তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

সাধারণভাবে অনুমান করা হয়, ১৮৭৬ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকুরিরত অবস্থাতেই বন্দে মাতরম রচনা করেছিলেন জোড়াঘাটের বাড়িতে যেটা বঙ্কিম ভবন নামে পরিচিত। তবে ঠিক কোন সময় তিনি গানটি রচনা করেছিলেন তা জানা যায় না। সেইটা কি  এই বঙ্কিম ভবন? এই নিয়ে বিতর্ক আছে।

১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রথম গানটি প্রকাশিত হয়। বন্দে মাতরম গানটির সুর কে করেছিলেন? ১৮৮২ সালে ‘আনন্দমঠ’ প্রথম বার বই হয়ে বেরোনোর সময় গানটির নীচে পাদটীকা ছিল, ‘মল্লার রাগ। কাওয়ালি তাল।’ যদুভট্ট ওই রাগেই লেখকের ড্রয়িং রুমে গানটি গেয়েছিলেন। রাগিণী বদলে গেল বছর তিনেক পর। ১৮৮৫ সালে ‘বালক’ পত্রিকায় তরুণ কবি ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই গানের স্বরলিপি প্রকাশ করলেন ‘দেশ’ রাগে। সুরকার লেখককে গেয়ে শুনিয়েছিলেন, লেখকের পছন্দও হয়েছিল। 

১৮৭৬ সালের ২০শে মার্চ বঙ্কিমচন্দ্র হুগলীতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেকটরের পদে যোগদান করেন। নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে নৌকায় ভাগীরথী পার করে হুগলি এক ঘন্টারও পথ নয়। সেখান থেকেই কিছুদিন যাতায়াত করার পর তিনি নৈহাটির পাট চুকিয়ে সপরিবারে হুগলি চলে আসেন। হুগলিতে এসে তিনি মালিক কাশেমের প্রাসাদের উত্তরদিকের একটি অংশ হাজীবাবার থেকে ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।

যদিও হুগলির সঙ্গে বঙ্কিমের সম্পর্ক আরও আগের। নৈহাটিতে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিনি হুগলি কলেজে (বর্তমান হুগলী মোহসিন কলেজ) ভর্তি হন এবং চার বছর পড়াশোনা করে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে কলকাতার হিন্দু কলেজে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্তি হন। হুগলি কলেজে পড়ার সময় বঙ্কিম নৈহাটি থেকে নিয়মিত নৌকা করে যাতায়াত করতেন। হুগলি কলেজে পড়ার সময় থেকেই বঙ্কিমের সাহিত্য-প্রতিভার আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১২৫৯ সালের ২রা চৈত্র তারিখের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা থেকে জানা যায়, “হিন্দুকালেজের ছাত্র শ্রীযুক্ত দীনবন্ধু মিত্র, হুগলী কালেজের ছাত্র শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং কৃষ্ণনগর কালেজের ছাত্র শ্রীযুক্ত দ্বারকানাথ অধিকারী এই ছাত্রত্রয়ের বিরচিত গদ্য পদ্য পরিপূরিত তিনটি প্রবন্ধ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি…”।

হুগলিতে সে সময় নাট্যচর্চার জোয়ার এসেছিল। বহু ধনী বাবুরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাটকের দল তৈরি করে নাট্যচর্চা করতেন। বঙ্কিমের সাহিত্য-প্রতিভার কথা চাউর হওয়ার পর হুগলির এক জনৈক বাবু তাঁকে তাঁর নাটকের দলে যোগ দেওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ জানান। বঙ্কিম যদিও সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তিনি নাটক দেখার জন্য নিয়মিত হুগলিতে যাওয়া-আসা করতেন বলে জানা যায়।

এর প্রায় কুড়ি বছর পর তিনি হুগলির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে জোড়াঘাটের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ইতিমধ্যে তিনি সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছেছেন। তাঁর বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রত্যেক শিক্ষিত সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির অন্দরমহলে নিজের স্থান করে নিয়েছে। যদিও দীনবন্ধু মিত্রের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে বঙ্গদর্শনে একটি সাময়িক হল্ট সৃষ্টি হয়। এর পর পরই বঙ্কিম হুগলি চলে আসেন। তবে বঙ্গদর্শন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও বঙ্কিমের সাহিত্যচর্চায় ভাঁটা পড়েনি কখনই। সেকালের বহু নামকরা কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা নিয়মিত তাঁর হুগলির বাড়িতে আসতেন এবং তাঁর জোড়াঘাটের বৈঠকখানা ঘরে সাহিত্যচর্চা, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের আসর জমে উঠত। সাহিত্যিক চন্দ্রনাথ বসুর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে তারই এক খণ্ডচিত্র – “…তাহার দিনকতক পরে বঙ্কিমবাবু হুগলিতে বাসা করেন। দুইটি বাড়ি ভাড়া করেছিলেন। জোড়াঘাটের ঠিক দক্ষিণে দুইখানা বাড়ির পর একটি বাড়ি তাঁহার অন্দর ছিল। অন্দর-বাটীর পূর্বাংশের চাতালটি স্তম্ভোপরি নির্ম্মিত। উহার নীচ দিয়া গঙ্গার স্রোত প্রবাহিত হইত। ঐ চাতালে দাঁড়াইয়া বঙ্কিমবাবু একদিন বলিয়াছিলেন- “সন্ধ্যার পর আমরা এইখানে বসিয়া থাকি।’ … বৈঠকখানা-বাড়িতে তিনটি ঘর ছিল; তন্মধ্যে মাঝের ঘরটি সর্বাপেক্ষা বড়। সেই ঘরে গঙ্গার দিকে একটি বাতায়নের পার্শ্বে একখানি ইজিচেয়ারে বসিতেন। কথা কহিতেন, আর গঙ্গা দেখিতেন।…” [“বন্ধুবৎসল বঙ্কিম”] – চন্দ্রনাথ বসু।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর স্মৃতিকথাতেও এই জোড়াঘাটের বাড়ির কথা জানা যায়। হরপ্রসাদ তখন উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণ। তিনি ছিলেন বঙ্কিমের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত আর বঙ্কিমও তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি প্রায় প্রতিদিন নৈহাটি থেকে নৌকা করে বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়াঘাটের বাড়িতে আসতেন এবং ধর্ম, সাহিত্য, সমাজ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা গভীর প্রতর্ক চলত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বা চন্দ্রনাথ বসু ছাড়াও ভুদেব মুখোপাধ্যায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, রামগতি ন্যায়রত্ন, তারাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সেকালের স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিকরা নিয়মিত বঙ্কিমের সান্নিধ্য লাভের জন্য জোড়াঘাটের এই বাড়িতে এসেছেন।

ভাগীরথীর তীরের এই বাড়ি যে বঙ্কিমকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল, তা তাঁর নিজের লেখা থেকেই জানা যায় – “একদিন বর্ষাকালে গঙ্গাতীরস্থ কোন ভবনে বসিয়াছিলাম। প্রদোষকাল – প্রস্ফুটিত চন্দ্রালোকে বিশাল বিস্তীর্ণ ভাগীরথী লক্ষবীচিবিক্ষেপশালিনী – মৃদু পবনহিল্লোলে তরঙ্গভঙ্গচঞ্চল চন্দ্রকরমালা লক্ষ তারকার মত ফুটিতেছিল ও নিবিতেছিল। যে বারান্দায় বসিয়াছিলাম তাহার নীচে দিয়া বর্ষার তীব্রগামী বারিরাশি মৃদু রব করিয়া ছুটিতেছিল। আকাশ নক্ষত্র, নদীবক্ষে নৌকায় আলো, তরঙ্গে চন্দ্ররশ্মি। কাব্যের রাজ্য উপস্থিত হইল।”

জোড়াঘাটের এই বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র পাঁচ বছর বসবাস করেছিলেন। এই পাঁচটি বছর তাঁর সাহিত্যরচনার পরিপ্রেক্ষিত থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়েই প্রকাশিত হয় রজনী (১৮৭৭), উপকথা (ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয় ও রাধারানী একত্রে) (১৮৭৭), কবিতা পুস্তক (১৮৭৮), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৯), সাম্য (১৮৭৯) প্রভৃতি বই। হুগলিতে চলে আসার ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার কাজ আবার চালু হয়। ‘কমলাকান্তের পত্রাবলী’, ‘রাজসিংহ’, ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’, ‘কমলাকান্তের জবানবন্দী’, ‘আনন্দমঠ’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলি একে একে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়। ১৮৮০ সালের ১৫ই জুলাই চুঁচুড়া থেকে নবীনচন্দ্র সেনকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে এই বাড়িতে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন আনন্দমঠ এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস। ‘আনন্দমঠ’ বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হওয়ার ঠিক আগে বঙ্কিম হুগলী ছেড়ে হাবড়া চলে যান।

স্থানীয় বেশ কিছু সাহিত্য ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে আনন্দমঠের প্রাণস্বরূপ ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রটি রূপগ্রহণ করেছিল জোড়াঘাটের এই বাড়িতেই। আর সেই মতকে মান্যতা দিয়েই বঙ্কিমের এই বাড়িটি বর্তমানে ‘বন্দেমাতরম ভবন’ নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু এই তথ্য কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বঙ্কিমচন্দ্রের ছোটভাই এবং বঙ্গদর্শন পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় এর বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য মেলে। পূর্ণচন্দ্র লিখছেন, “বঙ্গদর্শনে মাঝে মাঝে দুই এক পাত matter কম পড়িলে পন্ডিতমশায় আসিয়া সম্পাদককে জানাইতেন। তিনি তাহা ঐ দিনেই লিখিয়া দিতেন। ঐ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মধ্যে দুই একটি লোকরহস্যে প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু অধিকাংশ প্রকাশিত হয় নাই। বন্দেমাতরম গীতটি রচিত হইবার কিছু দিবস পরে পন্ডিতমহাশয় আসিয়া জানাইলেন, প্রায় এক পাতা matter কম পড়িয়াছে। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, আচ্ছা আজই পাবে। একখানা কাগজ টেবিলে পড়িয়াছিল, পন্ডিতমহাশয়ের উহার প্রতি নজর পড়িয়াছিল, বোধ হয় উহা পাঠও করিয়াছিলেন, কাগজখানিতে বন্দেমাতরম গীতটি লেখা ছিল। পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই যে গীতটি লেখা আছে – উহা মন্দ নয় তো – ঐটা দিন না কেন। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হইয়া কাগজখানি টেবিলের দেরাজের ভিতর রাখিয়া বলিলেন, উহা ভাল কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে – আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।” এই লেখা থেকে জানা যায় যে বঙ্কিমচন্দ্র যে সময় বন্দে মাতরম গীতটি লিখেছিলেন, সেই সময় তিনি ছিলেন বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদক। ১২৮২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস (১৮৭৬ সালের এপ্রিল মাস) পর্যন্ত তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছিলেন, যার পর তিনি পত্রিকা উঠিয়ে দিয়ে হুগলি চলে যান। পরবর্তীকালে ১২৮৪ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শন ফের চালু হলেও তার সম্পাদক হন সঞ্জীবচন্দ্র। সুতরাং এ কথা অনুমান করা যায় যে বন্দে মাতরম লেখা হয়েছিল সম্ভবত ১২৮২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের আগে, অর্থাৎ তিনি হুগলির জোড়াঘাটের বাড়িতে আসার আগে।

শ্রীঅরবিন্দের একটি লেখা থেকেও একই তথ্য পাওয়া যায়, “It was thirty two years ago that Bankim wrote his great song and few listened; but in a sudden moment of awakening from long delusions the people of Bengal looked round for the truth and in a fated moment somebody sang Bandemataram.” শ্রীঅরবিন্দের এই লেখাটি ১৯০৭ সালের। অর্থাৎ শ্রীঅরবিন্দের বক্তব্য থেকেও এ কথা অনুমান করা যায় যে বঙ্কিমচন্দ্র বন্দে মাতরম রচনা করেছিলেন ১৮৭৫ সালে, হুগলি আসার আগেই।

১৮৮১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র জোড়াঘাটের বাড়িটি ছেড়ে চলে যাবার পর এর হাতবদল হয় একাধিকবার। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন। কিন্তু তারপর বহুদিন যাবত বাড়িটির কোন সংস্কার না হওয়ায় সেটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। অবশেষে ১৯৯৮ সালে বাড়িটি সংস্কার করা হয়। বাড়িটিতে ওলন্দাজ ও মুঘল স্থাপত্য শৈলীর বৈশিষ্ট উজ্জ্বল রূপে নজর কাড়ে। পলেস্তারার কারুকাজ, কড়িকাঠের ছাদ, খড়খড়িওয়ালা কাচের জানালা, হাওয়া ঢোকার জন্য কাঠের ঘুলঘুলি, ছাদের রেলিঙে ইতালীয় baluster-এর ব্যবহার প্রভৃতি আজও মুগ্ধ হয়ে দেখার মত। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পর্যটন দপ্তরের পরিকল্পনা আছে ভবিষ্যতে এই বাড়িটিকে একটি সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করার।

(www.theoffnews.com - Bankim Chandra Chattopadhyay Vande Mataram)

 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours