সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:
পরিষ্কার দিনে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে চুনারে সংবাদ পাঠাতে সময় লাগত মাত্র ৫০ মিনিট। কলকাতা ও চুনারের মধ্যে টাওয়ারগুলি ছাড়াও ফোর্ট উইলিয়াম ও ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে যোগাযোগের কারনে ২৫ কিমি ব্যাপী কয়েকটি ‘টাওয়ার’ স্থাপন করা হয়েছিল। শ্যামবাজার যাওয়ার পথে লকগেট সেতুতে ওঠার মুখে B.T. রোডে এই ধরনের ৭৫ ফুট উঁচু এক টাওয়ার দূর থেকে চোখে পড়ে। যেখানে উৎকীর্ণ করা আছে “THIS 75 FEET TALL MASONARY TOWER WAS BUILT IN 1831 FOR THE GREAT TRIGONOMETRICAL SURVEY CONDUCTED BY GEORGE EVEREST, THE THEN SUPERINTENDENT OF THE GREAT TRIGONOMETRICAL SURVEY PROJECT & SURVEYOR GENERAL IN CHARGE OF ALL TOPOGRAPHICAL AND REVENUE SURVEY CARRIED OUT BY SURVEY OF INDIA ”। সুখচরেও এই ধরনের একটি ‘টাওয়ার’ বর্তমান।
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ার ব্যবহৃত হয়েছিল সিগন্যালের মাধ্যমে জাহাজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কলকাতা ও মেদিনীপুরের খেজুরির মধ্যে সিমাফোর টেলিগ্রাফ পদ্ধতি চালু ছিল বলে জানা যায়। তখন খেজুরি ছিল চালু সামুদ্রিক বন্দর। ১৩টি টেলিগ্রাফ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল কলকাতা ও খেজুরির মধ্যে জাহাজের গতিবিধি নজরে আনার জন্য। যার খরচ পড়েছিল সেই সময় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। ১৮৪৭ সালের হ্যারিকেন ঝড়ে টাওয়ারগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৮১-এ ফোর্ট উইলিয়ামস্থিত কলকাতা কমিশনার অফিস এক প্রকান্ড গোলক কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম টাওয়ারের সর্ব্বোচ্চ স্থানে স্থাপন করেছিল। যেটি সাধারণের কাছে ‘টাইম বল’ নামে পরিচিত ছিল। সময়ের হিসাব রাখতে এই টাইম বল ঘড়ি হিসাবে সাহায্য করত। সময়ের সূ্চক হিসাবে বলটি রাত ১২.৫৫ মিনিটে ওঠানো হত এবং প্রতিদিন দুপুর ১.০০ টায় নামানো হত। সমুদ্রের নাবিকদের সময় দেখানোর জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
ক্লউডে চাপ্পে ছিলেন এই সিমাফোর পদ্ধতির আবিষ্কারক। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে প্রথম সিমাফোর টাওয়ারের মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণের কর্ম পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৭৯২ সালের ২২ মার্চ ফ্রান্সের সংসদে চাপ্পে ও তার চার ভাইয়ের আবিষ্কার তখন এই ব্যবস্থার নাম ছিল সিমাফোর টেলিগ্রাফ বা অপটিকাল টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা। ফ্রান্সের বিপ্লবের সময় সেখানকার ‘রেভুউলুশনারী আর্মি’ এই পদ্ধতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে সংবাদ আদানপ্রদান করত। নেপোলিয়ন এই ব্যবস্থাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে যখন কোন ‘মিলিটারী ক্যাম্প’ তিনি পরিদর্শনে যেতেন তখন সঙ্গে নিতেন একটি পোর্টেবল সিমাফোর যন্ত্র।
১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশরা ফ্রান্সের পরেই যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংকেত প্রেরণের জন্য সিমাফোর পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিল। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশরা তাদের কলোনিগুলিতে এই সিমাফোর পদ্ধতি চালু করে। ঐ বছরেই ভারতবর্ষে চলে আসে সিমাফোর পদ্ধতির রূপরেখা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে সিমাফোর টাওয়ারগুলি। আন্দুল, জয়চন্ডী হিল, সিঙ্গুর ও নালিকুলের মধ্যবর্তী ভোলা, মোবারকপুর, বাঁকুড়ায় তাঁতিপুকুর জঙ্গল ও ছাতনা, গোঘাটের নবসান, ওন্দায় সলঘাটায় এখনও অস্তিত্ব রক্ষা করে দাঁড়িয়াছে কয়েকটি সিমাফোর টাওয়ার। পরিত্যক্ত ত্রিকোণমিতিক টাওয়ারগুলি পরবর্তীকালে জরিপের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। কৌতুহলোদ্দীপক পরিত্যক্ত টাওয়ারগুলির স্মৃতিচিহ্ন একধরণের পুরাকীর্তি হিসাবে বলা যেতে পারে। অবহেলিত অবস্থায় ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে স্থাপত্যগুলি এখনও দণ্ডায়মান। বর্তমানে কয়েকটি টাওয়ার উন্নয়ণের কারন দেখিয়ে ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে। এগুলি সরকার হেরিটেজ হিসাবে কখনই ঘোষিত করেনি। কয়েকটি শুধু P.W.D র আওতার অধীনে । অথচ ফ্রান্স, জার্মানি, মাল্টা, ইংল্যান্ডে এইসব টাওয়ারগুলিকে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা আছে এবং কয়েকটিকে আবার নতুনভাবে সেখানে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। টাওয়ারগুলিকে কেন্দ্র করে ঐ সব দেশগুলিতে এলাকাগুলি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষামূলক হিসাবে সেখানকার বর্তমান প্রজন্মকে হাতে কলমে দেখানো হয় কিভাবে সিমাফোর টেলিগ্রাফ পদ্ধতিতে সংবাদ প্রেরণ করা হত। অন্যদিকে আমাদের দেশে স্থাপত্যগুলির ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত থেকেই একদিন কালের গর্ভে নিমজ্জিত হবে টাওয়ারগুলি। অজানা ইতিহাসের ভুল তথ্য নিয়ে তার সাক্ষী থাকব আমরা। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় সত্যই আমরা ‘ইতিহাস বিস্মৃত জাতি’। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - simaphor tower)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours