পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

২০০৭ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দর ছিল ৭০ ডলার। তখন দেশে পেট্রল ও ডিজেল ছিল লিটারে যথাক্রমে ৪৩ ও ৩০ টাকার কিছু বেশি। এখনও আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দর কমবেশি একই। কিন্তু এখন ভারতে জ্বালানি তেলের দাম কোথাও কোথাও সেঞ্চুরি পার করেছে। এই উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট কেন্দ্রে থাকা সরকারটি কতটা জনদরদি। একেই করোনাকালে কেন্দ্রের চরম অপদার্থতা মানুষকে অসহায় করে তুলেছে, তার উপরে তেলের দামের এই বেপরোয়া অঙ্কটা সাধারণ মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছে। যার ফল মিলেছে বিগত নির্বাচনে। 

২৬ শে ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে কমিশন। ঠিক পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারিই ফের তেলের দাম বাড়ায় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলি। নির্বাচনের সময় তখনই জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। নির্বাচন আসছে তা জানত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তা স্বত্বেও কিন্তু লাগাতার পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়িয়ে গিয়েছে তারা। এমনকি ভোটের সময় মাস দেড়েক একটু থেমে থাকলেও ভোট মিটতেই শুরু হয়ে গিয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খেলা। ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৯ বার পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্র। 

পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা রাজস্থানের একটি জনপদ শ্রীগঙ্গা নগর। আমাদের দেশে সব চাইতে বেশি দামে পেট্রল ডিজেল সেখানেই বিক্রি হয়। এই লেখা মুদ্রনে যাওয়া পর্যন্ত শ্রীগঙ্গা নগরে পেট্রল এবং ডিজেল বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে কমবেশি একশো ছয় টাকা এবং সাড়ে আটানব্বই টাকা দরে। পেট্রলের দরে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে শ্রীগঙ্গা নগরকে টক্কর দিচ্ছে মুম্বাইও।

আমাদের রাজ্যও কিন্তু কম যাচ্ছে না। প্রায় পচানব্বই টাকায় পেট্রল এবং ডিজেল প্রায় উনআশি টাকা। বিভিন্ন দেশে পেট্রল ডিজেলের দাম নজরকারি সংস্থা globalpetrolprices.com এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ি পড়শি দেশগুলি তো বটেই, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিন আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের চাইতেও এই মুহুর্তে ভারতে পেট্রলের দাম সব চেয়ে বেশি। পাকিস্তানেও আমাদের থেকে জ্বালানি তেলের দাম কম। স্থানীয়ভাবে কর, ভ্যাট, পরিবহণ শুল্ক এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের কর মিলিয়ে পেট্রলে ৬০% এবং ডিজেলে ৫৪% কর নেওয়া হয়। করোনার প্রথম ধাপে যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম শূন্যের নিচে চলে গিয়েছিল, তখনও আমরা তার সুফল পাইনি। মোদি সরকার সুকৌশলে তাদের কর বাড়িয়ে দাম না কমিয়ে তুলে নিয়েছিল সেই বিপুল পরিমানে লাভের টাকা। 

তেলের দাম বাড়লে কি শুধুই চার বা দু’চাকার মালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে? পেট্রল-ডিজেলের দাম আকাশছোঁয়া হলে তা সরাসরি প্রভাব ফেলে আমাদের সকলের দৈনন্দিন জীবনেও। প্রতিদিনের খাবারে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, সবজির দামও যে এখন চড়া হতে শুরু করেছে খেয়াল করেছেন নিশ্চয়। এর পিছনেও রয়েছে সেই তেলেরই দাম। ভেবে দেখলেই বুঝবেন, পাঞ্জাব থেকে চাল, আলু, নাসিক থেকে পেঁয়াজ আনতে লরি মালিকদের খরচ কতটা বেড়েছে। আর সেই খরচের কড়ি তো গুণতে হচ্ছে আমজনতাকেই। জ্বালানি তেলের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে ভোজ্য তেলেরও। একশো, একশো কুড়ি টাকা দরের সর্ষের তেল এখন দুশোর ঘরে। বাস মালিকেরা এখনই ঘোষণা করে দিয়েছেন তেলের দাম বাড়ার কারণে বাস ভাড়া না বাড়ালে তারা আর পথে বাস নামাবেন না। 

একেই করোনার ফলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারে টান, তার উপরে পেট্রোল ডিজেলের ক্রমবর্ধমান দামের সরাসরি প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনযাত্রায়। আচ্ছে দিনের বেলু্ন থেকে মোদী ম্যাজিকের হাওয়া বেরিয়ে আপাতত তা চুপসে গিয়েছে। সেই প্রভাব অবশ্যই গিয়ে পড়েছে ভোটের বাক্সে। জাত পাতের বিভেদ, সুনার বাংলার স্বপ্নের চেয়েও মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটা বেশি মূল্যবান। জ্বালানী তেলের দাম বাড়িয়ে কেন্দ্র এই দুর্দিনেও কোনওরকমে বেঁচে থাকার উপরে ক্রমাগত খাঁড়ার আঘাত এনেই চলেছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলি তা যে মোটেই ভালভাবে নেয়নি সেই সত্যিটা এখনও স্বীকার করে উঠতেই পারেনি বালিতে মুখ গুঁজে থাকা কেন্দ্র সরকার। তার মাশুলই তাদের দিতে হয়েছে, আগামী দিনেও হয় তো দিতে হবে।

(www.theoffnews.com - Modi government petrol diesel price)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours