তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

রবীন্দ্রনাথ ‘সাধারণ মেয়ে’র আখ্যান লিখতে বলেছিলেন শরৎবাবুকে। দুঃখী সাধারণ মেয়ে, নিতান্ত তুচ্ছ মেয়ে, যদি কোনো অসাধারণত্ব থাকেও, তার অন্বেষণ করার জন্য, কেউ হয়তো থাকে না। ‘কাঁচা বয়সের জাদু’তে তারা বিকিয়ে যায় ‘মরীচিকার দামে’। এখানেই অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কলম থেমে যায়নি; তিনি চেয়েছিলেন এই সাধারণ মেয়েটি অসাধারণ হয়ে উঠুক কলমের এক আঁচড়ে। বড়ো-বড়ো নামজাদার সভার মাঝখানে যেন সে অনায়াসে আপন অহঙ্কারে হয়ে থাকতে পারে উন্নতশির, এগিয়ে যেতে পারে চারদিকের হাততালিকে উপেক্ষা করে। এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন শরৎবাবুই। করেছেনও বটে! পঁচিশ বছর একটানা মেয়েদের গল্পই লিখে গেছেন শরৎচন্দ্র। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৮ – তাঁর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাধারণ মেয়ের আখ্যান, আটপৌরে রোমান্টিক ঠাসবুনোট গপ্পো, নিপাট সহজ ভাববিভোর ভাষা – এই হলো তাঁর পুঁজি। অবিরত লিখে গেছেন প্রেমাকুল মেয়েদের গল্প। পতিতা, বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, অরক্ষণীয়া অথবা বিয়ে-বহির্ভূত প্রেম – তা সে যেমনটাই হোক না কেন, শরৎচন্দ্র অভিভূত হয়ে থাকতেন তাদের প্রেমে।

শরৎচন্দ্র একবার উন্মত্ত হয়েছিলেন একটি মেয়েকে নিয়ে, তাঁর নাম গায়ত্রী দেবী। প্রতিবেশী যুবকের প্ররোচনায় গায়ত্রী গৃহত্যাগ করেছিল এবং বহু অপমানও তাকে সহ্য করতে হয়েছিল এ-সময়। শরৎচন্দ্র গায়ত্রীর দুঃখে কাতর হয়ে বলেছিলেন, সমাজের চোখে গায়ত্রী পতিতা; অতএব আত্মীয়-স্বজনের ঘরে ঠাঁই পাবে না সে। অথচ এই মেয়েটির চোখের জলের হিসাব কোনোদিন নেবে না সমাজ। এই সমবেদনাই রূপান্তরিত হয়েছিল প্রেমে। তবে গায়ত্রী শরৎচন্দ্রের প্রস্তাবে সায় দেয়নি। এ ধরনের ঘটনাও তাঁর উপন্যাস রচনায় পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। রেঙ্গুনে ও পেগুতে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র যে-উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন, সেই অভিজ্ঞতাও বোধহয় তাঁকে উপন্যাসের কাহিনী-রচনায় প্রণোদিত করেছিল। মদ্যাসক্তি এবং বে^...শ্যাসক্তি ছিল তাঁর। তিনি যে এজন্য আত্মীয়-পরিজনের কাছে ধিকৃত এবং নিন্দিত হতেন, তাও জানা ছিল তাঁর। সপ্তাহের কোনো কোনো দিন তিনি অফিসেও যেতেন না। এরকম বর্ণনাও পাওয়া যায়, ‘মাসের মাহিনা হাতে পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ি দিতেন একটু আনন্দলাভের আশায়। নির্দিষ্ট স্থানের কোন স্থিরতা ছিল না – যখন যেখানে খুশী, দল বেঁধে যেতেন, হৈ-চৈ করে রাত কাটিয়ে আসতেন বাসায়।’ শরৎচন্দ্রের নামের সঙ্গে জড়িয়েছিল অনেক পতিতার নামই, তবে তার সত্যতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত নন। এরকম কাহিনিও লিখিত হয়েছে। বাসমত্মী নামে এক পতিতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এতটাই বেশি ছিল যে, এই মেয়েটির প্লেগ হলে শরৎচন্দ্র তার সেবা করেছিলেন এবং মৃত্যুর পর শেষকৃত্যও করেছিলেন।

বাসমত্মী ও গায়ত্রীর সঙ্গে লেখকের ঘনিষ্ঠতার গল্প ‘চরিত্রহীনে’র সতীশ-সাবিত্রীর প্রসঙ্গ স্মরণ করায়। শরৎচন্দ্র যে-ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, সেই ভালোবাসায় মগ্ন হয়েছিল সতীশ-সাবিত্রী। প্রসঙ্গ ভিন্ন, প্রেক্ষাপটও আলাদা, কিন্তু ভালোবাসার গল্পটা এক। ওই বাসমত্মীর গল্পটির আঁচে কি তৈরি হয়েছে দেবদাসের চন্দ্রমুখী-দেবদাস কাহিনী? 

কেন নিষিদ্ধ পল্লীর মাটি মিশ্রণে তৈরি হয় দেবী মুর্তি। পুরুষ রা আনন্দ পান দৈহিক সম্পর্কে কিন্তু বে^...শ্যা নারীরা আনন্দ পান না, তারা যৌন কর্মে লিপ্ত থাকলেও যৌনাতর উর্ধে থাকেন, মন দেওয়া নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না কারণ এটা তাঁদের কর্ম যৌনতার বিচারে পবিত্র কিছু ব্যক্তিক্রম ছাড়া। তারা শরীরের উর্ধে মনকে ধরে রাখেন।

চিরাচরিতভাবে মানুষ বিশ্বাস করেন যে, মানুষের মধ্যে যে কামনা, বাসনা, লালসার বাস... পতিতারা তা নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেন। তাঁরা নিজেদের অশুদ্ধ, অপবিত্র করে সমাজকে শুদ্ধ রাখতে চান। পবিত্র রাখতে চান। ফলে হাজার হাজার পুরুষের পুণ্যে বে^...শ্যাদ্বারের মাটি হয়ে ওঠে পবিত্র ৷ সে কারণেই এই মাটি দিয়ে গড়তে হয় দেবী মুর্তি ৷ এই আচার থেকে বোঝানো হয় যে, নারী মায়ের জাতি। নারীর ঔরসেই পুরুষের জন্ম। নারীকে পতিতা বানায় পুরুষরাই। তাই ওই পুরুষরাই অপবিত্র। মায়ের প্রতিমা তৈরীতে পতিতালয়ের মাটি দিতে হয় অর্থাৎ যাঁরা এই পরিস্থিতির শিকার তাঁদের সম্মান করতে হবে। নারী কখনও অপবিত্র হতে পারে না, এই ধারণাটিই লুকিয়ে থাকে এই রীতির আড়ালে৷ শরৎকালে হয় দেবীর অকাল বোধন৷ এই সময় মহামায়া ৯টি রূপে পুজিত হন৷ এই নবম রূপটিই আসলে পতিতালয়ের প্রতিনিধি৷ মনে করা হয়, সে কারণেও এই রীতির জন্ম হয়েছে৷ অনেক পন্ডিত ও গবেষকরা বলেন বে^...শ্যাবৃত্তি আছে বলেই সমাজের ভারসাম্য আছে,কিন্তু এই ভারসাম্য রক্ষা যারা করেন তাঁরাই সমাজের চোখে ঘৃণ্য।

১৯০৭ সালে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী যুবকদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল বারবনিতারা। ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুশীলন সমিতির যুবকেরা ঠিক করলেন সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে বিডন স্কোয়ারে একটা সভা করবেন । সভা শুরু হলো ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। আর তাঁর পরেই শুরু হলো পুলিশের লাঠি চালানো। বিপ্লবী যুবকেরা ইট পাথর ছুঁড়ে পাল্টা আক্রমণ চালাল আর সেই সময় দেখা গেল, চিৎপুরের বাড়ির ছাদ থেকে বারবনিতারা পুলিশের ওপর ইট ছুঁড়ে তাঁদের তাড়িয়ে দেয়।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে কলকাতার বারবনিতারা আন্দোলনের জন্য অর্থসংগ্রহের কাজে নেমেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী সোনাগাছি অঞ্চলের বারবনিতাদের নিয়ে সভা করেন। এর পরের বছর বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যেও পথে নেমেছিল বারবনিতারা। ত্রাণের জন্য যে রিলিফ কমিটির গঠিত হলো ”বেঙ্গল রিলিফ কমিটি” যার সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাস, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রমুখ।

মাত্র কদিনের মধ্যেই এই কমিটি ১ লাখ টাকারও বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছিল। মনাদা দেবীর লেখা বই থেকে জানা যায় সেই সময় ‘পতিতা সমিতি‘ গঠিত হয়েছিল তাঁরা লালপাড় শাড়ি পরে কপালে সিঁদুরের ফোটা লাগিয়ে গান গেয়ে টাকা তুলে ছিলেন বন্যার্তদের জন্য মাসিক বসুমতিতে এই নিয়ে একটি রচনা লেখা হয়। সংগৃহীত অর্থ তাঁরা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছিল। পিতৃস্নেহে এস এস মা লক্ষীরা বলে আচার্য তাঁদের আহ্বান করেন এবং তাঁরা এই অকৃত্রিম স্নেহ দেখে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। বরিশালেও পতিতা সমিতি গড়ে ওঠে তাঁর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গান্ধীবাদী – শরৎকুমার ঘোষ।

১৯২৪ সালে বারবনিতারা তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাস। বাংলার ভদ্র সমাজ এই নিয়ে আবার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। প্রবাসী পত্রিকা এই নিয়ে প্রতিবাদ করেন কেন পতিতারা সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করছে বলে। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাস প্রয়াত হলে তাঁর মরদেহ নিয়ে যে বিরাট মিছিল হয়েছিল সেই মিছিলে পা মেলান বারবনিতারা। স্বদেশী আমলে প্রচুর বিপ্লবী সোনাগাছীতে লুকিয়ে থাকতেন, তাঁদের সাহায্য করতেন পতিতারা অন্ত্যত সম্মানের সাথে।

যদিও ঊনিশ শতকের পতিতারা আর আজকের একদম আলাদা। কারণ ঊনিশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার পতিতারা নবজাগরণের প্রভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যার সম্পূর্ণ ইতিহাস আমাদের জানা নেই।

১৯৩০ সালে মেদিনীপুরে নন্দীগ্রামে সত্যবতী নামে একা বারবনিতা নারী লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করে পুলিশদ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। তমলুকে ১৯৪২ এর আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত কয়েকজন বিপ্লবীর প্রাণ বাঁচিয়েছিল এক পতিতা নারী। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত হয়তো আছে বিছিন্ন ভাবে তাঁরা আন্দোলনে সহায়তা করেছিলেন বা করে গেছেন। সে ইতিহাস কোন না কোন একদিন নিশ্চয় লেখা হবে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - prostitution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours