সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:
বাংলা, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের কোনও কোনও প্রত্যন্ত এলাকায় আজও কিছু রহস্যজনক টাওয়ারের অস্তিত্ব মেলে যা স্থানীয়দের কাছে এখনও বিস্ময়জনক। স্থানীয়রা এই অজানা পরিত্যক্ত টাওয়ারগুলির ইতিহাস সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। ত্রিকোণমিতিক সুউচ্চ এই টাওয়ার বা স্তম্ভগুলির ব্যাখ্যা জনশ্রুতিতে স্থান বিশেষে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। স্থানীয় মতে কোনও অঞ্চলে এই অজানা টাওয়ারগুলিকে আখ্যা দেওয়া হয় চিমনি বা ওয়াচ টাওয়ার বলে। আবার অনেক জায়গায় পরিত্যক্ত টাওয়ারগুলিকে বলা হয় মাচান বা গির্জা। প্রকৃতপক্ষে টেলিগ্রাফ পদ্ধতি চালু হবার প্রাক সময়ে এই টাওয়ারগুলিকে ব্যবহার করে দূরবর্তী স্থানে সংবাদ প্রেরণ করা হত যা সিমাফোর পদ্ধতি নামে পরিচিত ছিল।
১৮২০ থেকে ১৮৩৩ সালের মধ্যে ভারত সরকার কলকাতা থেকে চূনার পর্যন্ত সংবাদ প্রেরণের জন্য সিমাফোর পদ্ধতি চালু করেন। এই পদ্ধতিতে সংবাদ পাঠানোর প্রয়োজনে সরকার প্রতি নয় মাইল ব্যবধানে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ার বা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। টেলিগ্রাফ পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই সংবাদ আদানপ্রদান করা হত। ফোর্ট উইলিয়ম হতে শুরু করে হুগলী, বাঁকুড়া, হাওড়া, ছোটনাগপুরের বিভিন্ন জায়গায় এইরকম স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। সিমাফোর পদ্ধতিতে সংবাদ প্রেরণের উল্লেখ করে ও’ম্যালী এবং মনমোহন চক্রবর্তী হুগলি জেলা গেজেটিয়ারে লিখেছেন – In the first quarter of the 19th century an experimental Semaphore telegraph system was tried between Calcutta and Chunar. The experiment proved a failure and was abandoned before 1830 in which year some of the Semaphore towers were utilized for the Trigonometric Survey of India.
এই ধরনের টাওয়ারগুলিকে GTS (Great Trigonometrical Survey) Tower বলেও অভিহিত করা হয়। বাংলা, ঝাড়খণ্ড থেকে বারাণসীর কাছে চুনার পর্যন্ত ব্যস্ত হাইওয়ে ও রেলপথের পার্শ্বে এবং জঙ্গলের মধ্যে প্রায় ২০০ বছর ধরে দণ্ডায়মান কিছু ‘টাওয়ার’ আজও গোচরে আসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের নিজেদের প্রয়োজনে বহুদূর পযর্ন্ত খবরা খবর পাঠানোর জন্য তৈরি করেছিল এই টাওয়ারগুলি। প্রাথমিক ভাবে সামরিক প্রয়োজনে এই পদ্ধতি ভারতবর্ষে ব্যবহার করা হত।
অসামরিক কাজে এই টাওয়ারগুলি ব্যবহৃত হত না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ৬৯৪ কিমি দূরত্বে চুনার পর্যন্ত সিমাফোর পদ্ধতিতে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল কেন না এলাহাবাদের কাছেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারী আউটপোস্ট। ১৮১৭-এ ২১ শে অক্টোবর স্যার জর্জ এভেরেস্ট কলকাতা ও চুনারের মধ্যে সিমাফোর পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য সার্ভের কাজ সম্পাদন করেছিলেন। এই সার্ভে শেষ করতে তাঁর এক বছর সময় লেগেছিল।
সংকেত মারফত বার্তা প্রেরণের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা কারনে এবং সিমাফোরের সিগন্যালগুলি সঠিকভাবে পড়ার জন্য একই সরলরেখায় প্রায় ৪৫টি স্তম্ভ নির্মিত করা হয়েছিল। এদের প্রত্যেকের মধ্যে দূরত্ব ছিল ৯.৫ থেকে ১৩ মাইল। ইটের তৈরির গোল বেড় দেওয়া চারতলার সমান উঁচু উপরদিকে ক্রমশঃ সরু হয়ে যাওয়া স্তম্ভগুলির সর্বোচ্চে একটি দণ্ডায়মান কাঠের দণ্ডে দুটো দুই মিটার লম্বা চলমান কাঠের তৈরি হাত সংযুক্ত থাকত। এই দণ্ডটি এমন উচ্চতায় রাখা হত যাতে বহুদূর থেকে সেটি গোচরে আসে। এই দুই কাঠের হাতের বিভিন্ন অবস্থানে দেখিয়ে সংবাদের ভাষা তৈরী হত। প্রতিটি অবস্থান নির্দেশ করত এক একটি Alphabetical letter। পরবর্তী পদক্ষেপে ঐ সংবাদের ভাষা নিকটবর্তী স্তম্ভ গ্রহণ করত। প্রতিটি তলের উভয় দিকে চতুষ্কোণ জালানা থাকত। যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তম্ভে দুইজন করে ব্যক্তি উভয় দিকের জালনায় অবস্থান করত হাতে টেলিস্কোপ নিয়ে। এই টেলিস্কোপের মাধ্যমেই নিকটবর্তী স্তম্ভ থেকে প্রেরণ করা সিগন্যাল তারা পড়ত এবং পরে গ্রহণ করা ঐ সমস্ত সিগন্যালের যাবতীয় তথ্য স্তম্ভের সিমাফোর অপারেটরের কাছে পাঠানো হত। গ্রহণ করা সিগন্যালগুলি দুই কাঠের হাতের বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের অবস্থানের মাধ্যমে সংকেত তৈরি করে অপারেটর পুনরায় সেগুলি পরের দূরবর্তী স্তম্ভে প্রেরণ করে দিত। প্রায় ১৯৬টি সংকেত তৈরর সম্ভব হতো দুটি কাঠের হাত দ্বারা। স্তম্ভগুলির ভিতরের ফাঁপা অংশে সিঁড়ি দিয়ে কাঠের মেঝে যুক্ত প্রতিটি তল তৈরি করা হত। তবে সিঁড়ি থাকত না উপরের তলে পৌঁছতে। মই ব্যবহার হত।
বার্তা প্রেরণের জন্য আরও একটি পদ্ধতি প্রচলন ছিল যাকে বলা হত শাটার টেলিগ্রাফ পদ্ধতি। ইংল্যান্ডের লর্ড জর্জ মুররে এই পদ্ধতির উদ্ভাবক। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যেকার বিরোধের কারনে সিমাফোর পরিত্যাগ করে ইংল্যান্ডে এই পদ্ধতি চালু হয়। এই পদ্ধতিতে একটা বড় খোলা কাঠের ফ্রেম তৈরু করা হত যাতে আনুভূমিক অক্ষে ৬টি শাটার বসানো থাকত। বড় এবং ভাড়ি শাটার সিস্টেম দ্বারা সজ্জিত একটি বিশেষভাবে নকশা করা ভবনের ভিতর থেকে দড়ি টেনে শাটারগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হত। প্রকৃতির আলোককে ব্যবহার করে শাটারগুলির সাহায্যে সংকেত তৈরি করে যা প্রেরণ করা হতো একই সরলরেখায় অবস্থিত পরপর স্তম্ভগুলির মাধ্যমে। লন্ডন থেকে পোর্টসমাউথে এই পদ্ধতি একটি বার্তা যেতে সময় লেগেছিল মাত্র ১৫ মিনিট। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - simaphor tower)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours