।
জ্যৈষ্ঠ মাসে পুষ্যা নক্ষত্রে মায়ের গাত্র মৃত্তিকা হয় এবং মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়। কমিটি সভা আয়োজন করে স্থির করে পূর্ণিমা বা শ্রাবণের শুক্ল পক্ষের সপ্তমী তিথি, কোন দিন নির্দিষ্ট হবে পুজোর জন্য। পূর্ণিমাতে পুজো হলেও পুজোর প্রথম দিনটিকে সপ্তমী ধরা হয়। ঐদিন সকালে ঢাক বাদ্যি সহযোগে গঙ্গা থেকে ঘট ভরে আনা হয় মায়ের স্নানের জন্য।
"শ্রী পঞ্চমীর দিন পালকি করে ঘট নিয়ে সারা কালনা পরিক্রমা করা হয়" এই তথ্য একদমই ঠিক নয়। পুজোর তিনদিন অন্নক্ষেত্র, বস্ত্রদান বিভিন্ন সৎ কাজের আয়োজন করা হয়। মায়ের কাপড় গরীব, দুঃস্থ মেয়েদের বিয়েতে কমিটির মাধ্যমে দান করা হয়। বলিদান মানবিক না অমানবিক সে আলোচনা তার্কিক মহলে চললেও এখানে বলিদান প্রথা রয়েছে।
গতবছর ৩রা আগস্ট পুজোর দিন স্থির করা হয়েছিল, কিন্তু গাত্রমৃত্তিকা অনুষ্ঠান হয়নি। এবছরও কোনোরকম আয়োজন সম্ভব হলো না।
এবার বলা যাক, মায়ের মূর্তির বিষয়ে। মহিষাসুর প্রভূত বলশালী, অতুলনীয় শক্তির অধিকারী। কিন্তু সে অসংযত, মদমত্ত। ভোগতৃষ্ণা এবং ইন্দ্রিয়পরতা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে শুভাশুভ বোধ হারিয়ে মহা বিপর্যয় ঘটিয়ে দেয়। সেই শক্তিকে কল্যাণ বুদ্ধি, বিবেক বুদ্ধি দ্বারা বা শিব শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে হয়। শিব সুখদ, শুভদ। মর্দন অর্থে দমন। অশুভ শক্তিকে দমন করা প্রয়োজন আর দমন করার জন্য বীর্য রূপী পশুরাজ সিংহের প্রয়োজন। মহিষাসুর তমোগুণের প্রতীক, সিংহ রজঃ গুণের প্রতীক, জ্ঞানময়ী দেবীর মধ্যে সত্ত্বগুণ কায়াবতী। তমোগুণকে দমন করার জন্য রজঃ গুণ, রজোগুণকে দমন করতে সত্ত্ব গুণের প্রয়োজন। সেজন্য মহিষাসুরের উপর সিংহ এবং সিংহের উপর দেবী অধিষ্ঠিতা।
কালনায় মহিষমর্দিনী পুজো হলে আজ নবমী পুজো হতো। হতো, কিন্তু হলো না। কারণ তো সবারই জানা। আমরা হয়তো একদিনের জন্য যাই, কোনো কোনো বছর তাও হয় না। তাতেই মনটা কেমন কেমন করছে। আর যে সব কলাকুশলী এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত? প্রতিমা তৈরি, মণ্ডপ সজ্জা, আলোকসজ্জা, রকমারি দোকানদারি, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, নহবত সবকিছু বন্ধ, মানে এতো মানুষের কাজ বন্ধ। ভাবলে আরও মন খারাপ হয়ে যায়। আকাশ-মাটি কান্না ভেজা। আশা রাখি, ঈশ্বরের ইচ্ছায় সকল কালো, সকল দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়ে 'ভালো' জাগ্রত হবে। শুধু ধৈর্য ধরতে হবে।
(www.theoffnews.com - Kalna puja)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours