তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এখন মিডিয়াও করোনার কথা খুব একটা বলছে না। আপাতত ভুলতে হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ মরছে অক্সিজেনের অভাবে, বেডের অভাবে, আকাশ ছোঁয়া বিল দিতে পারছেন না বলেই অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। এটাকি দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য হচ্ছে? তাহলে কি মিডিয়া এর সাথে যুক্ত? মিডিয়া প্রতি মূহুর্তে চার হেভিওয়েট নেতার অবস্থার বর্ণনা করেছেন, চমৎকার অবস্থা।রাজনীতির ময়দানে সরকার ও মিডিয়া একই সাথে। আহা কি নির্লজ্জকর যৌথ সহবস্থান! এই মূহুর্তে মানুষের পাশে দাঁড়াবার এদের সময় নেই,।কারণ টিআরপি বাড়াতে হবে। কোনও ইতিবাচক সংবাদ নেই।

আমি নিচু তোলার সমস্ত দলের রাজনৈতিক কর্মীদের অনুরোধ করে বলছি এখন কোনও রাজনীতি করার সময় নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ান।কোন রাজনীতি ও মিডিয়ার ফাঁদে পা দেবেন না। আপনার বাবা ও মা যদি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হাসপাতালে বা বাড়িতে, আপনি কি তখন রাজনীতির কথা বলবেন? নাকি নিজের আপনজনকে বাঁচাবেন?

এই মূহুর্তে সাধারণ মানুষ কোনও রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, তারা বাঁচতে চায়, তাদের বাঁচান, পাশে দাঁড়ান, তাদের মনে শক্তি যোগান, এইটাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ। এখন রাজনীতি করার সময় নয়। ওইসব পরে হবে। save humanity, fight for humanity till last breath এটাই মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি কাম্য করে।

ইতিহাস কি বলছে দেখা যাক:

এই চলতি মহামারী আগেও আরও এক অতীত মহাহারীতে দেখেছিল বাংলা, পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা।

সাল ১৯১১। ভারতে জনসংখ্যা বাড়ছে না। তার একমাত্র কারণ জন্ম আর মৃত্যুর হার প্রায় সমান সমান। ম্যালেরিয়া, প্লেগ, কালাজ্বর, কলেরা, কুষ্ঠ – শেষ করে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। কোনও টিকা আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। সেই সময় কেমন ছিল কলকাতা? বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। লিখছেন, “পলাতক— প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটি লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া উক্ত ঠিকানায় আছি— কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।” সবাই এক এক করে এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন। কোথায় পালাচ্ছেন কেউ জানেন না, দিশেহারা পরিস্থিতি। বাঁচার কোনও পরিত্রাণ নেই। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ের ধরা পড়ল প্লেগ। আর বাঁচানো গেল না তাঁকেও।

মহামারী যে কী প্রবল আকার ধারণ করতে পারে, তা জানার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে। মানুষ যখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে থিতু হচ্ছে, তখনই মূলত গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় তৈরির ধারণা আরও পোক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন রোগ সংক্রামিত হতে শুরু করছে। মানবসভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, মহামারী তত থাবা বসিয়েছে। জনঘনত্ব বেড়েছে, মানুষের দেহে রোগও বেড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য যত আত্মিক হয়েছে, দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়তে থেকেছে। 

খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দের এথেন্স, ৫৪১ খ্রীস্টাব্দের জাস্টিনিয়ান প্লেগ, একাদশ শতাব্দীর কুষ্ঠ, ১৩৫০ সালের দ্য ব্ল্যাক ডেথ, ১৬৬৫ সালের দ্য গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডন, ১৮১৭ সালের প্রথম কলেরা, ১৮৫৫ সালের তৃতীয় প্লেগ, ১৮৮৯-এর রাশিয়ান ফ্লু, ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লু, ১৯৮১-র এইচআইভি/এইডস। এই প্রত্যেকটি রোগেই বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ মারা গিয়েছে। বাদ যায়নি তিলোত্তমা কলকাতাও।

অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের কলকাতা ছিল অস্বাস্থ্যকর। একের পর এক রোগ লেগেই থাকত। প্রতি বছর বর্ষায় আমাশা আর কলেরায় মারা যেতেন বহু সাহেব-সুবো। যারা বেঁচে থাকতেন তাঁরা ১৫ নভেম্বর জমা হতেন হারমোনিক ট্যাভার্নে (আজকের লালবাজার)। হুল্লোড়ে ভরে উঠত চারপাশ। কারণ সেই বছরের মতো তাঁরা বেঁচে গেছেন। 

মহামারী প্লেগের সময় স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। কলকাতায় প্রথম ধরা পড়ল প্লেগ। বিবেকানন্দ তখন দার্জিলিং-এ। প্লেগের কথা শুনেই ফিরে এলেন কলকাতায়। মহামারীকে যেমন ভাবেই হোক মোকাবিলা করতে হবে। স্বামীজি ঠিক করলেন, বেলুড় মঠে কেনা জমি বিক্রি করে, সেই টাকা প্লেগ রোগীদের জন্য দান করবেন। সেই প্রথমবার ত্রাণের কাজ করেছিল সদ্যগঠিত রামকৃষ্ণ মিশন। পাশাপাশি এগিয়ে এসেছিলেন ভগিনী নিবেদিতাও। সেই সময় বাংলার অবস্থা। বাদ যাননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। প্লেগের জন্য হাসপাতাল তৈরির কাজে নিযুক্ত হলেন। সেই সময়কার বীভৎসতার রূপ দেখে ঠিক থাকতে পারেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষ্য মাত্র, তাহারা বাহ্য লক্ষণমাত্র - মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।”

আজ যখন গোটা বিশ্ব ভীত, সন্ত্রস্ত, কলকাতায় প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, তখন এই ইতিহাস আমাদের জানিয়ে দেয় বীভৎসতার জল্লাদ কতটা অসুররূপী। রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকারি পদক্ষেপগুলো দেখার পর বারবার মনে হচ্ছে, প্রত্যেক মহামারীতে ঠিক এমন কাউকেই এগিয়ে আসতে হবে, যাঁদের উপর নির্ভর করছে একটা বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থা। এখন সচেতন ও সাবধানে থাকা আর দূর থেকে পাশে দাঁড়ানো ছাড়া কিছু করার নেই। 

প্লেগ প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কলকাতায় ফিরে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী ও অনুগামীদের নিয়ে স্বামীজি এক সভা করেন এবং বলেন, “দেখো, আমরা সকলে ভগবানের পবিত্র নাম নিয়ে এখানে মিলিত হয়েছি। মরণ ভয় তুচ্ছ করে এই সব প্লেগ রোগীদের সেবা আমাদের করতে হবে। এদের সেবা করতে, ওষুধ দিতে, চিকিৎসা করতে আমাদের নতুন মঠের জমিও যদি বিক্রি করে দিতে হয়, আমাদের যদি জীবন বিসর্জনও দিতে হয়, আমরা প্রস্তুত।”

১৮৯৮ থেকে ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ভারতে প্লেগ বিরাট আকার ধারণ করে। কলকাতায় এর প্রভাব মারাত্মক হয়ে ওঠে। মানুষজন দলে দলে ঘর ছাড়তে শুরু করে। সংক্রমণের চেয়েও বেশি ছিল ভয়। আতঙ্কের নানান খবরে কলকাতায় তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ১৮৯৮-এর ৪মে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশ পায় এমনই একটি প্রতিবেদন, “আতঙ্কের রূপ অদৃষ্টপূর্ব। আর কখনো কলকাতার বিপুল জনসংখ্যা এইরকম প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়নি। যেসব জেনানার মুখ ‘সূর্যও দেখেনি’, তাঁরাও শহরের পথের উপর দিয়ে দৌড়েছেন, বা ট্রামে-চড়ে পালাতে চেয়েছেন।...গত কয়েকদিনের বিপুল সংখ্যক মানুষের পলায়ন, সেইসঙ্গে দোকানপাট বন্ধ এবং পথে গাড়ি-ঘোড়ার অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে কলকাতা পরিত্যক্ত নগরীর চেহারা ধরেছিল।”

প্লেগের এই ভয়াবহতায় রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্য রচনাতেই থেমে থাকেননি, নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। ভগিনী নিবেদিতা তখন সদ্য এসেছেন কলকাতায়। বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের। মানব হিতৈষী দু’জন সে দিন মহামারি সামলাতে এক সঙ্গে পথে নেমেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।”

(www.theoffnews.com - Kolkata epidemic corona plague Rabindranath Tagore Sister Nivedita Swami Vivekananda)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours