তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
জোড়াসাঁকোর জয়রাম ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্ৰ নীলমনি ঠাকুরের আবার তিন পুত্র-- রামলোচন, রামমনি, রামবল্লভ। রামলোচনের পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি মেজো ভাই রামমনির ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তক গ্রহণ করেন। প্রায় দুশো বছর আগে ১৭৯৪ সালে দ্বারকানাথের জন্ম হয়। উনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পুরুষদের অন্যতম। শুধু তাই নয় তিনি শিল্প সংস্কৃতি ও বাণিজ্যে স্বপ্ন সমৃদ্ধ পদচারণের এক অনন্য নিদর্শন। রামলোচনের মৃত্যুর পরে ষোলো বছর বয়সে দ্বারকানাথ তাঁর সম্পত্তির মালিক হন। সম্পত্তি বলতে, কলকাতার জমি-বাড়ি এবং মফঃস্বলের জমিদারি। সেই সময় জমিদারির বার্ষিক আয় ছিল তিরিশ হাজার টাকা। অন্য জমিদারদের থেকে দ্বারকানাথ ছিলেন স্বতন্ত্র। আইনকানুন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। পরবর্তী কালে তিনি আরও কয়েকটি জমিদারি কিনেছিলেন। দ্বারকানাথের বয়স যখন সতেরো যশোহরের এক পীরালি পরিবারের মেয়ে দ্বিগম্বরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রামমোহন রায় সমসাময়িক এবং বন্ধু হলেও দু’জন দুই প্রান্তের মানুষ ছিলেন। চিন্তাধারায় এবং উদ্যোগে দ্বারকানাথ তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম তথা রামমোহনের একেশ্বরবাদী দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও তিনি কখনও নিজের ধর্ম ছাড়েননি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তখন প্রতি বছর দুর্গা, কালী এবং জগদ্ধাত্রী পুজো হত। এমনকী, একসময় দ্বারকানাথ নিজের হাতে কুলদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনের নিত্য সেবা করতেন। তাঁর ছিল তীক্ষ্ম বুদ্ধি, অদম্য সাহস, ফার্সি এবং ইংরেজি ভাষায় অভাবনীয় পান্ডিত্য, সংগীতে পারদর্শিতা, তেমনি ছিল গভীর দেশপ্রেম ও তেজস্বীতা। ব্রিটিশ শাসক যখন প্রেস আইন এর বলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করছিল ওই সময়ে টাউন হলের জনসভায় উনি ছিলেন অন্যতম বক্তা।দ্বারকানাথ রামমোহনের সমসাময়িক এবং রামমোহনের সংস্কার প্রচেষ্টার বা আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক। কিন্তু সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
উনি বুঝে ছিলেন শিল্প বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে গেলে পরিকাঠামো দরকার এবং আইনকে বুঝে ব্যবহার করার পারদর্শীতা চাই। না হলে পুঁজির বিকাশ ঘটবে না। বাঙালির শিল্প বাণিজ্যের ইতিহাসে উনি ছিলেন প্রথম। উনাকে বাদ দিয়ে এগোনোই যাবে না। ১৮৩৩ সাল থেকে আমৃত্যু হিন্দু কলেজের পরিচালক ছিলেন। ১৮৩৫ সালে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা। কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও জমিদার সভা স্থাপনে প্রধান উদ্যোগী। যেন উনি একাই একটা বহুজাতিক সংস্থা।
তাঁর ভাষা ও আইন জ্ঞানের জন্য তিনি ২৯ বছর বয়সে ২৪ পরগনার কালেক্টর এবং সল্ট এজেন্ট হয়েছিলেন। পরে তিনি শুল্ক ও আবগারি বিভাগের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। তাঁর চিন্তা ভাবনার সফল রূপায়নের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন একটির পর একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যেমন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, বেঙ্গল কোল মাইন, বীমা, কার টগর কোম্পানি, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি, বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি প্রভৃতি আরও নানা রকমের প্রতিষ্ঠান। তাঁর নিজেরই ছিল তিনটে বাণিজ্যিক জাহাজ যা ছিল আমদানি রপ্তানির বানিজ্যের বাহন। ১৮৩২ সালে ৯ জানুয়ারি ইন্ডিকা নামে নিজের জাহাজে চেপে তিনি লন্ডন যাত্রা করেন। ইংল্যান্ডের মানুষ দ্বারকানাথের সৌন্দর্য্য বোধ, জ্ঞান ও আন্তর্জাতিক মানসিতকার জন্য বিস্মিত হয়েছিলেন। সেইখানকার সম্ভ্রান্ত ইংরেজ নাগরিক তাঁকে প্রিন্স নামে ভূষিত করেছিলেন। ১৮৪৫ সালে তিনি দ্বিতীয় বার ইংল্যান্ড যান এবং ১৮৪৬ সালের পয়লা আগস্ট লন্ডন শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। কেনসাল গ্রিন গির্জায় তাঁর শব দেহ সমাহিত করা হয়।
কেনসাল গ্রিন সমাধিক্ষেত্রে যে বাঙালি চিরনিদ্রায় শায়িত, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন হুগলির তীরে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব আনার। ব্রিটিশের দাসত্ব নয়, বরং তাঁদের সহযোগিতায় এ দেশের উন্নতি সম্ভব, এ ছিল তাঁর একান্ত উপলব্ধি। তাই সেকেলে ধর্মান্ধতাকে তুচ্ছ করে বিশ্ব দরবারে বাঙালির শিল্পোদ্যোগী উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে কালাপানি পেড়িয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর বিলেতে। অথচ বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা হিসেবে!
তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যাঙ্কের সঙ্গে বাঙালির যোগসূত্র গড়ে তোলা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের উন্নতিসাধন বা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে রেলপথ স্থাপনের স্বপ্ন দেখা— এ সবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। তাঁর হাত ধরেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বৈভব ও প্রতিপত্তির সূচনা।
৫১ বছর বয়সের এক বাঙালী ভদ্রলোক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুশয্যাতেও তাঁর অগাধ সৌজন্যবোধের এতটুকু ঘাটতি দেখা যায় নি। তাঁর সদাহাস্য মুখে ছিল একটিই কথা “I am content”। এই ভদ্রলোকের নাম প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর সম্বন্ধে কবিগুরু চিরকাল এক রহস্যময় নীরবতা বজায় রেখেছেন।
বাগ বাজারের রূপচাঁদ পক্ষী ছড়া কেটে লিখেছিলেন, “বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি,...মদের কত গুণাগুণ আমরা তার কি জানি? জানেন ঠাকুর কোম্পানী।” দ্বারকানাথ প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাঁকে নিপাট ভালো মানুষ বলেও ভাবা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর গুণ ছিল অনেক। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন, “এই বিপুল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে আছেন মাঝারি উচ্চতার, পেলব চেহারার একটি মানুষ – দ্বারকানাথ ঠাকুর আর তাঁর ম্যানেজিং এজেন্সি সংস্থা – ‘কার-টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানী’। সময়টা ১৮২০ থেকে ১৮৪৬, যে পর্বে কলকাতায় একটা মিনি-ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন প্রায় ঘটতে চলেছিল। সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ ও সামাজিক হিত সাধনে রামমোহনের অনুরাগী ও সহযোদ্ধা দ্বারকানাথ। আধুনিক চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী। অন্ধ ও কুষ্ঠারোগাক্রান্তের হিতার্থী, কলকাতা নগরে উন্নতিকামী জাস্টিস ফর পিস, একাধিক সংবাদপত্রের স্বত্ত্বাধিকারী, মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী, কলকাতা থিয়েটার ও চারুকলা সংস্থার পৃষ্ঠপোষক। দ্বারকানাথের চেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যক্তিত্ব উনবিংশ কেন বিংশ শতাব্দীতেও বিরল।
কর্মজীবনের পাশাপাশি দ্বারকানাথ ছিলেন থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক এবং শিল্পরসিক। তাঁর নামের সঙ্গে একটা মিথ হয়ে রয়ে গিয়েছে বেলগাছিয়া ভিলা। তৎকালীন সাহেবদের কাছে এটি ছিল ‘পারফেক্ট প্যারাডাইস’। চার দিকে সবুজ ঘাস বিস্তৃত দোতলা বাড়িটির প্রতিটি ঘর ছিল ইউরোপীয় ধাঁচের আসবাবপত্রে সাজানো। এ ছাড়াও সে সময় জোড়াসাঁকোর বৈঠকখানা বাড়িটিও সাজানো ছিল দেওয়াল জোড়া আয়না, কাটগ্লাসের ঝাড়বাতি ও বিদেশি শিল্পীদের আঁকা তৈলচিত্রে। দ্বারকানাথের জমি কেবলমাত্র বেলগাছিয়া ভিলাতে শুধু নয় ,পাইকপাড়ার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিলো দমদম রোড পর্যন্ত।
যাই হোক ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় পাবলিক ব্যাঙ্ক ছিল না। আধা সরকারি ব্যাঙ্ক কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার নেপথ্যেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এসবের পাশাপাশি, এ দেশে সংবাদমাধ্যম স্থাপন এবং তার উন্নতির জন্য দ্বারকানাথের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ১৮২১-এ রামমোহন প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ‘সংবাদ কৌমুদি’র তিনি সম্পাদক ছিলেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল হেরল্ড’ এবং বাংলা ‘বঙ্গদূত’ কাগজের সূচনাও হয়েছিল তাঁর হাতে। এ ছাড়া তাঁর অর্থসাহায্যে চলত ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘ইংলিশম্যান’ প্রভৃতি সংবাদপত্র।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বৈভব ও প্রতিপত্তির প্রধান উৎস ছিলেন দ্বারকানাথ। কিন্তু তিনিই আজও হয়েছেন বিস্মরণের শিকার। এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু লেখেননি। কেন? বা নীরব কেন? এই প্রশ্ন বার বার উঠেছে।পুরো সাহিত্যিক জীবনে পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ প্রায় নীরব। তবে বিভিন্নজনের লেখায় দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের পরস্পর সম্পর্কে মনোভাবের কিছু খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়।
দেখা যাচ্ছে, পিতার মহানুভবতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পিতামহের প্রসঙ্গ টানছেন। লন্ডনে দ্বারকানাথের হঠাৎ মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানেরা, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ, ‘ঋণসমুদ্রে’ পড়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ পিতামহ দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে সদর্থক কিছু বলছেন না। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বারকানাথ দুজনেরই জীবনীকার ছিলেন কৃষ্ণ কৃপালনী। আত্মীয়তার সূত্রে তিনি ঠাকুর পরিবারের সদস্য (রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী নন্দিতার স্বামী)। পিতামহের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা তাঁকেও অবাক করেছে।
এদিকে দেবেন্দ্রনাথ-পৌত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ (হেমেন্দ্রনাথ-পুত্র) দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীতে লিখছেন, দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত ‘কার ঠাকুর কোম্পানি’র কাগজপত্র রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হয়। একই রকম অভিযোগ দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেও আছে। কৃপালনী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তিনি (দ্বারকানাথ) কেন অবজ্ঞাত উপেক্ষিত হয়ে রইলেন? এই বিস্মৃতপ্রায় লোকটি কি তবে কুলে কালি দিয়েছিলেন বলে পরিবারের কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করে না? যে-লোকটি তাঁর জীবিতকালে এত লোকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো কেন?’
মাত্র ৫১ বছর বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর পর প্রিন্স দ্বারকানাথের ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছিল উড়নচণ্ডী, অপব্যয়ী, ভোগবিলাসে মত্ত এক পুরুষ হিসেবে। কৃষ্ণ কৃপালনী লিখেছেন, ‘ঠাকুর-পরিবারের লোকেদের মুখে কিংবা বহুকাল শান্তিনিকেতন থেকেও আমি তো এঁর (দ্বারকানাথ) নাম বড় একটা শুনিনি।’ তাই হয়তো বইয়ের নাম দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ টেগোর: আ ফরগটেন পাওনিয়র: আ লাইফ।
দ্বারকানাথের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির পেছনে বাইরের মানুষের চেয়েও পরিবারের লোকদের, বিশেষত পুত্র দেবেন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত কার ঠাকুর কোম্পানির পতন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মজীবনীতে দেবেন্দ্রনাথ সখেদে লিখেছেন, ‘কল্য কি খাইব, কি পরিব, তাহার আর ভাবনা নাই। কাল এ বাড়িতে থাকিব, কি, এ বাড়ি ছাড়িতে হইবে, তাহার ভাবনা নাই। একেবারে নিষ্কাম হইলাম।’
দ্বারকানাথের মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন। পিতামহকে সরাসরি জানা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। শৈশবে মাকে হারিয়ে বড় হয়েছেন পিতার প্রচণ্ড প্রভাবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতার প্রভাব থেকে অনেকটা বেরিয়ে এলেও পিতামহ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব পরিবর্তনের কোনও ইঙ্গিত মেলে না।
উত্তর লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সেমেট্রিতে সমাহিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ। রবীন্দ্রনাথ অন্তত চারবার বিলেতযাত্রা করেছেন, একটিবারও ঠাকুরদার সমাধি দেখতে যাননি। বিলেতে প্রশিক্ষণ নিতে যান। দ্বারকানাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে সত্যেন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন। স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর স্মৃতিকথায় জানা যায়, তাঁদের অকালপ্রয়াত শিশুপুত্রকে সমাহিত করা হয় দ্বারকানাথের সমাধির পাশে।
১৮৪২ সালে সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম। চার বছর পর দ্বারকানাথ মৃত্যুবরণ করেন। সত্যেন্দ্রনাথের মনে ঠাকুরদার কিছু স্মৃতি কি ছিল? নিজের বুদ্ধি ও আর্থিক স্বাধীনতা দিয়ে দ্বারকানাথের ব্যাপারে স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন তিনি? এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু জানা যায় না। ১৮৮২ সালে দ্বারকানাথের সমাধিতে গিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। সঙ্গে ছিলেন সুহৃদ মনমোহন ঘোষ। দ্বারকানাথের সমাধির দুর্দশা দেখে দুজনেই ব্যথিত হন। ১৯ মে মনমোহন চিঠি লেখেন দেবেন্দ্রনাথের আরেক পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথকে। ইংরেজি চিঠিতে মনমোহন লেখেন, মহর্ষি যদি চান খুব অল্প খরচেই দ্বারকানাথের সমাধির উন্নয়ন সম্ভব।
এর কোনও উত্তর দেবেন্দ্রনাথ দেননি। পিতা দ্বারকানাথের ব্যাপারে দেবেন্দ্রনাথের অবস্থান খুব স্পষ্ট নয়। আত্মজীবনীতে একদিকে তিনি পিতার ঋণসমুদ্রের কথা লিখে গেছেন, অন্যদিকে নিজেদের বিষয়বুদ্ধিহীনতার কথাও বলেছেন।
দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার পিতা ১৭৬৩ শকের পৌষ মাসে য়ুরোপে প্রথমবার যান। তখন তাহার হাতে হুগলী, পাবনা, রাজসাহী, কটক, মেদিনীপুর, রঙ্গপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলার বৃহৎ বৃহৎ জমিদারি এবং নীলের কুঠী, সোরা, চিনি, চা প্রভৃতি বাণিজ্যের বিস্তৃত ব্যাপার। ইহার সঙ্গে আবার রাণীগঞ্জে কয়লার খনির কাজও চলিতেছে। তখন আমাদের সম্পদের মধ্যাহ্ন সময়। তাঁহার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই সকল বৃহৎ কার্য্যের ভার আমাদের হাতে পড়িলে আমরা তাহা রক্ষা করিতে পারিব না।’
দেবেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, এ জন্য দ্বারকানাথ পৈতৃক দুটি ও নিজের অর্জিত দুটি জমিদারি ট্রাস্টের কাছে দিয়ে যান। দ্বারকানাথের তিন ছেলে এখান থেকে মাসে নির্দিষ্ট অর্থ পেতেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই কার্য্যে আমাদের প্রতি তাঁহার স্নেহ ও সূক্ষ্ম ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, উভয়ই প্রকাশ পাইয়াছে।’
দেবেন্দ্রনাথের এই লেখা থেকে দ্বারকানাথের বিশাল কর্মোদ্যোগের খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পৈতৃক দুটি জমিদারির ভার গ্রহণ করে তিনি খুব দ্রুত প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন। আয়ের জন্য শুধু জমিদারির ওপর তিনি নির্ভর করেননি, আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেছেন। পাশাপাশি আইন ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এ ছাড়া দুই দফায় প্রায় ১২ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে দেওয়ানি ও সেরেস্তাদারির চাকরি করেছেন।
দ্বারকানাথ যে পুত্র দেবেন্দ্রনাথের বিষয়বুদ্ধির ওপর তেমন আস্থা রাখতে পারেননি, সেটা মৃত্যুর মাস দুই আগে দেবেন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে স্পষ্ট। কমলেন্দু ধরের দ্বারকানাথ ঠাকুর: বাংলার শিল্প-বাণিজ্য বইয়ে চিঠিটি আছে। ২২ মে ১৮৪৬ সালে দ্বারকানাথ লিখেছেন, ‘অপরাপর জায়গা থেকে যে-সব খবরবার্তা ইতিমধ্যে আমি পেয়েছি এবং মি. গর্ডন তোমার আমলাদের বিষয়ে যা-কিছু লিখেছেন তা থেকে আমি এখন দৃঢ়নিশ্চিত এ-সব রিপোর্ট সত্য। আমার সমস্ত এস্টেটগুলি যে এখনো ছারেখারে যায়নি—এইটেই আশ্চর্য। আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় খবরকাগজের জন্য লিখে নতুবা মিশনারি সায়েবদের সঙ্গে ঝগড়া করে। অথচ তোমার উচিত ছিল বিষয়-আশয়ের এই সব জরুরী ব্যাপারের উপর সর্বদা নজর রাখা ও বিষয়-আশয় রক্ষা করা। যে-সব কাজ সতর্ক হয়ে তোমার নিজের করা উচিত ছিল, সেগুলি ফেলে রেখেছ তোমার সব পেয়ারের আমলাদের হাতে। দেশের জলহাওয়া ও গরমি সহ্য করার মতো আমার যদি শক্তি থাকত, তাহলে এতদ্দণ্ডে লন্ডন ছেড়ে আমি চলে যেতাম নিজের হাতে সবকিছু তত্ত্বাবধান করতে।’
শুধু বিষয়-আশয় রক্ষা করা নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল, তা নয়। দেবেন্দ্রনাথের মা দিগম্বরী দেবীও এখানে বড় অনুঘটক বলে প্রতীয়মান হয়। ইংরেজ সাহেব-বিবিদের সঙ্গে দ্বারকানাথকে একসঙ্গে সুরা পান করতে দেখে দিগম্বরী গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজের কাছে মতামত চান, স্বামী যদি ‘ম্লেচ্ছ’দের সঙ্গে পানভোজন করে, তাহলে তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে থাকা কর্তব্য কি না। বিধান আসে, স্বামীর ভক্তি-সেবা করা কর্তব্য, কিন্তু সহবাস অকর্তব্য। এই বিধান আমৃত্যু মেনেছিলেন দিগম্বরী।দ্বারকানাথও স্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে মূল বাড়ির বাইরে আলাদা থাকতে শুরু করেন। কোনও প্রয়োজনে স্বামীর সঙ্গে কথা বললে পরে শরীরে সাত ঘড়া গঙ্গাজল ঢেলে নিজেকে ‘পরিশুদ্ধ’ করতেন দিগম্বরী।
‘দ্বারকানাথের মৃত্যুমুখোশ’ লেখায় অনিরুদ্ধ সান্যাল ইঙ্গিত করেছেন, দিগম্বরীর প্রভাবেই হয়তো দ্বারকানাথের মা অলকাসুন্দরী দেবীকে মৃত্যুর তিন দিন আগে গঙ্গাযাত্রায় নিয়ে যান দেবেন্দ্রনাথ। দ্বারকানাথ তখন উত্তর ভারতে। ২১ বছরের নাতিকে অলকাসুন্দরী বলেছিলেন, দ্বারকানাথ থাকলে এমনটা কখনোই হতে দিতেন না। ফিরে এসে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পান দ্বারকানাথ। পরবর্তীকালে দিগম্বরী দেবী মরণাপন্ন হলেও গঙ্গাযাত্রা করতে দেননি দ্বারকানাথ। আমৃত্যু বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করিয়েছেন।
যে ব্রাহ্মণ সমাজের বিধানে দিগম্বরী দেবী স্বামীর প্রতি এত কঠোর আচরণ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন দ্বারকানাথের ঘোর বিরোধী। তাঁদের বিরুদ্ধেই রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে দ্বারকানাথ সক্রিয়ভাবে লড়েছিলেন সতীদাহ প্রথা বিলোপ করতে। প্রথমবার সমুদ্র পার করে বিদেশযাত্রা থেকে ফিরে ব্রাহ্মণ সমাজের বিধানমতে ‘শুদ্ধ’ হতেও রাজি হননি দ্বারকানাথ। তিনি ধার্মিক ছিলেন, আবার একই সঙ্গে ছিলেন সংস্কারমুক্ত আধুনিক মানুষ।
এমন মানুষকে নিয়ে নানা কথা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ভোগবিলাসী আচরণ, বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে সুরা পান, নৃত্যগীত, বিদেশি নারীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার নানা অভিযোগ তাঁকে শুনতে হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা পর্যন্ত দ্বারকানাথের নাম নিতে সংকোচ করতেন। অথচ কৃপালনীর লেখা জীবনীতে আছে, ক্ষিতীন্দ্রনাথকে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, দ্বারকানাথকে তিনি খুব ভালো করে চিনতেন। তাঁর বিরুদ্ধে যা বলা হয়, সেগুলো নির্লজ্জ মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
এ কথা ঠিক যে দ্বারকানাথ ঋণ করেছিলেন। কিন্তু একটি চলমান কারবারে ঋণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। ঋণের চেয়ে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল কয়েক গুণ বেশি। দ্বারকানাথের অর্জিত ও রক্ষিত জমিদারির আয়েই তাঁর ঋণ শোধ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। এই আয়েই ঠাকুর পরিবারের কয়েক পুরুষ সচ্ছল জীবন যাপন করেছিলেন। কেন দেবেন্দ্রনাথ সহ দ্বারকানাথের উত্তরসূরিরা তাঁর ব্যাপক শিল্পোদ্যোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটি অন্যত্র আলোচ্য।
রবীন্দ্রনাথ পিতা দেবেন্দ্রনাথের মতো ‘অতুল বৈভবের মধ্যে লালিতপালিত’ হননি বটে, কিন্তু তাঁর বাল্যকাল অসচ্ছলও ছিল না। দেবেন্দ্রনাথের বৈভবশালী ও রবীন্দ্রনাথের সচ্ছল শৈশব—দুই'ই দ্বারকানাথের সৌজন্যে। এহেন দ্বারকানাথকে আমরা ভুলে গেলাম কি করে? বেলগাছিয়া ভিলা আজ সব হারানো স্মৃতি যেন মনে করিয়ে দিয়ে বলে, বাঙালি আর ঘুম নয় ,একটু মুক্ত মনা হও আর পারলে একটু আন্তর্জাতিক হও।
তথ্যসূত্র:
অজিত কুমার বসু-- কলকাতার পথ ঘাট সমাজে ও সংষ্কৃতিতে
কিশোরীচাঁদ মিত্র-- ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ১৯৬২।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর-- ‘দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী’, ১৩৭৬।
সিদ্ধার্থ ঘোষ-- ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ’, দেশ পত্রিকা, ১২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪।
‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর কমেমোরেটিভ ভল্যুম’, বিশ্বভারতী প্রেস, ১৯৯০।
টাইমস অফ লন্ডন, আগস্ট ৫ ও ৬ সংখ্যা, ১৮৪৬।
কৃষ্ণ কৃপালানি-- ‘দ্বারকানাথ টেগোরঃ এ ফরগটন পাইওনিয়ার’।
(www.theoffnews.com - Prince Dwarakanath Tagore)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours