তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
মৃত্যুর প্রাক মূহুর্তে প্রিয়জনদের উদ্দেশ্য স্মরণীয় বিপ্লবীদের লেখা দীনেশ মজুমদারের সেই ঐতিহাসিক নানা চিঠির অংশ বিশেষ নিচে বর্ণিত হল।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত এক তরুণ, জেলখানা থেকে দীর্ঘ একটি চিঠিতে মা-কে লিখেছেন, ‘মাগো, আমি যে আজ মরণের পথে আমার যাত্রা শুরু করেছি তার জন্য কোন শোক করো না।… আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি, তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে, মন খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।...’ পরাধীন স্বদেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন দু’চোখে নিয়ে উনিশ বছরের প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেও হাতে তুলে নিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। মেদিনীপুরের কুখ্যাত জেলাশাসক রবার্ট ডগলাস ১৯৩২-এর ৩০ এপ্রিল জেলা বোর্ডের মিটিং করছিলেন। অতর্কিতে সেখানে ঢুকে গেলেন প্রদ্যোৎ ও প্রভাংশু পাল। ডগলাস হত্যা সফল। প্রভাংশু পালাতে সক্ষম হলেও ধরা পড়ে গেলেন প্রদ্যোৎ। আট মাসের বিচারপর্ব শেষে তাঁর ফাঁসি হয়। মা পঙ্কজিনী দেবীকে লেখা সেই চিঠি শেষ হচ্ছে এই ভাবে: ‘...মা, তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনো মরতে পারে! আজ চারদিকে চেয়ে দেখ, লক্ষ লক্ষ প্রদ্যোৎ তোমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি বেঁচেই রইলাম মা অক্ষয় অমর হয়ে।’ মা-কে ছাড়াও ‘ফাঁসির আসামী’ প্রদ্যোৎ বড়দাদা প্রভাতচন্দ্র ভট্টাচার্য, বড়বৌদি বনকুসুম দেবীকে একাধিক চিঠি লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল ভক্ত এই মেধাবী তরুণ বৌদিকে লিখেছেন: ‘আমি আসি।… মায়ের প্রাণে আঘাতটা খুবই বেশি হয়ে বাজবে তা জানি, কিন্তু আপনারা সে-আঘাতটাকে লঘু করাবার চেষ্টা করবেন।… আসি, কেমন?’
মেদিনীপুরের আর এক বিপ্লবী ব্রজকিশোর চক্রবর্তীকে তাঁর মা-বাবা আদর করে ‘বেজা’ বলে ডাকতেন। জেলাশাসক বার্জ হত্যা-মামলায় অভিযুক্ত ব্রজকিশোর, নির্মলজীবন ঘোষ এবং রামকৃষ্ণ রায়ের ফাঁসি হয় ১৯৩৪-এর অক্টোবরে। ফাঁসির চার দিন আগে মরণ-নিস্পৃহ চিঠি লিখছেন একুশ বছরের অকুতোভয় ব্রজকিশোর: ‘বাবা, আপনি চার বছর আগে বলেছিলেন যে, যখন আমার চন্দ্রের দশা পড়বে তখন আমাকে বারো বছর প্রবাসে বাস করতে হবে। এমনকি আমার মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়! এই কথা আজ বর্ণে বর্ণে সত্য হচ্ছে।’ আর মা-কে লেখা চিঠিতে আদরের ‘বেজা’ ঠাকুরমা, দিদিমা, পিসিমা, কাকিমা এবং অন্য গুরুজনদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ‘শেষ বিদায়’ চেয়েছেন: ‘আমার মা, মা আমার, প্রণাম নিন।… ভোরের বেলা শূন্য কোলে/ ডাকবি যখন ‘বেজা’ বলে/ বলবো আমি— নাই গো ‘বেজা’ নাই, মাগো যাই।’
ব্রজকিশোরের সঙ্গেই ফাঁসি হয়েছিল রামকৃষ্ণ রায়ের। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে রামকৃষ্ণ মা-কে চিঠি লিখেছেন। এই চিঠির বয়ানেও মৃত্যুকে হাসিমুখে গ্রহণ করার অনাবিল আনন্দ, মৃত্যুকে যেন মনে হচ্ছে ‘আলো’, সেই আলোর আহ্বানেই আত্মহারা হয়ে ছুটে চলা, অনন্তের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আকুতি: ‘মা, আজ আমার হৃদয়ে কী সুখ যে অনুভব করছি তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।’ এই পৃথিবী ঠিক যেন একটি বাজারের মতো, বাজার করুক বা না-করুক, তাদের ফিরে যেতে হবে। চিঠি শেষ হচ্ছে চিরবিদায়ের কথা বলে: ‘আমি তবে এবারের মত আসি মা! আপনার কোল হতে চিরবিদায় নিয়ে চললাম। ‘গীতা’টি দিয়ে গেলাম।’
টেগার্টকে হত্যা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন বসিরহাটের দীনেশ মজুমদার। কিন্তু চন্দননগরের পুলিশ কমিশনারকে হত্যা করার সময় তাঁর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, কলকাতায় ধরা পড়ে গেলেন। ১৯৩৪-এর ৯ জুন আলিপুর জেলে যখন তাঁর ফাঁসি হল, বয়স সাতাশ। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে দাদা সুরেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন। ‘প্রিজ়নার্স লেটার’ ছাপ মারা জেলখানার বিশেষ চিঠি লেখার কাগজে ১৯৩৪-এর ১৪ এপ্রিল যে চিঠি লিখছেন, তাতে পয়লা বৈশাখের নববর্ষের স্পর্শ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দিনকয়েক আগের নতুন বর্ষায় ধোয়া পৃথিবীর মায়া: ‘পয়লা বোশেক। শনিবার। নতুন বছর আসবে বোলেই বুঝি গত বুধবার রাত্রিতে প্রথম বৃষ্টি এসে সব কিছু ধুয়ে দিয়ে গেল। একদিনের বৃষ্টিতেই যেন পৃথিবীর রং, গন্ধ বদলে গেল।’ এই চিঠির দিন পনেরো পর বৌদি বিভাবতী দেবীকে লেখা চিঠিতে কিন্তু ফুটে ওঠে এক দৃঢ়চিত্ত বিপ্লবীর অসীম আশা: ‘তোমাদের ছেলেমেয়েদের আমার আন্তরিক স্নেহাশীষ জানিও। তারা যেন নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে উঠতে পারে। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানবসমাজের ব্যথা যেন মনে-প্রাণে অনুভব করতে পারে। নিজেদের যেন ফাঁকি না দেয়।’
চারুচন্দ্র বসু ভেবেছিলেন তাঁর ফাঁসি হবে ২৪ ফেব্রুয়ারি। তাই ১৯০৯-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি আলিপুর জেল থেকে চিঠিতে লিখছেন— ‘নয় দিন পরে আমার জীবনের সব খেলা ফুরাইবে’। এরই মধ্যে জেলখানায় এই উনিশ বছরের যুবকের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে, তবু তাঁর মুখ খোলানো যায়নি। কেমন ছিল এই অত্যাচার? বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে ভগিনী নিবেদিতার একটি চিঠিতে। মিসেস এবং মিস্টার এস কে র্যাটক্লিফকে তিনি লিখছেন: ‘‘অশোক নন্দী এবং উল্লাসকর দত্ত কবুল করেছে, বিচারে ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়ে যাবার পরেও চারুকে রাতে ইলেকট্রিক শক দিয়ে অত্যাচার করা হত তথ্য পাবার জন্য। তাঁরা চারুর কান্না এবং চিৎকার শুনতে পেতেন।’’ জন্ম থেকেই চারুচন্দ্রের ডান হাত পঙ্গু ছিল। হাওড়ায় এক ছোট ছাপাখানার সামান্য কর্মীটি বাধ্য হয়ে থাকতেন মাসিক আট আনা ভাড়ায় একটি খোলার ঘরে। মাঝে মাঝে বগুলায় মেজদাদার বাড়ি যেতে হয়। সেখানে তেরো বছরের বালিকা স্ত্রী থাকেন যে! আলিপুর বোমা মামলার সরকারি আইনজীবী আশুতোষ সরকারকে আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে গুলি করেছেন চারু। ধরাও পড়েছেন। এই ঘটনার ৩৬ দিনের মধ্যে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ!
চারুচন্দ্র জানতেন তাঁর ফাঁসি আরও আগে, ২৪ তারিখেই হয়ে যাবে। মৃত্যুর আগে শ্যালক ছত্রধারী ঘোষকে স্ত্রীর প্রসঙ্গে বেদনাহত কলমে লিখছেন: ‘একটি অভাগিনী তের বৎসর বয়স্কা বালিকাকে দীনহীন অবস্থায় এই সংসার-সমুদ্রে ভাসাইলাম।... তাহাকে আপনাদের কাছে অর্পণ করিলাম।’ এই চিঠিতেই পুনশ্চ-সংযোগে লিখেছেন—‘আমার শেষ আশা আমার মৃত্যুর দিনে ২৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে আপনি অবশ্যই আসিবেন।… বোধহয় ভগবান আমার এ আশা পূর্ণ করিবেন।’
আলিপুরের বিখ্যাত ‘ভবানী ভবন’ যাঁর নামে, তিনি বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ডাকনাম টুনু। দার্জিলিঙে লেবং রেস কোর্সে ছোটলাট জন অ্যান্ডারসনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন ভবানী এবং রবি বন্দ্যোপাধ্যায়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। দুজনেই ঘটনাস্থলে ধরা পড়ে গেলেন। ১৯৩৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলে একুশ বছরের ভবানীপ্রসাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল। মৃত্যুর তিন দিন আগে ছোটভাই দুর্গাপ্রসাদকে তিনি চিঠি লিখেছেন: ‘অমাবস্যার শ্মশানে ভীরু ভয় পায়— সাধক সেখানে সিদ্ধিলাভ করে।… আজ আমি বেশি কথা লিখব না, শুধু ভাবব। মৃত্যু কত সুন্দর! অনন্ত জীবনের বার্তা তার কাছে।’
ত্রিপুরার বিটঘর গ্রামের সত্যেন্দ্রচন্দ্র বর্ধন মালয়ে ডাকবিভাগের কর্মী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন অগ্নিক্ষরা। সত্যেন্দ্র সরকারি চাকরি ছেড়ে দেশমুক্তির সাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন। চার সঙ্গীকে নিয়ে তিনি মালয় থেকে গোপনে ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে যান। জলপথে। আরব সাগর পার হয়ে কাথিয়াবাড় উপকূলে যে দিন পৌঁছলেন, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। স্থানীয় লোকেরা ডাকাত সন্দেহে পুলিশে খবর দিল। ধরা পড়ে গেলেন তাঁরা। মাদ্রাজ দুর্গে ফাঁসি হয়েছিল সত্যেন্দ্রর। তারিখটা ১৯৪৩-এর ১০ সেপ্টেম্বর। ফাঁসির কয়েক দিন আগে ‘কানুদা’ সত্যেন্দ্রচন্দ্র ছোট ভাইকে গোপনে একটি চিরকুট পাঠাতে পেরেছিলেন: ‘তোমাকে আমার কিছু বলার বা লেখার নেই। ঈশ্বর আমার ভাগ্যে আমার মাতৃভূমির জন্য আত্মদান লিখে রেখেছেন। তার জন্য আমি সুখী ও গর্বিত। যদি কখনও সুযোগ পাও, প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করো। স্বাধীনতার জন্য আত্মদান বাঙালিদের কাছে নতুন কিছু নয়।’
মাদারিপুরের বিপ্লবী পূর্ণ দাসের কাছে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন ফরিদপুরের মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত। ডাক নাম কোকো। বেশ কিছু ডাকাতি, দুজন বাঙালি পুলিশ অফিসার হত্যা ইত্যাদি বিপ্লবী কার্যক্রমে হাত পাকিয়ে হয়ে ওঠেন বাঘা যতীনের ছায়াসঙ্গী। বুড়িবালাম নদীতীরে পুলিশের সঙ্গে বাঘা যতীনের দলের বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের অন্যতম সৈনিক ছিলেন তিনি। ৮৪ দিনের দ্রুত বিচার-প্রহসন শেষে মামাতো-পিসতুতো দুই ভাই মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ফাঁসি হয় বালেশ্বর জেলে। মনোরঞ্জন এর আগে দিদিকে কখনও চিঠি লেখেননি, ‘এই জীবনের শেষে শেষপত্র’ লিখতে বসে স্বাভাবিক ভাবেই চিরবিদায় চেয়েছেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দিদির প্রতি তাঁর সান্ত্বনাবাক্যে প্রকাশ পেয়েছে গভীর জীবনদর্শন: ‘এ মায়াময় নশ্বর পৃথিবীতে কেহই কাহারও নয়। সমস্তই অনিত্য।… সকলেই চলে যাবে। আমরা এ সংসারে জল-বুদবুদের মত এই আছি, এই নাই।’ স্নেহের ছোট ভাই চিত্তরঞ্জনকে তাঁর ‘নোয়াদা’ লিখেছেন: ‘আগামী পরশু আমার জীবনের বিজয়া দশমী।’ অশুভ এই বিজয়ার বিষণ্ণতা এক মুহূর্তে আবিষ্ট করলেও অগ্নিচিত্ত বিপ্লবীর তেজ আছড়ে পড়ে আবার: ‘মনে করিও না এই জীবনদান নিরর্থক… আমরা আমাদের লক্ষ্যে নিশ্চয়ই পৌঁছাব। …তোমাকে আমি বহুদিন বলেছি, আজও শেষ দিনে বলে যাচ্ছি— কেউ এক গালে চড় দিলে তাকে দুই গালে দুইটা চড় দিবে।’ আর মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগে বড়দাদাকে মনোরঞ্জন তাঁর শেষ চিঠিতে লিখছেন: ‘নলিনী এবং বিজয় আমার নিকট দুইটি টাকা পাইবে। উহা শোধ করিয়া দিবেন।’ (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - revolutionist letters)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours