তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

রবীন্দ্রনাথ যে গৌতম বুদ্ধ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বুদ্ধ লেখাটি আজও প্রাসঙ্গিক। আসুন দেখে নিই রবীন্দ্র মননে বুদ্ধের প্রভাব।

প্রখ্যাত রবীন্দ্র-জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনির জবানিতে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘জীবনে একবারমাত্র একটি মূর্তির সামনে আমার প্রণত হওয়ার প্রেরণা জেগেছিল, সেটা বুদ্ধগয়ায়, যখন আমি বুদ্ধমূর্তি দর্শন করি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তির তাৎপর্য এই যে, ব্যাপারটি তাঁর পরিবার ও সমাজের পক্ষে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ তাঁরা ব্রাহ্ম, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক, মুর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী। সেই রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ভগবান বুদ্ধ এমনভাবে জয় করেছিলেন যে তাঁর পবিত্র মুর্তির সামনে প্রণাম নিবেদনের জন্য তাঁর অন্তর প্রস্তুত হয়েছিল। কৃপালনি যে কোনও অতিশয়োক্তি করেননি তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত কবি নিজে রেখে গিয়েছেন—কবিতায়, গানে ও সাহিত্যে।

বুদ্ধদর্শন ও বুদ্ধচেতনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে সকল গান লিখেছেন, তার একটি আংশিক তালিকা প্রস্তুত করা যেতে পারে—

‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ গানটিও বুদ্ধগয়ায় বসে রচিত। বুদ্ধকে তিনি বিশেষভাবে ধারণ করেছেন বলেই দুইবার গেছেন বুদ্ধগয়ায়। প্রতিবারই তিনি বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন পরম আন্তরিকতায়। নিবেদন করেছেন হৃদয়ের অর্ঘ্য। আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের যত আত্মনিবেদনের গান, তার প্রায় সকল স্থানেই রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বাণী ও দর্শনের প্রকাশ। কখনো তা পরোক্ষ, কখনো তা প্রত্যক্ষ হয়ে ফুটে উঠেছে।

১. অন্তর মম বিকশিত কর

২. অন্ধজনে দেহ আলো মৃতজনে দেহ প্রাণ

৩. আজি মম মন চাহে জীবন বন্ধুরে

৪. আমার বিচার তুমি করো তবে আপন করে

৫. এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ

৬. চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি

৭. জীবন যখন শুকায়ে যায়

৮. ডাকছি শুনি জাগিনু প্রভু, আসিনু তব পাশে

৯. ডাকিছ কে তুমি তাপিত জনে

১০. তোমার রাগিণী জীবনকুঞ্জে

১১. তুমি বন্ধু তুমি নাথ, নিশীদিন তুমি আমার

১২. তোমারি সেবক করো হে

১৩. তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হইক

১৪. দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া

১৫. দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে

১৬. দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক

১৭. দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমায় নাহি ডরিব হে

১৮. নমি নমি চরণে, নমি কলুষহরণে

১৯. পদপ্রান্তে রাখ সেবকে

২০. পেয়েছি অভয়পদ আর ভয় কারে

২১. প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে

২২. বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

২৩. ভয় হতে তব অভয় মাঝে

২৪. সকল কলুষ তামস হর, জয় হোক তব জয়

২৫. সার্থক করো সাধন

২৬. শীতল তব পদছায়া

২৭. হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে

২৮. হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই

২৯. হে মহাজীবন, হে মহামরণ লইনু শরণ

৩০. হে মহাজীবন হে মহামরণ

বুদ্ধগয়াতে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ গান লেখেন। তিন দিনের অবস্থানকালে তিনি প্রায় ১০টি গান রচনা করেন। এর সবই প্রায় স্থান পায় ‘গীতালি’ কাব্যে। এগুলো পূজাপর্বের গান হিসেবেও পরিচিত। বুদ্ধের চরণতলে সন্ধ্যাতারার ফুল দিয়ে নৈবেদ্য সাজানোর কথা কবি কল্পনা করেছেন। বুদ্ধের চরণতল কবি চোখের জলে ধুয়ে দেওয়া আকুতি প্রকাশ করেছেন। এই একটি উক্তি থেকেই বোঝা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মহামতি বুদ্ধদেবের প্রতি কতটা অনুরক্ত ছিলেন!

গৌতম বুদ্ধের শাশ্বত কল্যাণের বাণী তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছে তাঁর গানে, কবিতাও ও নাটকের মাধ্যমে। বুদ্ধের স্মৃতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি বুদ্ধগয়ায় যেতেন। একাকী গেছেন। সপরিবারও গেছেন। সেখানেই বসে তিনি ধ্যান করেছেন। সেখানে বসে তিনি গানও রচনা করেছেন। একটি গানে তিনি পুনরাগমনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি আবার এই জ্ঞান-সাগরের তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন। আবার তিনি ধুলিমাটির পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন। মায়ার পৃথিবীতে ফিরে আসার এই আকুতিই ফুটে উঠেছে তাঁর গানের চরণে—

নমি নমি চরণে

নমি করুষহরণে॥

সুধারসনির্ঝর হে,

নমি নমি চরণে।

নমি চিরনির্ভর হে

মোহগহনতরণে॥

নমি চিরমঙ্গল হে

নমি চিরসম্বল হে

উদিল তপন গেল রাত্রি,

নমি নমি চরণে॥

গৌতমবুদ্ধ বাদে আর কোনও ধর্মবেত্তার পায়ের কাছে রবীন্দ্র নত হননি। বুদ্ধদেবই ছিলেন তাঁর কাছে একান্ত নমস্য। এই গানে সেই অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেয়েছে তুমুলভাবে। 

‘তোমা লাগি নাথ, জাগি, জাগি হে’, 

‘এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ’, 

‘সকল কলুষতামসহর, জয় হোক, তব জয়, অমৃতবারি সিঞ্চন করি নিখিলভুবনময়’ 

এ রকম বেশ কিছু গানেও বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের ভিত্তি প্রকাশিত হয়েছে।

এই নাটকগুলোতে ব্যবহৃত গানে বুদ্ধদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। বলা যেতে পারে, বুদ্ধদর্শনকে চেতনায় ধারণ করেই এই নাটকের গানগুলো রচিত হয়েছে। ‘শ্যামা’ নাটকের কথাই ধরা যাক। বজ্রসেন যখন শ্যামাকে ক্ষমা করতে না পারার জন্য নিজের অক্ষমতাকে দায়ী করেন। আর তখন এই দীনতার জন্য গৌতম বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানান।

রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের ও স্বদেশপর্বের গানে বুদ্ধচেতনার সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া নাটকের গানেও রয়েছে বুদ্ধচেতনার প্রকাশ। বিশেষ করে যে সকল নাটকে বৌদ্ধ আখ্যান রয়েছে, সে সকল নাটকের গানে সঙ্গত কারণেই বুদ্ধচেতনার প্রকাশ রয়েছে। ‘মালিনী’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘গুরু’, ‘অরূপরতন’, ‘নটীর পূজা’, ‘চণ্ডালিকা’ ও ‘শ্যামা—

নাটকে-কবিতায়-গানে খুব তীব্রভাবে বুদ্ধচেতনাকে গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাবিশ্বেও গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সদাজাগ্রত। তাই ছোটগল্প ও উপন্যাসেও বুদ্ধপ্রসঙ্গ উঁকি দিয়েছে কখনও-কখনও। কিন্তু দুঃখের কথা, নিবেদনের কথা, ভক্তির কথা, ভালবাসার কথা, অনুরাগের কথা, প্রার্থনার কথা খুব তীব্রভাবে প্রকাশ করার জন্য সংগীতের চেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম আর নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বুদ্ধচেতনাকে প্রকাশ করতে গানকে অবলম্বন করছেন। বুদ্ধচেতনায় জারিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের গানও হয়ে উঠেছে সর্বাঙ্গসুন্দর!

ওই বুদ্ধ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,

‘ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড় করিয়াছিলেন। তিনি জাতি মানেন নাই, যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়াছিলেন, দেবতাকে মানুষের লক্ষ্য হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন। তিনি মানুষের আত্মশক্তি প্রচার করিয়াছিলেন। দয়া এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ হইতে প্রার্থনা করেন নাই, মানুষের অন্তর হইতেই তাহা তিনি আহ্বান করিয়াছিলেন।'

রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শ ও সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করে বলা যায়, তিনি গৌতম বুদ্ধকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতেন ও জানতেন তা সুধাংশু বিমল বড়ুয়া রচিত রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি গ্রন্থে প্রবোধ সেনের কথা তুলে ধরেছেন- “একবার করাচিতে অবস্থান কালে রবীন্দ্রনাথকে একজন ছাত্র প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাকে তো সবাই ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করেন, আপনার গুরু কে?” রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ আমারও একজন গুরু আছেন। তোমরা সবাই তাকে জানো। তিনি হলেন গৌতম বুদ্ধ। মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে সমগ্র ভারতবর্ষে আজো গৌতম বুদ্ধেও উদ্দেশ্যে তাঁদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কবির ভাষায়- এতদসত্বেও রবীন্দ্র জীবনে ও সাহিত্যে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির কালজয়ী মহিমার ভাবাদর্শ যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে তার তুলনা বিরল। এখানেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ণতা ও সার্থকতা।

আমরা জানি ঠাকুর পরিবার মুর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। তাই কোনদিন কোন মুর্তির সামনে মাথা নত করেনি। কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন জীবনে একটি মুর্তির সামনেই তিনি মাথানত করেছেন। বুদ্ধগয়াতে বুদ্ধমুর্তি দর্শন করেই কবির মনে এই ভাবোদয় হয় এবং বুদ্ধমুর্তির সামনেই তিনি মাথানত করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পরম অনুরাগী শান্তিনিকেতনের একজন প্রবীন শিক্ষক নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী। সকলে তাঁকে গোঁসাইজি বলেই ডাকত। গোঁসাইজির মুখে শুনতে পাওয়া গেছে যে, একবার বুদ্ধগয়া থেকে ফিরে আসার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মস্তক মুন্ডন ও গোঁফ দাড়ি পর্যন্ত ছেদন করেছিলেন। বুদ্ধের আদর্শ ও ত্যাগের কথা চিন্তা করতে করতে কবির মনেও এমন বৈরাগ্য ভাবের সঞ্চার হয়েছিল।

রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হানা-হানি, স্বদেশী আন্দোলনের উত্তেজনা, প্রবলের অত্যাচার ও উৎপীড়ন এক প্রকার মাত্রাতিরিক্ত। এতে কবি উপলব্ধি করেছিলেন, পরাধীনতার গ্লানি, দেশবাসীর মানসিকতার দৈন্যদশা ও ভয়াবহ দারিদ্রতা। লোভ, হিংসা উগ্রতা, ক্ষমতার বড়াই ও লড়াই আর ক্ষমতার অপব্যবহার সব কিছুর বিরুদ্ধেই কবিগুরু সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। এই ঘোর তামসিকতার বিপরীতে যে সব গুণ বিভূষিত সত্যধর্ম তা ছিল মূলত রবীন্দ্রনাথের ধর্ম তথা মানবীয় ধর্ম। বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কবিগুরু সেই ধর্মবোধের প্রতিফলন দেখেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বুদ্ধ পৃথিবী জয় করেছিলেন, আলেকজান্ডার নয়।' রবীন্দ্র সংগীতের ঐক্যতত্ত্বের মূলত প্রেরণার উৎস যে তাই ছিল গৌতম বুদ্ধ।

সূত্র-

১। সৈয়দ আকরাম হোসেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস চেতনালোক ও শিল্পরূপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩৯৪, পৃ.১৮

২। অনীতা মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র সংগীতে বেীদ্ধ অনুপ্রেরণা, পশ্চিম বঙ্গ, রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৩, কলিকাতা, ১৯৯৬, পৃ. ৪০

৩। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক (১ম ভণ্ড), বিশ্ব ভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলিকাতা, ১৩৬৭, পৃ, ৪-৫

৪। এছাড়া গবেষক তপন বাগচীর কাছে ঋণী

রবীন্দ্রনাথ; বুদ্ধ

৫। https://bibartanonline.com 

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore Goutam Buddha)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours