পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
রাজ্য বিধানসভা ভোটের মাস খানেক আগে যখন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের জোয়ার, তখন কথাপ্রসঙ্গে এক, বাম নেতা আমায় বলেছিলেন – “ছাড়ুন তো মশাই, ওসব নাটক। এগুলি পিকের (প্রশান্ত কিশোরের) চাল। সব চর হিসেবে বিজেপিতে পাঠাচ্ছে টিএমসি। এরা সব আত্মঘাতী জঙ্গী হিসেবে কাজ করবে। এরা বিজেপিতে গিয়ে হারলেও টিএমসি-র লাভ, জিতলেও টিএমসির লাভ।“ এই কথাগুলি তখন বেশ হাস্যকর মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল কেউ দল বদলে ভুলেও বামেদের দিকে আসছে না বলে বোধহয় ফ্রাস্টেশনে এই কথাগুলি বলছেন বাম নেতা। পরে কিন্তু টিভির বিভিন্ন আলোচনাতেও বাম নেতৃত্বের মুখে এই বক্তব্য শুনতে পেয়েছি। আজ যখন বিপুল জয় নিয়ে ক্ষমতায় এসে তৃণমূল সুপ্রিমো দলবদলুদের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন “আসুক না। কে বারণ করেছে? স্বাগত।“ তখন বাম নেতাদের ওই মন্তব্য কিছুটা ভাবিয়ে তোলে বৈকি।
অনেকেই বলতে পারেন এটা রাজনৈতিক উদারতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতীতের তিক্ততা ভুলে এই উদারতা দেখিয়েছেন। এখানে কোনও রাজনৈতিক চাল নেই। কিন্তু সাধারণ কর্মী, সমর্থকদের কাছে এটা কি শুধুই উদারতা হিসেবেই গ্রহণযোগ্য হবে? নির্বাচনের আগে এই মমতাই দলবদলুদের মিরজাফর, গদ্দার, পচা ফল ইত্যদি বলে গালাগাল দিয়েছেন। নিচুতলার অগণিত কর্মী সমর্থকেরা বহু জায়গাতেই এই গদ্দারদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন। মমতা সহ বহু তৃণমূল নেতৃত্ব নির্বাচনের আগে বার বার বলেছেন এই গদ্দারদের জন্য দলের দরজা চিরতরে বন্ধ। কর্মীরাও এতে জোর পেয়েছেন লড়াইয়ে। তাহলে আজ এই উদারতা তাদের প্রতি বঞ্চনা কি নয়?
পচা ফল থাকলে ঝুড়ির অন্য ভাল ফলগুলিও নষ্ট হয়ে যায়। তাই ফের পচা ফল এনে ঝুড়িতে রাখলে তৃণমূলের সাজানো সংসারে কি পচন ধরবে না? বার বার বলা হয়েছিল বিজেপি কোটি কোটি টাকা দিয়ে, এজেন্সির ভয় দেখিয়ে এদের দলে নিয়েছে। এই তথ্য অনুযায়ী তাহলে টাকার লোভে যারা দল ছেড়েছিলেন তাদের দলে নিলে তো ফের লোভীদের ভিড়ে দল ভরে উঠবে। এতটা উদারতা পরে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তো?
দলবদলু নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল তৃণমূল। তাদের দুর্নীতি বা আর্থিক নানা অনিয়মের অভিযোগ থেকে বাঁচতেই বিজেপিতে গিয়েছে এই সব নেতারা। কিন্তু এখন সেই সব দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের যদি দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে দুর্দিনে দলে থাকা নেতা কর্মীদের কাছে কি বার্তা যাবে? অর্থাৎ দুর্নীতি করলে, তা থেকে বাঁচতে দল পাল্টালেও পরে বিনা প্রতিরোধে দলে ফিরে আসা যায়?
পূর্বতন নেত্রীর এই উদাত্ত আহ্বানে দলবদলুরা কি করবেন তা এখনও পরিস্কার নয়। তবে তলে তলে নাকি অনেকেই ইতিমধ্যে উসখুস করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তাদের তো সুবিধেই হল। কিন্তু মানুষের কাছে কি বার্তা যাবে? সেটা কি ভেবে দেখেছেন তৃণমূল নেত্রী। দলবদলু সিংহ ভাগ নেতাই এই ভোটে পরাজিত। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এই সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানীদের ভাল চোখে নেয়নি। তারা বহু জায়গাতেই দলত্যাগীদের পরিবর্তে তৃনমূলের প্রার্থীদেরই বেছে নিয়েছেন। এবার যদি তৃণমূল সেই অপছন্দের মানুষগুলিকে ফের গলায় জড়িয়ে নেয় তাহলে সাধারণ মানুষ কি তা ভাল ভাবে নেবেন?
সব শেষে তবে ওই বামেদের মন্তব্যকেই মান্যতা দিতে হচ্ছে। এরা সকলেই তৃণমূলের চর হিসেবে বিজেপিতে গেছিলেন বা পাঠানো হয়েছিল? কারণ হিসেব যদি এটাই হয় তবে তো সত্যিই এরা জিতলেও তৃনমূলের লাভ, হারলেও তৃণমূলেরই লাভ। তাই হয়েছে বোধহয়। এখন ভোট মিটতে নিজেদের কাজ শেষে ফের ফিরে আসছেন দলে। নেত্রী সেই আসার পথ পরিষ্কার করে দিলেন? নাকি বিজেপিকে আরও দুর্বল করে দিতে এটিও মমতার আর এক রাজনৈতিক চাল? এই লেখা জুড়েই প্রশ্ন অনেক। কিন্তু তার উত্তর মেলা সত্যিই কঠিন। কারন, রাজনীতিতে কি না হয়?
(www.theoffnews.com - West Bengal politics Mamata Banerjee TMC BJP)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours