সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:

(ছবি সৌজন্যে: প্রতিবন্ধী সহায়ক কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টুইঙ্কেল স্টার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট'এর পালিত রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান।)

বর্তমানে আমরা এক কঠিন সময়ের ভেতর বাস করছি। চারিদিকে মৃত্যু কান্না হাহাকার। করোনা মহামরিতে আমরা সত্যিই বোধহয় শেষের পথে।  ভগ্ন হৃদয়ে হতাশা যখন ঘিরে ধরে, আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের তখন যে পথ দেখান। বিখ‍্যাতকবিতা দুঃসময় কবিতাটা মনে পড়ে-

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,

সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,

যদিও সঙ্গী নহি অনন্ত অম্বরে,

যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,

কবিকেও কিন্তু দুঃসময়ের ভেতর যেতে হয়েছে।  ব‍্যক্তিগত ভাবে কবি অনেক মৃত্যু শোক পেয়েছেন। প্রথম জীবনে তার প্রিয় বৌঠানের মৃত্যু তাঁকে গভীর ভাবে শোকাতুর করেছিল। এরপরে স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যু শোকও তাঁকে সইতে হয়েছে। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ, তাঁর অন্তরে শোক তাপ যাই থাকুক তার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে তার কবিতায়। শোক দুঃখ হতাশা সবকিছুতে তিনি অন‍্য জীবন দর্শনের খোঁজ পেয়েছেন। আর সেই জীবনের দর্শন তাঁকে করেছে  দার্শনিক। এই দর্শন সত্ত্বাই করেছে তাঁকে কবীন্দ্র। 

আমাদের নিভৃত মনের আলোকদ্যূতি। আমাদের নিভৃত প্রাণের দেবতা। 

আজ অতিমারির সময় 'পুরাতন ভৃত‍্য' কবিতায় কৃষ্ণকান্ত ওরফে কেষ্টার কথা মনে আসছে। 

কেষ্টা হল প্রভুর অতি বিশ্বস্ত ভৃত‍্য বা চাকর। বাড়ির ফাই ফরমাস খাটাই তার কাজ। বিনিময়ে দুইবেলা আহারাদি সহ য‍ৎসামান‍্য বেতন।

এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল কবিতাটার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল একজন ভৃত‍্য অর্থাৎ সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষ। এই নিচু শ্রেণীর মানুষকে সাহিত্যে ব‍্যবহার করা হত হাস‍্যরস আনার জন‍্য। কিম্বা নিচুশ্রেণীর মানুষের দারিদ্রতাকে পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন‍্য। 

কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ। এলিট সোসাইটির অগ্রগণ‍্য ব‍্যক্তি হয়েও পরিচারক কেষ্টাকেই নায়ক বানিয়েছেন। শুধু কেষ্টাই নয় রাইচরণকেও তিনি অন‍্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন।

কবিতার শুরুতে কেষ্টার চেহারার বর্ণনায় একটা শ্রেণিবিদ্বেষ ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু তার পরে ছত্রে ছত্রে রয়েছে কবির তার প্রতি এক মমতা। কবিতাতেই পাই এই কেষ্টার নির্বুদ্ধিতার জন‍্য কর্তা গিন্নির কলহর কথা। তাকে চোর অপবাদও দিয়েছেন। কবি লিখছেন "যত পায় বেত না পায় বেতন.." তথাপি কেষ্টার আনুগত্য অতুলনীয়। আর কবিও তাকে সঙ্গের সঙ্গীই ভেবেছেন। 

বৃন্দাবনে গিয়ে কবি যখন বসন্ত রোগে আক্রান্ত। বসন্ত তখন মারণ রোগ। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কবির পরিচিত চেনা সকল বন্ধু বর্গ রোগের ভয়ে কবিকে ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু ব‍্যাতিক্রম কেষ্টা। সেও কিন্তু অনায়াসে ছেড়ে চলে যেতে পারত, কিন্তু না। সে তা করেনি। ওর কবির প্রতি শুধু আনুগত্য নয় এক অদৃশ‍্য ভালবাসা দিনরাত এক করে সেবা করেছে। আর কবির তখন ওকেই পরম আত্মীয় মনে হয়েছে। কবি বলছেন ''ডাকি নিশিদিন সকরুণ, ক্ষীণ, ‘কেষ্ট, আয় রে কাছে,

এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেশে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।"

কেষ্ট মারণ রোগের তোয়াক্কাই করেনি। প্রভুর প্রতি তার শ্রদ্ধাই প্রকাশ পেয়েছে তার সেবার ভেতর। সবাই বলতেই পারেন যে পরিচারকদের কাছ থেকে এটাই স্বাভাবিক প্রাপ্তি। কিন্তু প্রভুর সম্পূর্ণরূপে তার ওপর আত্মসমর্পণ, তাকে পরমআত্মীয় ভাবা বা পরমবন্ধু ভাবা তা কি ব‍্যতিক্রমী নয়? ঐ যে বলেছি উনি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জীবনদর্শন আলাদা। মনিব আর ভৃত্যর চিরাচরিত সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে কেষ্ট সেবার পাশাপাশি কবিকে সুস্থ হয়ে ওঠার আশ্বাস দেয়। বলে "কর্তা, তোমার ভয় নাই শুন--যাবে দেশে ফিরে মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।" 

বর্তমানে অতিমারিতে যখন বাঁচার তাগিদে আমরা নিভৃতবাসে, আক্রান্ত ব‍্যক্তি থেকে আত্মীয় পরিজনও বহুদূরে, তখন বহু বছর আগে লেখা কবিতাটি এক অনন্য ব্যতিক্রম বৈকি!

সবশেষে কেষ্টা কিন্তু বসন্ত রোগের যোদ্ধা হিসেবে চলে যায় জীবনের সীমা ছাড়িয়ে অনেকদূরে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আজ কবির জন্মদিনে এই অতিমারীর সময়ে সকল কোভিক যোদ্ধাদের আমার শ্রদ্ধা। আশারাখি এই দুঃসময় কাটিয়ে আমরা উঠবই। 

কবির ভাষাতেই বলি "ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।"

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours