পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

২০০৪ এর লোকসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়েছে। ভোটের দিন চারেক আগে অফিস থেকে ফোন, ভোট কভারে অন্য জেলাতেও যেতে হবে। আমার ভাগে হাওড়া পড়েছে। কলকাতার পাশের জেলা। মনে মনে খুশিই হলাম এই সুযোগে বাড়িতেও একবার ঘুরে আসা যাবে, ভালই হয়েছে। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম, হাওড়ার দায়িত্বে থাকা শাশ্বত ইটিভিতে আমারই ব্যাচমেট। আমি আসছি খবর পেয়ে ওই ফোন করে জানাল, কোনও অসুবিধে হবে না। সব ব্যবস্থা ওই করে রাখবে। ভোটের দিন সকালে হাওড়া পৌঁছলাম। অফিস আগেই গাড়ি দিয়ে দিয়েছিল, হাওড়া থেকে আমার সঙ্গী হল স্থানীয় এক ক্যামেরাম্যান। শাশ্বত ফোনে জানাল “তোকে বেশি খাটাখাটনি করতে হবে না। তোর জন্য খুব সোজা একটা জায়গার কথা ভেবে রেখেছি। সঙ্গে থাকা ক্যামেরাম্যানকে সব বলা আছে। ওই তোকে নিয়ে যাবে। তুই জাস্ট বেড়িয়ে আয়, বিকেলে এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া হবে।”

সঙ্গী ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করতে জানাল, আমতার কাছে একটা গ্রামে যাব দাদা। শুনে বেশ খুশিই হলাম, গ্রামই ভাল, শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে শস্য শ্যামলা বাংলা দেখতে দেখতে দিনটা ভালই কেটে যাবে। খুশি খুশি মেজাজে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। পথে একটা ধাবায় প্রাতরাশ সেরে এবার আমতার সেই গ্রামে ঢুকবার পালা। লক্ষ্য করলাম সঙ্গী ছেলেটির মুখ চোখ বদলাচ্ছে। এতক্ষণ যে খুশি খুশি ভাব ছিল তা যেন একটু কম মনে হচ্ছে। এদিক ওদিক ফালুক ফুলুক তাকাচ্ছে। উসখুস করছে। জিজ্ঞাসা করলাম- “কোনও সমস্যা হচ্ছে নাকি?” মুখে না বলল বটে তবে ভাব দেখে তেমন স্বস্তি মনে হল না। মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ এক জায়গায় বলল গাড়ি দাঁড় করাতে। বড় রাস্তা ছেড়ে আমরা তখন একটা ছোট পথে। সেখানে কাছাকাছি জনমনিষ্যি দেখলাম না। গাড়ি দাঁড়াতে নেমে বলল এবার হেঁটে যেতে হবে দাদা। রাস্তায় গাড়ি আরও যেতেই পারে। কাছাকাছি কোনও ভোট কেন্দ্র বা কিছুই চোখে পড়ছে না। অবাক হয়ে বললাম এখানে কি আছে? সঙ্গীর উত্তর ওই গ্রামে গাড়ি নিয়ে যাওয়াটা রিস্কি। আমরা নজরে পড়ে যাব। অগত্যা চালককে থাকতে বলে দুজনে হেঁটেই রওনা দিলাম গ্রামের দিকে। 

যেতেই যেতেই শুনলাম গ্রামের নাম কাদুয়া। ১৯৯১ সালে লোকসভা ভোটের পর হাত চিহ্নে ভোট দেওয়ার অপরাধে কবজি থেকে হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল ১৪ জন গ্রামবাসীর। খুন হয়েছিলেন কংগ্রেসের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য গোপাল পাত্র।  ঘটনার পর প্রায় ১৪ বছর পর এখনও এই গ্রামে উঠতে বসতে লাল হুকুম চলে। এখানে সাংবাদিকদের ঢোকা শাসকদলের না পসন্দ। তাই সন্তপর্ণে আমাদের গিয়ে কাজ সেরে ফিরে আসতে হবে। গাড়ি নিয়ে ঢুকলে তো সহজেই নজরে পড়ে যাব। এবার বুঝলাম শাশ্বত আমায় ভালবেসে কতটা সহজ এবং শান্তিপূর্ণ জায়গাতে পাঠিয়েছে। আর কিছু করবার নেই, মনে মনে ওটাকে গালাগালি দিতে দিতে এগোলাম গ্রামের দিকে। হঠাৎ পাশে চাপা আওয়াজ, দাদা... ও দাদা... লোগোটা লুকিয়ে ফেলুন। কেন? বিপদ হতে পারে। সামনেই দেখলাম কতগুলি যুবক সন্দিহান দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে। কোনও দিকে না তাকিয়ে আমরা সোজা চলেছি। গ্রামের মাঝে একটা স্কুলে ভোট গ্রহণ চলছে। বেশ কিছু রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই হাজির হলাম সেই স্কুলে। ভোট চলছে শান্তিপূর্ণ ভাবেই। শুধু বিরোধীদলের এজেন্টকেই চোখে পড়ল না। এবার একটু আধটু ছবি নেওয়ার পালা। ভোট কেন্দ্রেই পেয়ে গেলাম এমন একজনকে যার হাত কাটা গিয়েছিল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার অপরাধে। মর্মান্তিক সেই কাহিনী তার মুখ থেকেই শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল কোথায় আছি আমরা। তার একটা বাইট নিয়ে, ভোট কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে পিটিসি দেওয়া শুরু করেছি, এমন সময় এসে থামল চার পাঁচটি বাইক। নেমে এল কয়েকজন। সোজা প্রশ্ন, এখানে কি করতে এসেছেন? বললাম ভোট দেখতে। হুকুম এল এখুনি এখান থেকে চলে যান, জায়গাটা ভাল নয়। বললাম কাজ শেষ করেই চলে যাব, কিন্তু আপনারা কে? আমার কাছে তো ইলেকশন কমিশনের কার্ড আছে। আপনাদের কাছে কি আছে? শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল যুবদল। “বেশি কথা বললে এখানেই মেরে এখানেই পুতে দেব, কেউ কিচ্ছু বলবে না।” তেড়ে এল একজন। দূরে এক পুলিশ কর্মী নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে। বুঝলাম তাকে কিছু বলে কোনও লাভ নেই। সঙ্গী ছেলেটি ইতিমধ্যে একটা কাজ করে ফেলেছে এই বাদানুবাদের খানিকটা ছবি সে তুলে ফেলেছে। আমার অভিজ্ঞ চোখে সেটা নজর এড়ায়নি। দেখলাম এটুকুতেই অনেকটা কাজ হয়ে গিয়েছে। বললাম ঠিক আছে আমরা ফিরে যাচ্ছি। দুজনে হাঁটা শুরু করে খানিকটা এগিয়ে এসেছি। হঠাৎ সামনে এসে থামল বাইক বাহিনী। কি হল আবার? ক্যাসেটটা দিয়ে যান। কোন ক্যাসেট? যেটাতে আমাদের ছবি তুলেছেন। বলতে বলতেই দেখলাম হাতে রয়েছে দেশি পিস্তল। বুঝলাম ধরা পড়ে গিয়েছি। ইশারা করতেই ক্যামেরা থেকে ক্যাসেট খুলে ওদের হাতে দিয়ে দেওয়া হল। থাপ্পড় খেল ক্যামেরাম্যান। আরও কয়েক ঘা পড়তে চলেছে এমন সময় হঠাৎ হাজির হলেন স্থানীয় কোনও নেতা। তারই নির্দেশে আমাদের আর না মেরে ছেড়ে দেওয়া হল। ক্যাসেট নিয়ে আরও একবার শাসিয়ে বলে গেল আর পাঁচ মিনিট পর এখানে দেখা গেলে আমাদের আর বাড়ির লোক কোনওদিন দেখতে পাবে না। দেখলাম আমাদের উপরে নজর রাখছে কয়েকজন। ওকে বললাম আলাদা হয়ে যেতে, দুজনে দুদিক দিয়ে গাড়ির কাছে পৌছতে হবে। রাস্তা তেমন চিনি না, আন্দাজে মহিলাদের জিজ্ঞাসা করে এগোলাম গাড়ির দিকে। মাঠের আল বেয়ে তখন আসছে আমার সঙ্গী। দূরে ফের দেখা যাচ্ছে বাইক বাহিনীর আবছা চেহারা, আবার আসছে নাকি? এবার এলে সত্যি আমাদের ছেড়ে দেবে না সেটা জানাই আছে। দৌড়ে গিয়ে গাড়ি চালককে বললাম স্টার্ট দিয়ে রাখতে। ইশারা করে দ্রুত আসতে বলছি ছেলেটিকে। ওদিকে এগিয়ে আসছে বাইকের আওয়াজও। সঙ্গী ছেলেটি কাছে আসতে, প্রায় চলন্ত গাড়ি থেকেই তুলে নিলাম ওকে। গাড়ি চলছে, পিছনে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাড়া করে আসছে বাইক বাহিনী। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছি আমরা। বড় রাস্তায় গাড়ি পড়তেই নিঃশ্বাস নিলাম বড় করে। গাড়ি চালকও আন্দাজ করে নিয়েছে বিপদ, প্রায় ১০০তে চলছে গাড়ি। পিছনটা ফাঁকা দেখে এবার মুখ থেকে বেরিয়ে এল হাসি, জিনসের প্যান্টের নিচের দিকের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এল একটা ক্যাসেট। শ্যুট করবার পরেই সকলের নজর এড়িয়ে যেটা আমি নিয়ে নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে। এখনও বুঝতে পারেননি বোধহয়? ওদের যে ক্যাসেটটি দেওয়া হয়েছিল সেটাতে কিছুই ছিল না। তাই তো আমরা বুঝেছিলাম, ভাওতা দিয়ে সামান্য কিছু সময় আমরা পাব। তার মধ্যেই নিশ্চয় গিয়ে ওরাও দেখে নেবে। নিলেই বুঝবে ধোঁকা খেয়েছে। আর তার পরেই আমাদের গুলি খাওয়ার পালা। সেটাই হয়েছে, আর সামান্য কিছু সময় এদিক ওদিক হলেই কি যে হত! জানি না, এখন আর জানতেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু শাশ্বতকে যে ফিরে গিয়ে এই শান্তিপুর্ণ এসাইনমেন্টের জন্য খুব গালমন্দ করেছিলাম সেটা মনে আছে। ভোটের এটাও একটা দিক। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - election coverage)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours