তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

ব্যক্তিগত তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ইতিহাসের পেছনে ঐতিহাসিক সত্যটা কি? লোভ আর নির্লোভ এর মধ্যে পার্থক্য কি? কবি শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায় বললেন, নির্লোভ হতে চাওয়ার চেয়ে বড় লোভ আর কিছু হয় না। আমি সহমত। আসুন এই দৃষ্টি ভঙ্গির একটু বিশ্লেষণ করা যাক, বা আমি আমার মত করে আলোকপাত করার চেষ্টা করি আমি কেন সহমত তা বলা দরকার। কেবল ওইটুকু বললে লাইনটা অস্পষ্ট থেকে যায়। আসলে মানুষ লোভী হয়ে উঠে সমাজের মধ্যে দিয়ে। আবার কেউ কেউ এর মধ্যে লোভহীন হয়ে উঠে অর্থাৎ নির্লোভ। কিন্তু নির্লোভ হতে চাওয়াটা সব চেয়ে বড় প্রচার।

নির্লোভ হল আত্মমগ্নতা, প্রচার নয়। মানব সভ্যতার একদম গোড়ার দিকে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ ও বাসস্থানের জন্য বেড়িয়ে পরে। দুইবেলা দুমুঠো খাবার চাওয়াটা লোভ নয়। এটা জৈবিক ও প্রাকৃতিক চাহিদা। যখনই চাওয়া পাওয়াটা ক্ষমতার অঙ্গনে প্রবেশ করে তখনই লোভের জন্ম হয় বা মূর্ত হয়ে উঠে। প্রচুর মানুষ আছেন যারা অল্পতে খুশি, শান্তিতে থাকেন, চাওয়া পাওয়ার পেছনে দৌড়ায় না, অর্থাৎ নির্মোহ থাকে তারাই নির্লোভ। যদি এরকম না হতো তাহলে জ্ঞানী গুণীরা এই কথা বলতেন না যে লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। এইগুলি সাধারণ মানুষ থেকে শেখা। আজকের চাওয়া পাওয়া হল বাজার কেন্দ্রিক ফলে লোভ এক সাধারণ ঘটনা। এই লোভের বিভিন্ন রূপ, প্রথম এসেছিলো ধর্মের রূপ ধরে, জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে।কারণ স্কিল মানে পাওয়ার। আমি আপনার ওপর কর্তৃত্ব করতে পারি আমার শিক্ষা ও জ্ঞান দিয়ে।

অর্থাৎ জ্ঞান হল একপ্রকার ক্ষমতার পুঁজি। এখন লোভ বিজ্ঞানের রূপ নিয়ে আসছে আরও ভয়ঙ্কর। লোভের দানবীয় মূর্ত রূপ হল রাষ্ট্র ও সরকার। তাই প্রতি যুগেই এর বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করেছে। লোভ হল অন্তহীন, সীমিত নয়।

রাষ্ট্র যন্ত্রের এই ক্ষমতার পেছনে ঐতিহাসিক সত্য হল লোভ, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন, কেন্দ্রীয়করণ জনগণকে বঞ্চিত করে কর্তৃত্ব কায়েম করা। এই অতিরিক্ত উৎপাদন করেছে সাধারণ মানুষ আর ক্ষমতা ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু কোম্পানি। আদিপ্রাণ থেকে মানুষের ইতিহাস পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই শক্তিশালী সত্ত্বাই পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তারপর মানুষের প্রাথমিক ইতিহাস থেকে সর্বশেষ ইতিহাস পর্যন্তও আমরা দেখতে পাই শক্তিমানের একনায়কত্ব। মানব ইতিহাসের প্রথম দিকে শক্তির উৎস ছিল গায়ের জোর বা পেশি শক্তি।

ধীরে ধীরে শক্তির উৎস হিসেবে হাতিয়ার, প্রজ্ঞা এবং স্বপক্ষের জনবল যোগ হতে থাকলো। জনবল এবং শক্তিসংঘ যে গোত্রের যতবেশি বড় হতে থাকলো সে গোত্র ততবেশি ভূখন্ডের উপর আদিপত্য বিস্তার করতে থাকলো। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকলো প্রতিষ্ঠান। মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। আর আধুনিক রাষ্ট্রের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল।

প্রথম দিকে গ্রিক সাম্রাজ্য ভাবত আমরাই শ্রেষ্ঠ, পৃথিবী আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, কিন্তু হলো না, এরপর রোমান সাম্রাজ্য ভাবলো পৃথিবীকে আমরা কর্তৃত্ব করবো, সেও টিকল না, এলো জার্মানরা, হিটলার ভাবতে শুরু করলো পৃথিবী আমার অধীনে থাকবে, তাও হলো না। তারপর, সোভিয়েত, পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আরও বৃহৎ শক্তির আধিপত্য শুরু হলো, অর্থাৎ একচেটিয়া বাজার কেন্দ্রিক সভ্যতা। এখন গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, apple, আম্যাজন প্রভৃতি আধিপত্যগামী শক্তিগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রক শক্তি।এরা সবাই মানুষকে ভোগবাদী করে তুলছে। মানুষ যদি ভোগবাদে অভ্যস্ত হয়ে পরে মানুষ লোভ তথা ক্ষমতা ও পুঁজির লড়তে ব্যর্থ হবে। এবং সেটাই এরা খুব সফলতার সাথে, সচেতন ভাবে করে চলেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রের এই যে বিবর্তন কি করে তৈরি হলো।

যখনই মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলো, ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরী হলো, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, সমাজপতি তথা শাসকরা ঠিক করে দিল। তখনই লোভের রাষ্ট্রীয়করণ হলো। মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হল, মনের ওপর বা চাওয়া পাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালো তখনই লোভ সিলমোহর পেল। নির্লোভ আছে বলেই লোভের অস্তিত্য আছে। ক্ষমতার প্রতি লোভ, অর্থের প্রতি লোভ হল, নামের প্রতি লোভ আজ সর্বগ্রাসী রূপে পরিণত হয়েছে

যা মানুষকে পদদলিত ও শোষণ করতে ছাড়া আর কিছু শেখায় না। আর আধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান হল এরই বাহন। ছোট ছোট লোভ থেকে বড় লোভের জন্ম হয়। বড় লোভ ছোট লোভকে গ্রাস করে ফেলে, এটা একটা নিরন্তন প্রক্রিয়া। তাই গৌতম বুদ্ধ সঠিক ভাবে বলেছেন,  Desire is the root of human suffering। Endless desire মানে endless suffering। তাই আত্মজ্ঞানী বা আত্মমগ্ন মানুষ নির্লোভ হয়। প্রকৃতি এবং এই কসমস নির্মোহ ও অনন্ত। আপনার দুইটি শত্রু। এক শত্রু বাইরে থেকে আপনার ওপর অত্যাচার করছে, বাজারের মধ্যে দিয়ে, দলের মধ্যে দিয়ে, প্রচারের মধ্যে এবং সর্বপরি রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে।

আর একটি শত্রু বাস করে আপনার ভিতরে। তাই আপনি সকলকে শত্রু মনে করেন। আসলে আপনি আপনার শত্রু, শুধু বাইরের শত্রু নয়। ভিতরেও শত্রু আছে। সেই কারণেই নিজেকে জানা দরকার, আমি কে? তা চেনা দরকার, আমি এই পৃথিবীর, প্রকৃতির প্রায় কিছুই জানি না এই বোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ আর সেটাকেই বলে আত্মজ্ঞান। তাই মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ যত বাড়বে, নিজেকে জানা যত বাড়বে নিয়ন্ত্রণহীন শাসক ও শোষক ও অবলুপ্তির পথে হাটবে। আবার  নতুন শাসক আসবে লোভ দেখাবে নতুন রূপে, আবার বিদ্রোহ বিপ্লব হবে, করোনার মতো শাসক ও রূপ বদলাবে।

এটাই নিরন্তন প্রক্রিয়া, এই ভাবেই ইতিহাস এগোয়, মানুষের অগ্রগতি হয়। তাই যত নির্মোহ থাকবেন তত শান্তিতে থাকবেন, নিজেকে চিনবেন। নিজের হোক আর রাষ্ট্রের হোক লোভের স্বরূপ বুঝতে পারবেন। লোভের স্বরূপ যদি বুঝতে না পারেন তাহলে লড়াইটা করবেন  কার বিরুদ্ধে এবং কিভাবে।

বিকল্প পথে সর্বাঙ্গীন মুক্তি আনতে গেলে শুধু নিজের সর্বাঙ্গীন স্বরূপ বুঝতে হবে, শুধু শাসক নয় তাহলে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকেও উপলব্ধি করতে পারবেন। গবেষক কল্যাণ ঘোষ সঠিক ভাবে বলেছেন যে পরিমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে সেই পরিমানে আত্মিক বিকাশ খুব কমই হয়েছে। আজকের বিজ্ঞান প্রযুক্তির মালিকদের স্বার্থে কাজ  করছে। আবার বহু সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মালিক একই কোম্পানি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ বিশেষ করে ১৭৭০ খৃষ্টাব্দের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে কৃষি ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। একই সাথে চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভাবনীয় সব উদ্ভাবনের ফলে মানুষের গড় আয়ু ও মানবজাতির জনসংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পায়। সব মিলিয়ে প্রকৃতির উপর মানুষের দানব সুলভ কর্তৃত্ব পড় পড় করে বেড়ে যায়। আজকে আমরা এইসবেরই একটা মোটামুটি চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছেছি বলে মনে হয়। এটা মূলতঃ পশ্চিমী একটা সর্বব্যাপী সর্বগ্ৰাসী ধ্বংসাত্মক মানসিকতা, যেটা গত ৩০০ /৪০০ বছরে আজ বিশ্বব্যাপী বিরাজমান।

এর সঙ্গে তাল রেখে আমাদের আত্মিক বিকাশ কোনও ভাবেই হয়নি, বরং আত্মিক অবনতি অনেক হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রতি সীমাহীন লোভ, অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতার প্রতি নেশা, যুদ্ধ বাসনা, প্রকৃতির প্রতি চরম অসংবেদনশীলতা - সবই আত্মিক বিকাশ ও চৈতন্যের উন্মোদন সমান তালে না হওয়ার কারণে।আদিবাসীরা সভ‍্যতার এই ফাঁদে পা ফেলেনি। মধ্য ও পূর্ব ভারতে থাকা সাঁওতাল, মুন্ডা, হো সমুদায় গোষ্ঠীরা বা উওর পূর্ব ভারতের নাগা, মিজো, মণীপুরি ও অন্যান্য সমুদায় গোষ্ঠীদের সমাজ ব্যবস্থা, বয়স্ক জ্ঞানী লোকদের দ্বারা পরিচালিত সামাজিক সংগঠন গুলো এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত মূলক।

আমাদের আজ প্রধানতঃ সংবেদনশীল, চিন্তা শীল, স্বার্থহীন হয়ে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে ও নিজেদের আত্মিক বিকাশের উপর জোর দিয়ে একটা সাম্নজস‍্য পূর্ণ আর্থ- সামাজিক ব‍্যবস্থার ছবি ভাবতে হবে।

(www.theoffnews.com - civilization power)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours