সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:
চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালি? না কি গরম চা আর বাসী রুটি খাওয়া বাঙালি? কিম্বা পর্যাপ্ত দুধ চিনি দেওয়া এককাপ ঘন চায়ের সাথে বাসী লুচি খাওয়া বাঙালি? যাই বলি না কেন তারা কি করে ভুলে ছিল "আন্তর্জাতিক চা দিবস"এর কথা? কি হল? মনে প্রশ্ন এল তো "প্রেম দিবস" বা "মাতৃদিবস"এর মত চা দিবসও আছে? আজ্ঞে হ্যাঁ।
চা দিবসও আছে। আর গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক চা দিবস। বাঙালিকে চা নিয়ে যত শিরোপাই দেওয়া হোক না কেন বাঙালির কাছে ৩৬৫×২৪×৭ দিনই চা দিবস। তাই আলাদা করে তারা আর মনে রাখতে চায় না।
ঘুম থেকে ওঠা থেকে পারলে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পযর্ন্ত বাঙালি ছাপোষারা চা খেয়ে থাকেন যতই পানীয়টার বদনাম থাকুক নিদ্রাহরণী হিসেবে। বাঙালি ভাবে হোক না নিদ্রাহরণী, তন্দ্রাহরণী তো নয়। ছোপোষা আম বাঙালি ধোঁয়া ওঠা চায়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। আসলে নেশা বলতে যে সর্বনাশা ধারণা মনে আসে চায়ের নেশা কিন্তু তা নয়। বরং উল্টো। আর সে জন্য চা এত জনপ্রিয়। আর এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ইউনাইটেড নেশনসের খাদ্য ও কৃষি বিভাগ প্রতিবছর ২১মে দিনটিকে "আন্তর্জাতিক চা দিবস" হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়।
সকাল বেলায় উঠে বাঙালি তার মেদবহুল শরীরে স্তরীভূত চর্বি ঝরাতে যতই ঈষদুষ্ণ জল লেবুর রস সহযোগে পান করে প্রাতঃভ্রমণে যান, বাড়ি ফিরে এক কাপ সরেসগরম পানীয়টি না খেলে তাদের দিনটাই মাটি।
অনেকের তো বাড়ি পযর্ন্ত পৌঁছনোরও তর সয় না। তখন পাড়ার হাবুর দোকান কিম্বা রতনের সস্তার কাঁচের গেলাসে একটু চুমুক দিতেই হয়। তবে এ ক্ষেত্রে চা পানের ব্যাপারে একটা রীতি আছে। অবশ্য হারুর দোকানে আট থেকে আশি সবাই তার খদ্দের। কেরাণী থেকে কোম্পানির এমডি সবাই ঐ গেলাসের গরম পানীয়ের খদ্দের। তাই কেউ চা পানের রীতিনীতির ধারধারে না। অভিজাত কায়দায় শৌখিন পেয়ালায় নিঃশব্দে চা পান যারা করেন তারা আর যাই হোক চা খোর নয়।
হাবুর দোকানে ভাঁড়ে বা গেলাসে আওয়াজ করে একটা লম্বা টান দিয়ে চা পান করার মধ্যে যে আমেজ বা সুখ পাওয়া যায় সেটাই সংস্কৃতি প্রবণ দিলখোলা বাঙালির সারাদিন ভাল থাকার পাসওয়ার্ড।
এক কাপ চা মানুষকে আরও বেশি কাছাকাছি আনে। অফিসের বড়বাবু থেকে কেরাণি, শিক্ষক কি ছাত্র, লেখক আর তার পাঠক অথবা প্রেমিক প্রেমিকা সবারই অবস্থান কিন্তু কাপের এধার বা ওধারে। ঠিকভাবে বলতে গেলে আড্ডা প্রিয় মজলিশি বাঙালির রোজকার লম্বা দৌড়ের এনার্জি লুকিয়ে থাকে এই চায়ের গেলাসে।
তাই কবে চা দিবস? আমজনতার মাথাব্যথা নেই তাতে। আর কেনইবা ২০১৯ সাল থেকে ২১ মে এই দিনটি চা দিবস পালিত হচ্ছে তার খবরও রাখে না। বাঙলার উত্তর দিগন্তে আছে অসংখ্য চা বাগান। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের অজান্তেই উপকার করে চলেছে এই চা খোর জনতারা তা সে বাঙালিই হোক বা তামিল।
ইউনাইটেড নেশনস চায় চায়ের ব্যবহার আরও বাড়ুক। এই পানীয়টি স্বাস্থ্যকরও বটে। নিয়মিত এবং পরিমিত চা পান ওষুধের কাজ করে। অনেক রোগের উপশমে সাহায্য করে। চা শিল্পও কিন্তু বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। দারিদ্র্য দূরীকরণে এই দুটি কুঁড়ি একটি পাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
স্বাস্থ্যের কারণে বাঙালি দুধ চিনি সহযোগে চা পান থেকে বিরত থাকলেও কালো চা, লেবু চা বা সবুজ চা সবেতেই অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। আজ করোনা কালে লকডাউন অবস্থায় হারুর বা রতনের দোকানে স্টোভের ধোঁয়ার গন্ধ আসে না। চায়ের গেলাসে চামচের টিংটিং আওয়াজও আসে না। চায়ের দোকানে প্রাতঃকালীন কি সান্ধ্যকালীন জমায়েত যতই বন্ধ থাক না কেন সোস্যাল মিডিয়া তো বন্ধ নেই! নিজের নিজের পছন্দের মানুষজনের সাথে পছন্দের সময় নিয়ে বসে পড়ছে জুমে বা গুগুল মিটে। হাতে কিন্তু থাকে এক কাপ চা। মাঝে মাঝেই শোনা যায় হাঁক "এক কাপ হবে নাকি?" আন্তর্জাতিক চা দিবস পৃথিবীময় ব্যাপ্তি পাক। সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি চা শ্রমিকদের। আর চা খোর বলে বাঙালির এই অপমান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনও একদিন শিরোপা হয়েও উঠতে পারে! আপনারা কি বলেন?
(www.theoffnews.com - tea day)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours