তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এই রকম আর একটা মানুষ পৃথিবীতে নেই। খাদ্য তাঁর কাছে দর্শন। খাদ্য সাহিত্য বলে যদি কিছু থাকে সেটা উনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যের ভান্ডার ছিলেন। তবে তিনি যে ভীষণ পরিমাণে ভোজনরসিক ছিলেন, তা কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না। খাদ্যতালিকায় স্বাভাবিক খাবারের সাথে সাথে অনেক অস্বাভাবিক খাবারও পছন্দের তালিকায় ছিল। তার যখন যা যা খেতে ইচ্ছা করত তার স্ত্রী মৃণালিনী তাকে সেটাই বানিয়ে দিতেন। মৃণালিনীর হাতের তৈরি ‘এলোঝেলো’ খেয়ে কবিগুরু এমন উদ্ভট নাম শুনে নাক সিঁটকে এর নাম দিলেন ‘পরিবন্ধ’। তার কবিতাতেও রয়েছে খাদ্যের নানান রকম বর্ণনা। তিনি লিখেছিলেন “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে, হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ, পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।” এত সুন্দর খাবারের বর্ণনা ভোজন রসিক না হলে বোধহয় দিতে পারতেন না। কবিগুরুর পছন্দের তালিকায় ছিল চা। তিনি জাপানি চা এতটাই পছন্দ করতেন যে, জাপানে গেলে তার জন্য একদিন চায়ের সেরিমনি করা হতো। গীতাঞ্জলি লেখার জন্য কবি নোবেল পুরস্কার পান। তার আগের বছর ইংল্যান্ডে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন “ইন্ডিয়ান সোসাইটি” লন্ডন। সেদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল গ্রীন ভেজিটেবল সুপ, ক্রিম অফ টমেটো সুপ, রোস্ট চিকেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, গ্রীন স্যালাড, আইসক্রিম প্রভৃতি।

কবিগুরু ফল খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন। তার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় থাকত পাকা পেপে, কলা, বাতাবি লেবু আর আম। তিনি আম কেটে কেটে দিলে খেতে পছন্দ করতেন না। চুষে খেতে তিনি বেশি ভালোবাসতেন। একবার কবি মৃণালিনী দেবীকে মানকচুর জিলিপি বানাতে বললেন। শুনে মৃণালিনী দেবী তো হাসি থামে না। তবে চেষ্টা করে তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তার পছন্দের তালিকায় ছিল কাঁঠালের দই, মাছের কালিয়া অথচ মাছ ছাড়া, ফুলকপির তৈরি সন্দেশ, দই মালপোয়া যখন যা যা ইচ্ছা করত সব বানিয়ে দিতেন মৃণালিনী দেবী। তথ্য যা বলছে তা হল, কবিগুরু যে কোনও খাবারে ঝাল খুব অপছন্দ করতেন।

তবে কবি পছন্দের দেশি খাবারের মধ্যে ছিল কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। তিনি কাবাব খেতেও পছন্দ করতেন। হিন্দুস্থানী তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব, আনারস দিয়ে মাংস ছাড়াও তিনি ভালবাসতেন ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলের রান্না হওয়া পাঁঠার মাংস। শুধু পাকা আম নয়, তার পছন্দের তালিকায় ছিল কাঁচা আমও। আচার খেতে বেশ ভালবাসতেন। সকালটা শুরু হতো এক গ্লাস নিম পাতার রস দিয়ে। কবিগুরু ছিলেন অসম্ভব পানের ভক্ত। তার নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনীর কাছ থেকে খুব সুন্দর একটি পানদানি উপহার পান।

কবিরাজি কাটলেট নাম হওয়ার পিছনে রবীন্দ্রনাথের নাম বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেউ কেউ জুড়ে দিয়েছেন। ‘কবিরাজি’ কথাটা সাধারণত ইংরেজি কথা ‘কভারেজ’ থেকে এসেছে, আবার কেউ কেউ মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বসন্ত কেবিনে গিয়েছিলেন কাটলেট খেতে, এই কাটলেটের উপরে থাকা পাউরুটির প্রলেপ কবির একেবারে পছন্দ ছিল না, তাই কবির মনের মতন করে ডিমের গোলায় ডুবিয়ে বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল কবিকে এক কাটলেট। সেটা খেয়ে কবির বেশ পছন্দ হয়েছিল। সেই থেকে এই কাটলেটের নাম দেওয়া হয় ‘কবিরাজি কাটলেট’।

উনি অনেক খাবারের নাম দিয়েছেন। খেতে খেতেও সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করেই বাজিমাত করেছিলেন। ছোটবেলার এই কবিতাটি এখনও অমর। কেননা এ যেন চমৎকার গন্ধ সমেত একদম থ্রিডি চিত্রকল্পই, "আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে— হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ, পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।" তার পেটে ও পিঠে, ইঁদুরের ভোজ, গল্পের মিঠাইয়ের ঝুড়ি, পয়লা নম্বর গল্পের মাছের কচুরি আর আমড়ার চাটনি (যেটি খাইয়ে অনিলা চরম শোধ তুলেছিল), বিনি পয়সার ভোজ এর -

"কী বললি? বাবু হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে গেছেন? বলিস কী রে! আজ তবে তো রীতিমত খানা! খিদেটিও দিব্যি জমে এসেছে। মটন-চপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ করে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতো চক্‌চকে করে রেখে দেব। একটা মুর্গির কারি অবিশ্যি থাকবে— কিন্তু, কতক্ষণই বা থাকবে! আর দু-রকমের দুটো পুডিং যদি দেয় তা হলে চেঁচেপুঁচে চীনের বাসনগুলোকে একেবারে কাচের আয়না বানিয়ে দেব। যদি মনে ক'রে ডজন-দুত্তিন অয়্‌স্টার প্যাটি আনে তা হলে ভোজনটি বেশ পরিপাটি রকমের হয়। আজ সকাল থেকে ডান চোখ নাচছে, বোধ হয় অয়্‌স্টার প্যাটি আসবে।"

এগুলো ভোলা যায়? কাব্যি করেছেন আমসত্ত্ব-দুধ আর সন্দেশ নিয়ে, আর খেতেন নিমপাতার শরবত। তবে শুধু নিমপাতার শরবতই নয় কিন্তু।

১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বেরোন। তারপর বাকি জীবন ধরে বহু দেশ ঘুরেছেন। আর নানা দেশের ভালো লাগা খাবারগুলো সময়-সুযোগমতো ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলে চালু করে দিতেন! ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশের একরকম ফ্রুট স্যালাড ঠাকুরবাড়িতে চালু করেছিলেন তিনি। বনফুলের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথও সে কথা লিখেছেন। ইন্দিরা দেবীও মোটামুটি কাছাকাছি কথাই লিখেছেন। আরও অন্যরাও তেমনই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তবে তাঁর খাদ্য দর্শনটি ধরতে পেরেছিলেন সম্ভবত রথীন্দ্রনাথই। পুত্র বলে তিনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বাবা রবীন্দ্রনাথকে। পছন্দ–অপছন্দ যেমন জানতেন, তেমনি জানতেন খাবার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব চিন্তার জগৎটা কি।

রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। এর সভ্যরা প্রতি মাসে নিজেদের বাড়িতে সভার আয়োজন করতেন পালাক্রমে। সেখানে গান হতো, কবিতা হতো, অভিনয় হতো। প্রচুর আড্ডা হতো এবং অবশ্যই খাওয়া দাওয়া হতো। বেশ কয়েকবারই রবীন্দ্রনাথের পালা পড়েছিল নিজের বাড়িতে আড্ডা বসানোর। তিনি নিজের সাধ্য এবং রুচিমতো সেটা পালনও করেছিলেন। সম্ভবত যেবার প্রথম রবীন্দ্রনাথের পালা পড়েছিল খামখেয়ালি সভা আয়োজনের, সে সময়ের কথা বলেছেন রথীন্দ্রনাথ।

রথীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাবার যেবার নিমন্ত্রণ করার পালা পড়ল, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মাকে ফরমাশ দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে হবে। মামুলি কিছুই থাকবে না, প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। ফরমাশ করেই নিশ্চিন্ত হলেন না, নতুন ধরনের রান্না কী করে রাঁধতে হবে তাও বলে দিতে লাগলেন।’ এই আয়োজনের সূত্রেই রথীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার খাদ্যদর্শন জানিয়ে দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘বাবা মনে করতেন খাওয়াটা উপলক্ষ মাত্র, রান্না ভালো হলেই হল না—খাবার পাত্র, পরিবেশনের প্রণালী, ঘর সাজানো, সবই সুন্দর হওয়া চাই। যেখানে খাওয়ানো হবে তার পরিবেশে শিল্পীর হাতের পরিচয় থাকা চাই। মা রান্নার কথা ভাবতে লাগলেন, অন্যরা সাজানোর দিকে মন দিলেন।’

এ আয়োজনের জন্য জয়পুরের শ্বেতপাথরের বাসন আনানো হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল মাটিতে বসে খাওয়া হবে কিন্তু খাবার রাখার জন্য প্রত্যেকের সামনে শ্বেতপাথরের একটি করে জলচৌকি থাকবে। অনেকগুলো পাথরের জলচৌকি তৈরি করা হয়েছিল। আর খাবারের জায়গা সাজানো হয়েছিল কেমন করে?

রথীন্দ্রনাথের জবানীতেই শোনা যাক, ‘জলচৌকি চতুষ্কোণভাবে সাজিয়ে মাঝখানে যে জায়গা রইল, তাতে বাংলাদেশের একটি গ্রামের বাড়ি বানানো হল। বাঁশবন, শ্যাওলাপড়া ডোবা, খড়ের ঘর কিছুই বাদ গেল না, ছবির মত সম্পূর্ণ একটি গ্রাম। কৃষ্ণনগর থেকে কারিগর আনিয়ে খড়ের ঘর, ছোট ছোট মানুষ, গোরু, ছাগল বানিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। এই সুন্দর পরিবেশে নৈশভোজন যে উপভোগ্য হয়েছিল, বলা বাহুল্য।’

প্রায় কাছাকাছি একটি বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল। সেই যে বেশি করে লঙ্কা দিয়ে ঘুগনি খাওয়ার সময় যেদিন, সেদিন মূলত রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বনফুলের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উত্তরায়ণের একটি বারান্দাকে পর্দা দিয়ে ঘিরে খাবারের আয়োজন। অদ্ভুত সে আয়োজনের বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল। লিখেছেন, ‘আমাদের পাঁচজনের জন্য পাঁচটি টেবিল। তাতে থরে থরে নানারকম খাবার সাজানো।… টেবিলগুলো অদ্ভুত। প্রত্যেক টেবিলে তিনটি কি চারটি থাক (ঠিক মনে নেই), তার প্রত্যেক থাকেই খাদ্য এবং পানীয়। উপরের থাকের খাবার খাওয়া হয়ে গেলে হাত দিয়ে একটু ঠেললেই সেটা সরে যাবে, বেরিয়ে পড়বে খাবারসুদ্ধ দ্বিতীয় থালাটা।’

বনফুল জানাচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকের পেছনে এমনকি তাঁর এক দেড় বছরের ছেলের বসার আসনের পেছনেও দাঁড়িয়েছিলেন একজন করে তত্ত্বাবধায়ক। খাবার নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কিন্তু খাবার নিয়ে এই যে আয়োজন, সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের খাদ্য দর্শন। কোথাও পাওয়া যায় না, রবীন্দ্রনাথ খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন। খাবার খাওয়ানোয় আভিজাত্য ছিল, খাদ্য পরিবেশনে চমৎকারিত্ব ছিল কিন্তু ‘অনেক খাওয়ালাম’ ধরনের বড়াই পাওয়া যায় না। বরং বনফুলই শুধু নন, আরও অনেকেই লিখেছেন, খাওয়াতে পারলে তিনি তৃপ্তি পেতেন।

মদ্যপান কম বেশি সকলেই করেন। এই মদ্যপান তো সেই আদিম কাল থেকেই চলে আসছে। পৃথিবী যত দিন থাকবে, তত দিন এই পানাচার থাকবেই! 

এই পানাচার থেকে বিখ্যাত শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক কেউই  বাদ যায়নি। আসুন পাঠক, আপনাদের একটি মদ্যপানের গল্প শোনাই সংক্ষেপে।

রবীন্দ্রনাথ কি মদ্যপান করতেন? আপনি কি জানেন? বা শুনেছেন কখনও? হয়তো কেউ শুনেছেন, কেউ চমকে উঠবেন এই খবর শুনে!

প্রাবন্ধিক সমীর সেনগুপ্ত অনেক বই ঘেঁটে, অনেক হিসেবপত্র দেখে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেচেন। যে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ রীতিমত মদ খেতেন। শুধু তাই নয়, বড়দের সঙ্গে বসে মদ না খাওয়ার মধ্যবিত্ত ন্যাকামো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। সবার সাথেই তিনি বসে মদ্যপান করতেন। এমনকি ছোটদের সঙ্গেও খেতেন। মদ্যপানের প্রতি নাকি তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও ছিল। তাই অন্য কোনও মদ্যপকে তিনি কখনও মানা করেননি মদ খেতে! সাহিত্যিক নির্মলকুমারী মহলানবীশ তাঁর বিলেত বাসের গল্পে জানিয়েছিলেন, এক ভোজসভায় তিনি জেদের বশে পর পর সাত গেলাস মদ খাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে কার্যত জোর করে হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ঘর অবধি পৌঁছে দেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর হাত ছাড়তেও রাজি হননি। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যের প্রিয় রানি চন্দও বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে মদ্যপানের অভ্যাসটি শিখিয়েছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন মদ খেতেন, তার ওপর আর কথা চলতে পারে? রানি চন্দ্রও বলতে পারেননি।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এই মদে আসক্ত হয়েছিলেন ঠাকুর বাড়ির সংস্কৃতি থেকেই। কারণ মদ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল ঠাকুরবাড়িতে বহুদিন আগে থেকেই।

(www.theoffnews.com - food wine Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours