দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
ভূতের রাজা তো গপ্পো, আসলতো গুপীকে গাধার পিঠে চাপিয়ে দেশ থেকে বের করা। দেখো রে নয়ন মেলে/ কোভিডে কত গেল অবহেলে...। তার আগেই গুপীকে গাধার পিঠে চাপিয়ে নিজের জায়গা থেকে বের করার চেষ্টা হয়নি তা নয়, বার কয়েক হয়েছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য ভূতের রাজা বেসুরো গুপীর গলায় সপ্ত সুরের বাহারে না সাজালেও, ইচ্ছে পূরণে চেষ্টার কোন খামতি নেই, তাঁর সাঙ্গ পাঙ্গদের! তাই ময়ূর নিয়ে তাঁর টুকটুকি খেলাতে যেমন কারো টিপ্পনির খামতি নেই, তেমনি বারানসীর চিকিৎসক কুলের সাথে ভার্চুয়াল বৈঠকে অশ্রুপাতে সায় নেই। তাই মনে হয় এসব নেহাতই নকল কান্না। --"নিউইয়র্ক টাইমসে প্রথম পেজে সেই "ছবি" ফেসবুকে পোস্টালাম। একটু দেখিস। পারলে লাইক দিস"।-- এসব চলতে থাকবেই। শিকার ধরার সময় কুমিরের ওপরের চোয়াল বেশখানিকটা ওপরে ওঠে। চোয়াল ওপরে উঠলে অশ্রুগ্রন্থির পেশিতে চাপ পড়ে। এ চাপের কারণেই নাকি অশ্রুগ্রন্থি থেকে জল বেরিয়ে চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু হয়। এই শিকারের কাহিনী তাড়িয়ে উপভোগ করার মতো।
এ সব চলতে থাকুক! তিনি বড় মাপের অভিনেতা! টিপ্পনিতে ঐতিহাসিক অশ্রুপাতের প্রসঙ্গে কেউ বলেছেন -- হাউস ফুল! কেউ হিসেব জাবদায় জের টেনেছেন সত্যজিৎ রায়ের নাম। এই ট্যাবু ভাঙতে গেলে ভক্তের তকমা জুটবে। থোড়াই কেয়ার করে বলি, অভিনেতা তপেন চট্টোপাধ্যায়ের এক সাক্ষাৎকারের কথা। পিতৃদেবকে ক্যাওড়াতলায় দাহ করতে যাওয়ার সময় গুপীর চোখের জল দেখে এক শিশু তাঁকে বলে ওঠে, কেন তোমার কাছে ম্যাজিক আছে তো! তুমি কাঁদছো কেন? দুঃখের সময় তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে! এখানে হাসি নয়, সেই "ম্যাজিক" দরকার ছিল! তাহলে অনেকেই খুশি হতেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রক নিয়ে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু এখানে অন্য পাঠ। দিল্লিতে বা কোনও রাজ্যে মহামারী নিয়ন্ত্রণ হলে কৃতিত্ব রাজ্য সরকারের। কিন্তু কোথাও তা ব্যর্থ হলে পুরো দোষটা কার সেটি জানতে কারও বাকি নেই!
কাগজের যথাযথ বৈশিষ্ট্য হলো কেন্দ্রে আসীন সরকারের ভুল ত্রুটি তুলে ধরা। মানুষ সেটাই চান। বিদেশী সংবাদ পত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বা দ্য গর্ডিয়ান সেটাই করে থাকে। সে ভিয়েতনাম ওয়ার হোক বা যাই হোক। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে এই আক্রমণে সামিল ছিল প্রো নিক্সন ট্রিবিউন ম্যাগাজিন। যার পরিণতি ছিল স্টেপডাউন অফ নিক্সন। চুয়াত্তর থাক। এখন সাড়ে চুয়াত্তর নিয়ে পড়ে আছি আমরা। সকলের প্রেম পত্রে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সেই "দিব্যি" কাটা অনেক গোপন কাহিনী। প্রেম পত্রের উপর ৭৪৷৷৹ চিহ্ন। তবুও পড়ে আছে মোদী নিয়ে। কেন? আমাদের চোখের সামনে পেরুর রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল মেরিনো আছেন। লেবানন থেকে স্পেন, চিলি, বলিভিয়া, ইকুয়েডর ও ভেনেজুয়েলা আছে। প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ইস্যু আছে গণ বিদ্রোহের কারণের পিছনে। এখানে এত বলা সম্ভব নয়। তবে কিস্যার কিস্যা সেই স্টেপ ডাউন। চলছে পিটিশন- হ্যাশট্যাগ মোদী মাস্ট রিজাইন। সাম্প্রতিক কালে টুলকিট ফাঁসে তার মুখোস অনেকটাই সামনে এসেছে। ভেনেজুয়েলার আন্দোলন থেমে যাওয়ার একটাই কারণ-- কোভিড। আমাদের দেশেও বোফর্স কামান ক্যাম্পেনে উননব্বইয়ে রাজীব গান্ধীর পরাজয়। পরে তাঁর মৃত্যুর পর জ্যোতি বসু নিজেই স্বীকার করেন, অভিযোগ ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রচারের কারণে। এরকম অভিযোগ উঠছে না মোদীর বিরুদ্ধে। মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সংবিধান ভঙ্গের। যার সূত্রপাত রামজন্মভূমি মসজিদ ইস্যু, কাশ্মীরে তিনশো সত্তর ধারা বিলোপ। তার আইনী ব্যাখ্যা যায় থাক মুসলিম সম্প্রদায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিল। তিন তালাক ইস্যুতে যে মহিলাদের আশীর্বাদ মোদী মুখ পেয়েছিল, এনআরসি ও সিএএ ইস্যুতে তার কানাকড়ি আর পাননি পরবর্তীকালে। এখানেও ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার জনিত কারণে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে গান্ধীজীর অঙ্গীকার অতি গান্ধীবাদী অনুসারী মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের মোদী অবিশ্বাস এতটাই চরমে! তাঁদের দাবী ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে হলে ওই দুই দেশ থেকে আগত হিন্দু মুসলিম সকলকেই দিতে হবে। ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে কারও প্রতি অবিচার করা হবে না। কিন্তু তা কার্যকর করতে গেলে আইনের তাৎপর্য থাকে না। কারণ বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত সংখ্যালঘু। এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুর ভারতে অনুপ্রবেশের সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া শ্রম অসাধ্য নয়। অন্তত: বিরোধী নেত্রী হিসেবে ষোলো বছর আগে লোকসভায় সেটা প্রমাণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, এটাও ঠিক মূল ইস্যু থেকে সরে গিয়ে কেন্দ্রের তরফে মুসলিমদের আশ্বস্ত না করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেব এমন হটকারি বার্তার কারণেই, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল রাম গড়তে বাঁদর গড়ে ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতিভাত হতে সময় নেইনি। প্রশ্ন উঠেছে রোহিঙ্গা প্রীতির। সেক্ষেত্রে শুধু মানবিকতা নয়, বিশ্বের যে কোন জায়গায় মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ বা ব্রাদারহুড প্রশ্নাতীত। সেখানে বিরূপ ভাষা, পোশাক খাদ্যাভাস কোনও বাধা নয়। সেই কারণেই সাতান্নটি দেশে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই সেই অস্মিতার সাথে তারা সব সময় আপোষহীন। সেই কারণেই নাগরিক পঞ্জীকরণ থেকে পঞ্জাবের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস মনোপলির বিরুদ্ধে কৃষি বিল যে পদক্ষেপ নিক তা অন্যের সন্দেহের বাইরে নয়। মুসলিমদের মতো হিন্দুদের পুরো আস্থা পাননি মোদী পশ্চিমবাংলায়। কারণ, সেই আসামের 'অসাম' ভুলে ভরা নাগরিক পঞ্জি তালিকা। যদিও আসামে মোদী সেই আস্থা পুনরুজ্জীবিত করেছেন।
কিন্তু, মোদী কুইট মুভমেন্ট প্রয়োজন কারণ কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মোদী সরকার যা এ যাবৎ করেছে তার পূর্বাবস্থা বহাল করা হবে। স্বভাবতই চব্বিশে মোদী সরকারের অভিমন্যু বধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভিতরে বাইরে বিদ্ধ হয়ে সেন্ট হেলেনায় তাঁর অন্তিম দিন কাটবে কিনা সময় বলবে। তবে মোদী কুইট মুভমেন্ট চলবে। করোনার কারণে সেই গতি কিছুটা শ্লথ হলেও, আবার শুরু হবে। লক্ষ্য স্থির আছে। শাহিনবাগ থেকে নয়ডা! জেএনইউ থেকে যাদবপুর! তাই সরকারের সাথে নন কো অপারেশন। নো আলোচনা স্ট্যাণ্ড। যদি সব কিছু অচল করে ভেনেজুয়েলার মত অবস্থা করা যায়। একইভাবে সেই লক্ষ্য তৃতীয়, চতুর্থ... উপস্থিতি। বৈদেশিক রাষ্ট্রের সরকারি হস্তক্ষেপ। এখন নতুন ইস্যু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে। এই দাবি অবশ্য এককভাবে বাংলাদেশের। ভারত তা অস্বীকার করেছে। কিন্তু এটাই মোক্ষম অস্ত্র অস্ত্র মোদী বিরোধীতার। আগেই ইউএন ভারতের জিডিপি নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে বলেছে, একুশে দুই শতাংশ বৃদ্ধি হবে। কোভিডের জন্য বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়বে সেটাও আগে বলেছে ইউএন। বলেছে, তার সাথে সামঞ্জস্যের নিরিখে বাইশে সাড়ে সাত থেকে দশের বেশিতে জিডিপি অবস্থানে দাঁড়াবে ভারত। অক্সফোর্ড অবশ্য বলেছে, কোভিডের জন্য একুশে এগারো দশমিক আট থেকে কমে দশ দশমিক দুইয়ে দাঁড়াবে ভারত। অর্থাৎ দুই ক্ষেত্রে একই ভবিষ্যবাণী। কিন্তু তা নিয়ে আরেক ঢেউ শুরু ট্যুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে। ভারত তো উন্নয়ন শীল দেশ। উন্নত দেশগুলোর জিডিপি বাড়ছে ও কমছে।
এ ব্যাপারে এগিয়ে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নিয়ে কিছু বলার নেই। তাঁরা জানেন, কখন কোনও ঘটনা কোন খাতে ট্রেণ্ডিং করাতে হয়। তাঁদের গুরুত্ব না দিলে যে কোনও সরকারের বিপদ। সেদিক দিয়ে বিচার করলে, বেশিরভাগ বামপন্থী জন্মগত ভাবে বুদ্ধিজীবী। তাদের একাংশ যাঁরা বাংলাদেশ থেকে প্রাণ নিয়ে কোনও রকমে এক কাপড়ে ভারতে আসতে পেরেছেন তাঁরাই বাংলাদেশে গিয়ে চাঁদপুরের ইলিশ পদ খেয়ে ঢেকুর তুলে বলেন, হেঁ হেঁ সব ঠিক আছে। ইণ্ডিয়ায় কত নির্যাতন ক্যাবা করে স-জানবি! সব মুদি! মুদি! দাঙ্গা বাজ!
এই বুদ্ধিজীবীরা ভেনেজুয়েলার আর্থসামাজিক সঙ্কট, ইকুয়েডরের সাথে আইএমএফের দশক পুরাতন ওল্ড সাবসিডি নিয়ে লড়াই বুঝতে পারলেও, প্রলয় এলে নির্ঘাৎ চোখ বুজে, পাক্ষিক সাম্প্রদায়িকতার খাদ্যপ্রাণে আজও তাঁরা ফুরফুরে দক্ষিণা হাওয়া পান! তাঁরা দ্বিধান্বিত-- 'কালো সাম্প্রদায়িকতা ও সাদা সাম্প্রদায়িকতা'র শব্দবন্ধে। সেটি ভাবের ঘোরে কিছুতেই বোঝাতে চান না। প্রায়শই গুন গুন করেন---শোনো গো দখিনো হাওয়া, প্রেম করেছি আমি... লেগেছে চোখেতে নেশা, দিক ভুলেছি আমি...
(www.theoffnews.com - crocodile crying Modi)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours