পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
আমাদের দেশে বছর দেড়েকের অতিথি করোনার সঙ্গে আমাদের সনাতনী রাজনীতি তথা রাজনৈতিক নেতাদের দারুণ একটা মিল লক্ষ্য করা যায়। প্রথমজন টিকে থাকার জন্য বার বার মিউট্যান্ট বদল করতে থাকে, দ্বিতীয়জন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বারবার দল বদল করতে থাকে। বলাবাহুল্য দুটিই বেশ সংক্রামক এবং অতিশয় ক্ষতিকারক মানব জাতির পক্ষে। কি প্রেক্ষিতে এ কথা বলছি আশা করি এতক্ষণে তা বোধগম্য হয়েছে সকলেরই। ক্ষমতার লোভে দলবদল এ রাজ্যে তো বটেই দেশেও খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। বহু দেশ বরেণ্য নেতাও দলবদল করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি রাজ্যের দলবদলের চিত্রটা অন্যদের বেশ লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।
ভোটের টিকিট না পেয়ে যারা বিভিন্ন দল বদল করেছিলেন তারা তো প্রমাণ করেই দিয়েছেন যে তাদের রাজনীতির আসল উদ্দেশ্যই হল ক্ষমতার অলিন্দে থেকে সুখভোগ। এবার অন্যদলে গিয়ে যখন বুঝলেন যে সেখানে ক্ষমতালাভ হল না। ব্যাস তখনই সেখানে দমবন্ধ হতে লাগল। হ্যাঁ, এই দমবন্ধ কথাটি এবারেই নতুন চালু হয়েছে। এখনকার রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সকলেই বোধহয় হাঁপানির রোগী, মাঝে মধ্যেই, যখন তখন দমবন্ধ হয়ে আসছে তাদের। একটাই ওষুধ, একটু চেঞ্জ। এপাড়া থেকে ওপাড়া গেলেই সাময়িক মুক্তি। কিন্তু কোনও ক্ষমতা না পেলেই ব্যস আবার দমবন্ধ, আবার পুরনো অথবা নতুন কোনও পাড়ায়।
সাংবাদিকতার পেশায় প্রথমদিকে বড়রা বলতেন একটা কথা “লজ্জা, ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়”। অর্থাৎ সাংবাদিক হতে গেলে ওই তিনটি জিনিস থাকা চলবে না। কিন্তু রাজনীতি করতে গেলে এই তিনটে জিনিসের নামও শোনা চলবে না সেটা তখনও এতটা স্পষ্ট করে বুঝিনি। বড়রা আরও একটা কথা বলতেন রাজনীতিতে কি না হয়? তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হত, আজ দেখতে পাচ্ছি সেই চরম সত্য।
বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় দেখেছি সিংহ ভাগ মানুষই রাজনীতি নিয়ে বীতশ্রদ্ধ, রাজনৈতিক নেতাদের তারা বিশ্বাস করেন না, প্রকারান্তরে নিচু নজরেই দেখেন। কিন্তু তা স্বত্বেও রাজনীতির এই বাড়বাড়ন্ত কেন? শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভ এবং আবশ্যকতা। সাধারণ মানুষও ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিকেই পছন্দ করেন, তার চাটুকারিতা করেই কাজ হাসিল করতে ভালবাসেন। মুকুল রায়ের দল বদলে আমরা আলোচনা করি, সেটা বড় মাপের উদাহরণ বলে। কিন্তু ছোট ছোট এলাকায়, অতি ছোট নেতা বা রাজনৈতিক কর্মীরাও দলবদল করেন অহরহ। তাদের কথা উঠে আসে না। এই দলবদলেও থাকে ক্ষমতারই নেশা। প্রত্যন্ত এলাকার মজদুর সঙ্ঘ বা অটোচালকদের ইউনিয়ন। বাম আমলে এমন সব সংগঠনই ছিল তাদের দখলে। যে দিকে যে ইউনিয়ন নজরে পড়ে তার প্রায় সবটাই তখন লাল। সরকার পাল্টাতেই সেই সব সংগঠন রাতারাতি হয়ে যায় নতুন শাসকদলের। এর মধ্যে কি কোনও রাজনৈতিক আদর্শ নজরে পড়ে? পড়ে না। যেটা প্রকট হয় সেটা ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতার আবশ্যকতা। অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষগুলিও রাজনীতি করেন ক্ষমতার লোভে পড়েই। তার চাওয়ার সঙ্গে রাজ্য বা জাতীয় স্তরের নেতাদের চাওয়ার পার্থক্য হয়তো থাকে। কিন্তু মূল জিনিস ক্ষমতা।
সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচনের আগেকার কথা একটু ভাবুন তো। ফি দিন একের পর এক নেতা নেত্রী যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। বাতাসে কেমন যেন পরিবর্তনের সুর, সেই সুরে গলা মিলিয়ে শাসক দলের নেতারা ক্রমেই যোগ দিচ্ছেন গেরুয়া শিবিরে। এতদিন মানুষের জন্য কাজ করতে না পারায় বেদনাহত তারা, আবার নতুন দলে যোগ দিয়ে সত্যিই মানুষের জন্য কিছু করতে পারবেন বলে চনমনে সকলে। রোজই চলছে এই নাটক। অংশ নিয়েছেন প্রকৃত অভিনেতারাও। ভোটের ফল বেরতেই বদলে গেল সব কিছু। যে শাসক দলে থেকে মানুষের জন্য কাজ করতে না পেরে বিজেপিতে গিয়েছিলেন নেতা, অভিনেতারা। তারাই আবার মানুষের কাজ করতে চেয়ে ঘরে ফিরতে চান। সাধারণ মানুষও এই সব নাটক, যাত্রা দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে কোনও বিকল্প নেই। নির্লোভী রাজনৈতিক নেতা এখন সোনার পাথর বাটি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করা কোনও ছাত্রকে বলতে শুনেছেন ভবিষ্যতে সৎ রাজনৈতিক নেতা হতে চাই। সব বাবা মায়েরাই তার ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক হওয়ার জন্য চাপ দেন। কোনওদিন কোনও বাবা মা কি সন্তানকে বলেছেন বড় হয়ে তোমাকে সৎ রাজনীতিবিদ হতে হবে? না। তাই তো এই পেশায় আজ বেনো জলের জোয়ার। তর্কের খাতিরে কেউ কেউ রাজনীতিতে আসা কিছু শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের কথা বলতেই পারেন। দিতে পারেন বিধান চন্দ্র রায়ের উদাহরণ, কিন্তু তা ব্যতিক্রম, অতি স্বল্প। এখনও যে সব ছিটে ফোঁটা কৃতিরা রাজনীতিতে যোগ দেন তারাও এসেই মূল স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। কেউই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারেন না। তাই ক্ষমতালোভীদের নাটক দেখে চায়ের কাপেই তুফান তুলব আমরা। সেই সুযোগে বার বার মিউট্যান্ট, থুড়ি দল বদলে কাজ হাসিল করবেন ওরা।
(www.theoffnews.com - party change leader Mukul Roy)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours