তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
করোনা মহামারী হল মহান সৃষ্টিকর্তার মহান সময়ের যমদূত।
ইতিহাসে করোনার এর চেয়েও ভয়ঙ্কর মহামারীর ঘটনা অতীতে ঘটেছে। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী ছিল বিউবোনিক প্লেগের প্রার্দুভাব। ১৩৪৬ সালে প্রথম প্লেগের প্রার্দুভাব ছড়াতে শুরু করে। ব্ল্যাক ডেথ বা কালো মৃত্যু নামে ইতিহাসে পরিচিত ওই মহামারী পরবর্তী কয়েক বছরে কেড়ে নিয়েছিল শুধু ইউরোপেই আড়াই কোটি জীবন। সারা পৃথিবীতে ওই প্লেগে মারা যায় বিশ কোটি মানুষ। ইতিহাস বলে প্রায় অর্ধেক ইউরোপ উজাড় হয়ে গিয়েছিল ওই ভয়ঙ্কর মড়কে। স্পেন ও পর্তুগাল থেকে ১৫২০ সালে অভিযাত্রীরা আমেরিকায় নিয়ে যায় গুটি বসন্ত রোগ। ওই মড়কে আমেরিকার আদি জনগোষ্ঠীর ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ উজাড় হয়ে যায়।
এরপর ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু থেকেও পৃথিবীতে মারা গিয়েছিল পাঁচ কোটি মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরা সৈন্যদের থেকে এই ফ্লু ভাইরাস ছড়িয়েছিল। ওই মহামারীতে গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩% থেকে ৫% প্রাণ হারায়। এইচআইভি এইডস যখন মহামারি আকারে প্রথম ছড়িয়েছিল ১৯৮০র দশকে, তখন সেই মহামারীতেও প্রাণহানি ঘটেছিল তিন কোটি ২০ লাখ মানুষের।
সব চেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো এই প্লেগ মহামারীর পরই জন্ম নেয় রেনেসাঁ। মৃত্যু শেষ কথা নয়। জীবন মৃত্যুর থেকে বড়। ব্যক্তিগত মৃত্যু আছে, থাকবে, কিন্তু সার্বজনীন ভাবে শুধু জীবনই আছে, চতুর্দিকে জীবনের জয়গান। মানুষ সবসময়েই মরতে ভয় পায় যেকোনও বয়সেই, কিন্তু মৃত্যু অবধারিত শান্তিতে মরা প্রয়োজনীয় আতঙ্কে নয়। আর চিরকালই মানুষ, বিশেষত গরিব মানুষ মরতে মরতে বাঁচে। এটাই অভিজ্ঞতা আর এটাই ইতিহাস, আর শেষ বিচারে এটাই অগ্রগতি। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হয়, বিজ্ঞানের জয় হয়।
এই একই আতঙ্ক বা ভয় প্রত্যক্ষ করেছিল প্লেগের সময়ে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ বহু প্রথিত যশা মানুষ। সবই বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে। একটু এদের ভূমিকা দেখে নেওয়া যাক। আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশি আতঙ্ক সেই সময়ে ছিল, কারণ আধুনিক বিজ্ঞান তখন পরিণত হয়নি।
ফেলে আসা ইতিহাস জানান দেয়, প্লেগের এই ভয়াবহতায় রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্য রচনাতেই থেমে থাকেননি, নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। ভগিনী নিবেদিতা তখন সদ্য এসেছেন কলকাতায়। বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের। মানবহিতৈষী দু’জন সেদিন মহামারী সামলাতে এক সঙ্গে পথে নেমেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেক্সনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।”
জগদীশচন্দ্র বসু প্লেগের ভয়ে বাড়ি পরিবর্তন করেছিলেন। তার নির্দিষ্ট কারণ অবশ্য ছিল। ১৩৯ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে তিনি সুহৃদ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “উপরের ঠিকানা থেকে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি পলাতক—প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটি লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া আসিয়া উক্ত ঠিকানায় আছি—কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।” এ কেবল জগদীশচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রেই নয়, প্রায় সকল কলকাতাবাসীর এমন অবস্থা দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও চিঠি-পত্রাদিতে পরিচিত সকলকে সাবধান করতেন। পাড়ায় পাড়ায় নজরদারিতে যাওয়ার সময়েও প্রত্যেককে সঠিক উপায় অবলম্বনের পরামর্শ দিতেন।
প্লেগ ঠেকাতে ব্রিটিশ সরকার টিকাকরণের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু তীব্র ইংরেজ-বিদ্বেষ, গুজব, রোগ-ভীতি, পর্দাসীন সাধারণের অন্দরমহলে বাইরের লোকের প্রবেশ ইত্যাদি নানা কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠেছিল। এমনকি, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করা হলে মঠের সন্ন্যাসীদের উপরে আক্রমণও হয়। স্বামী বিবেকানন্দ যে দিন দার্জিলিং থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে কলকাতায় আসেন, রাস্তার মানুষ তাঁর প্রতিও মারমুখী হয়ে ওঠে। তাদের সন্দেহ হয়, স্বামীজির ব্যাগে নাকি প্লেগের টিকা আছে। অবশেষে হাত জোড় করে স্বামীজিকে বলতে হয় যে, তিনি ফকির মানুষ, বিদেশ থেকে ফিরছেন।
কলকাতার নাগরিকদের সচেতন করতে রবীন্দ্রনাথও উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির প্রায় সকল সদস্যই তাতে শামিল হন। ‘Calcutta Notes’ এ নিবেদিতা লিখেছেন, “A few great Hindu families, notably the Tagores, stood firm, in the hope of allaying the agitation.” ঠাকুরবাড়ি যখন প্লেগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, সে সময়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়-দশ বছরের মেয়ে প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাধ্য হয়ে তাঁরা চৌরঙ্গির একটা বাড়িতে পালিয়ে যান। সেখানেই তিনি বিখ্যাত ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটি আঁকেন। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।”
শুধু প্লেগ নয় কলেরা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারীতেও রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা নেন। ১৯১৫ সালে বাংলায় কলেরা মারাত্মক আকার নেয়। ঠাকুরবাড়িতেও মৃত্যু হানা দেয়। রবীন্দ্রপুত্র শমীন্দ্রনাথ কলেরায় মারা যায়। কবির লেখনী আরও শক্ত হয়ে ওঠে। ‘ওলাউঠার বিস্তার’ নামক প্রবন্ধে তিনি বিভিন্ন দেশে এ রোগের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে হরিমোহিনীর স্বামী ও পুত্রের মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে নিজের দুঃখের কথাই যেন ব্যক্ত করলেন তিনি—“যে দুঃখ কল্পনা করিলেও অসহ্য বোধ হয় তাহাও যে মানুষের সয় ইহাই জানাইবার জন্য ঈশ্বর আমাকে বাঁচাইয়া রাখিলেন।” তাঁর ‘দুর্বুদ্ধি’, ‘দিদি’ ছোটগল্পেও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কথা আছে।
এর কয়েক বছর পরে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর আকার নেয়, রবীন্দ্রনাথ আগে থেকেই সতর্ক হয়েছিলেন। এবারে তিনি একেবারে কবিরাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শান্তিনিকেতনে এই ফ্লু যাতে না ছড়াতে পারে, তার জন্য তিনি ‘পঞ্চতিক্ত’ পাচন খাইয়েছিলেন প্রত্যেককে। বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে (১ জানুয়ারি, ১৯০০) এই পাচনের কথা জানিয়ে তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন, “বৌমার খুব কঠিন রকম নিমুনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই করে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্ছে।...কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আসছি।...আমার এখানে প্রায় দুশো লোক, অথচ হাসপাতাল প্রায়ই শূন্য পড়ে আছে—এমন কখনও হয় না—তাই মনে ভাবচি এটা নিশ্চয়ই পাঁচনের গুণে হয়েছে।” এই পাচন ছিল নিম, গুলঞ্চ, বাসক, পলতা ও কন্টিকারির মিশ্রণ।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় নৈরাশ্য, নিরানন্দ, অনশন ও মহামারী প্রাচীন ভারতের ‘মন্দিরভিত্তি’-কে ভেঙে ফেলছে ক্রমশ। তবে এসব ‘আকস্মিক’ নয়। ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষ্য মাত্র, তাহারা বাহ্যলক্ষ্মণমাত্র—মূল ব্যধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।”
স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টি, টিকাদান কর্মসূচি এবং মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে আরও উন্নতি এসবই এজন্য গুরুত্বপূর্ণ। আগের সব মহামারীর মতো এই করোনা মহামারী অবশ্যই এক মহান সৃষ্টিশীল, গতিশীল সময়ের জন্ম দেবে। অপেক্ষায় থাকুন। যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। ভরসা রাখুন।
(www.theoffnews.com - corona epidemic Bengal)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours