তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

বাঈজীর ব্যাপারে পুরনাে কলকাতার দু-জন বাবু খুব বিখ্যাত ছিলেন। একজন হচ্ছেন মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুত্র রাজকৃষ্ণ দেব, যার কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। অন্যজন হচ্ছেন চুড়ামণি দত্তের সন্তান কালীপ্রসাদ দত্ত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একজন। নিম্নপদস্থ সামরিক অফিসার ছিলেন ফ্রেডরিক উইন। তিনি রাজকৃষ্ণের বাড়িতে নাচের আসরে উপস্থিত ছিলেন। তার লেখা থেকে জানা যায়, রাজকৃষ্ণ সেবার তিন রাত ধরে চার-পাঁচ দল বাঈজীকে নাচানাের জন্যে বায়না করেছিলেন। এই বাঈজীদের মধ্যে নিকীও ছিল। তার বয়স তখন চোদ্দ বছর। উইনের ভাষায় ‘নিকীর মুখাকৃতি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন রতিদেবী স্বয়ং গঠন করিয়াছেন। আমি স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম যে, তিনরাত্রি নাচিবার জন্য নিকীকে যে বারােশত টাকার নগদ এবং সেই দামের দু-জোড়া শাল পারিশ্রমিক দেওয়া হইল, তাহা তাহার গুণের সমতুল্য বটে।’ ১৮১৪ সালে কিষাণচন্দ্র রায়ের বাড়িতে, ১৮১৫ সালে রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে আর ১৮৩২ সালে আশুতােষ দেবের বাড়িতে নিকী নেচেছিল বলে খবরে প্রকাশ। ১৮১৯ সালেও নিকী রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে নেচেছিল বলেও জানা যায়। এরপর চারবছর তার কোনাে খবর পাওয়া যায়নি। ১৮২৩ সালে সে রামমােহন রায়ের মানিকতলার বাগানবাড়ির মুজরােয় হাজির ছিল। 'ক্যালকাটা জার্নাল’-এ খবর বেরিয়েছিল।

নিকী আর আশরুনের পরেই থাকার কথা ছিল নূরবক্সের স্থান। কলকাতার বাঈজীদের নামের তালিকায় প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকা উচিত ছিল তার নাম। কিন্তু কোথায় কী! ১৮১৯ সালে আবির্ভাব-লগ্নেই তিরােভাব ঘটলাে কলকাতার প্রতিভাময়ী বাঈজী নূরবক্সের। টলে উঠলাে বাঈজী -সম্রাজ্ঞী নিকী বা আশরুনের সিংহাসন। একটা অসাধারণ প্রতিভার বিনাশ ঘটলাে।

১৮১৪ সালের ২০ অক্টোবর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ খবর বেরােলাে আশরুন দুর্গাপুজোয় নীলমণি মল্লিকের বাড়িতে নেচেছে। ১৮১৫ সালে আশরুন আবার দুর্গাপুজো উপলক্ষে রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে নেচেছিল। আশরুনের শেষ খবর ছাপা হয়েছিল ১৮১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-...তবে রামদুলাল দের পুত্র ছাতুবাবুও পিছিয়ে ছিলেন না। ছাতুবাবুর বাগান বাড়ি বিখ্যাত ছিল বাই নাচের জন্য। শুধু ছাতু বাবু নয়, বাবু খেলাত ঘোষ ছিলেন উৎকর্ষ সংগীতের পৃষ্ঠপোষক। বাগানবাড়িতে হিন্দু মেলার বৈঠকও ঐতিহাসিক ভাবে মূল্যবান। তবে মজার ব্যাপার হল যারা হিন্দু ধর্মের সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন যেমন রাধকান্তদেব এবং আর যারা নবজাগরণের আন্দোলনের অভিমুখে ছিলেন  তাদের প্রায় অনেকেই বাবু কালচারের ও বাইজি গান ও নাচের স্বপক্ষে ছিলেন। তবে শেষ করি গহরজানের কথা দিয়ে। প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড  সফল ভাবে প্রকাশিত হয় এইচএমভি থেকে। তিনি সব রকমের গান গেয়েছেন। তাঁর অবদানও কম নয়।

গওহরজান আর এক নামকরা বাঈজী। তার জন্ম ১৮৭৩ সালে। গওহরের আসল নাম এঞ্জেলিনা, বাবার নাম রবার্ট উইলিয়াম, ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কাশীতে ছিল তাঁর বাসস্থান। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া হেমিংস। ভিক্টোরিয়া ছিলেন অসাধারণ রূপসী। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। নতুন তার নাম হয় মালকাজান। এসময় সে মেয়ের নামও পাল্টে দিল—এঞ্জেলিনা হল গওহরজান, সংক্ষেপে গহর। 

গওহরজানকে বলা হত ‘ইণ্ডিয়ান নাইটিঙ্গেল’। তার দক্ষিণা ছিল ১৫০০ টাকা। জানা যায়, ১৯০২ সালে পাটনায় একটা বিয়েবাড়ির আসরে গওহরজান একখানা স্বরচিত গজল গেয়ে সবাইকে মােহিত করে দিয়েছিল। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, পাথুরিয়াঘাটার জমিদার ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘােষ গওহরকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। ১৯২০ সালে ভূপেনবাবুর বাড়িতে মালকাজানের সঙ্গে গওহরও নেচেছিল। পরে গওহর বােম্বাই চলে যায়। তারপর সেখান থেকে মহীশূরের মহারাজা কৃষ্ণরাজ ওয়ারিয়রের দরবারে গিয়ে হাজির হয়। মহারাজা তাকে মাসে দু’হাজার টাকা মাইনের গায়িকার চাকরিতে নিয়ােগ করেন। কিন্তু মহীশূরে যাওয়ার দু’বছর পরে ১৯২৯ সালে গওহর মারা যায়। গওহরের সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাপা হয় ১৯৩০ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়। এতে লেখা হয়েছিল,

“A loss has been sustained by the death in Mysore of Madame Gauhar Jan, where she was Court singer and dansense to H. H. the Maharaja of Mysore.”

এই কাগজে আরও লেখা হয়,

“Her fame as a songstress earned her the title of ‘Indian Nightingle’ and when gramophone records were first made of Indian songs, she was the first to be approched.”

দুর্গাপুজো ছাড়াও দোল আর রাসের সময়ও বাঈজী নাচ হত। তবে সে খুব কম। (ক্রমশঃ)

তথ্যসূত্রঃ উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় খণ্ড।

বিনোদনে পাইকপাড়া বেলগাছিয়া, সান্তুনু ঘোষ

কলকাতা রাজপথ সমাজও সংস্কৃতিতে, অজিত বসু

অতুল সুর, কলকাতার চালচিত্র, কলকাতা, পৃ. ১৯৩ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ১২১।

(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours