পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

(ডাকাত রানি ও স্টিং অপারেশন)

২০০৩ এর কোনও এক সকাল, সিউড়ীর ইটিভি অফিসে বসে আমরা কজন। কথা হচ্ছে এক মহিলা প্রতারককে নিয়ে। সামনে বসা তিন চারজনই চাকরি পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে তাকে টাকা দিয়েছিল, যথারীতি চাকরিও পায়নি, টাকাও না। পুলিশের কাছে গিয়েও সেভাবে পাত্তা না পাওয়ায় এবার তারা আমার স্মরণাপন্ন হয়েছে। টাকা যে দিয়েছে তেমন কোনও প্রমাণ তাদের কাছে নেই, শুধু মুখের কথায় এমন খবর করা মুশকিল। তাই প্ল্যান হচ্ছে কি করা যায়। ডাকা হল জেলায় ছড়িয়ে থাকা আমাদের অন্য প্রতিনিধিদের। রুদ্ধদ্বারে বসে ঠিক হল আমরাও যাব চাকরির খোঁজে ওই মহিলার কাছে। 

কাজটা মোটেই সহজ নয়। যে ছেলেরা টাকা দিয়েছিল তারা স্পষ্ট জানাল জায়গাটা মহম্মদবাজার থানার সোঁতসাল গ্রাম। মহিলার নাম গুলনেহার বেগম। এলাকাটা মোটেই ভাল নয়। স্থানীয় ছেলে বা গুন্ডাদের ওই মহিলা হাতে রেখে দিয়েছেন, ধরা পড়লে কিন্তু ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। গুলনেহারের নামে নানা কথা শোনা যায়, পুলিশ প্রশাসনের উপর তলা মায় মুখ্যমন্ত্রীর পিএ পর্যন্ত তার নাকি অবাধ যাতায়াত। সকলেই তার হাতের মুঠোয়। প্রতারণা, তোলা আদায় এমনকি ডাকাতি করানোর দুর্নামও আছে তার। তার বাড়ি পাহারা দেয় বেশ কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড। বোঝাই যাচ্ছিল ব্যাপারটা বেশ বিপদজনক। কি করা যায় তারই আলোচনা চলছে। তখনকার দিনে তো আজকের মত জামার বোতাম, পেন বা চশমার মধ্যে লুকানো ছোট্ট ক্যামেরা ছিল না। তাই কাজটাও কঠিন। ঠিক হল দুটি দলে ভাগ হয়ে আমরা যাব। একটি দল ভিতরে ঢুকবে চাকুরীপ্রার্থী সেজে, অন্য দল বাইরে থেকে কভার করবে, নজর রাখবে। গুলনেহার যেহেতু প্রথম থেকেই পুলিশের সঙ্গে তার যোগাযোগের দাবী করে আসছে, তাই পুলিশকে প্রাথমিক ভাবে কিছু জানানো হবে না ঠিক হল। 

এবারে প্রথম এবং প্রধান সমস্যা ক্যামেরা নেওয়া। বড় ক্যামেরা, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় প্রতি পদে। সকলেই সাইড ব্যাগ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হল। সেই ব্যাগের পাশের দিকটা সামান্য খোলা থাকবে যাতে সেই ফাঁক দিয়ে ক্যামেরায় ছবি তোলা যায়। ছক রেডি। গুলনেহারকে ফোন করা হল চাকরী চাওয়ার কথা বলে। পরের দিন আমাদের সকাল এগারোটা নাগাদ আমাদের যেতে বলা হল। আমার সৈনিকেরা সকাল সকাল হাজির ইটিভি অফিসে। আমাদের রামপুরহাটের প্রতিনিধি আশিস হঠাৎ বলল “পলাশদা আমার মনে হয় তোমার ভিতরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারন টিভিতে তোমায় প্রায়ই দেখা যায়, গতকালও একটা খবরে তোমার পিটিসি ছিল। তাই তোমায় চিনে ফেলার একটা সম্ভাবনা থাকতেও পারে।” আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা যুক্তি যুক্ত। চিনে ফেললে খুব বিপদ। শেষমেশ ঠিক হল আমি বাইরে থাকব একটু দূরে, ভিতরে যাব না। 

সোঁতসাল গ্রামে পৌঁছে আমরা দুটি দলে ভাগ হয়ে গেলাম। কেউ কাউকে চিনি না, এমন ভাবে ওরা দু তিনজন ঢুকে গেল ভিতরে। আমি বাইরে। ওরা ভিতরে ঢুকতেই শুরু হল টেনশন। কি হয়, কি হয়? এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল, লোকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। একটু এদিক ওদিক করছি, এর মধ্যে দুতিনটি বাইক এসে আমায় জরিপ করে গিয়েছে। কাউকে খুঁজছি কিনা সরল ভাবে জেনে গিয়েছে। আমি তো এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি বলে পাশ কাটিয়েছি। প্রায় ঘন্টা খানেক পর মুর্তিমানেরা বেরোতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। 

ভিতরে ওদের কাজটাও আরও কঠিন ছিল। ওদের কাছ থেকেই জানা। প্রথম দিকে কিছু বলতে চাইছিল না। পরে একটু একটু করে সে সবই বলেছে। পুলিশ প্রশাসন মন্ত্রী সব লেভেলেই তার নাকি বেজায় জানাশোনা, চাকরী নাকি হাতের মুঠোয়। আরও নানান কথা। আমাদের তিনটি ক্যামেরায় মিলিয়ে জুলিয়ে প্রায় সবই ক্যাপচার করা হয়েছে। হ্যা ফ্রেম ভাল আসেনি কিন্তু যা আমরা চাইছিলাম তা এসেছে। গুলনেহার নাকি বার বার কথা বলতে বলতে ব্যাগের দিকে তাকাচ্ছিল। তাই মাঝে মধ্যেই ব্যাগগুলিকে সামলাতে গিয়ে অনেক সময়েই ক্যামেরার ফ্রেম গন্ডগোল হয়ে যায়। তবে খুব অসুবিধে কিছু হয়নি। আসলে এর আগে তো স্টিং অপারেশন তেমন একটা হয়নি, তাই গুলনেহারও অতটা ভেবে উঠতে পারেনি। 

ফিরে আসা হল। সেই দিনই ইটিভিতে বড় করে খবরটি দেখানো হল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার পুলিশ কিন্তু নির্বিকার। আমরা পরের দিন পুলিশ সুপারের বাইট নিলাম, তিনি বিষয়টা দেখা হচ্ছে বলেই এড়িয়ে গেলেন। অথচ জেলা জুড়ে খবরটি রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছে। সর্বত্র আলোচনা, শুধু পুলিশের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। সেটা নিয়েও খবর করলাম আমরা। দুদিন পরে হঠাৎ ফোন করলেন গৌতম মোহন চক্রবর্তী, আইজি পশ্চিমাঞ্চল। গৌতমদার সঙ্গে আমার আগে আলাপ ছিল, তিনি খবরটা দেখে আমায় ফোন করেন।দুর্গাপুরে তার অফিসে যেতে বলেন। দুর্গাপুরে গেলে লোকাল পুলিশের ভুমিকা কি জানতে চান? আমি জানালাম পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশের কথা স্পষ্ট জানিয়েছে গুলনেহার, তার পরেও পুলিশের এই নিঃস্পৃহতা সেই দাবীকেই শক্ত করে। গৌতমদা বললেন একটু দাঁড়াও, রাইটার্স থেকেও খবরটি নিয়ে একটা চাপ তৈরি হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর পিএর নাম নিয়েছেন ওই মহিলা, আমরা দেখছি। অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত করানো হবে। পরের দিনই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন দুর্গাপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চতুর্বেদি। তাঁকে এই তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। সদ্য আইপিএস সুমিত তরতাজা যুবক, আমাদের অফিসে এলেন পরদিন। কথা বলে সাধুবাদ জানিয়ে শুরু করলেন তদন্তের কাজ। অদ্ভুত ব্যাপার এর পরেই গ্রেফতার করা হল গুলনেহারকে। সেদিন থানায় ডাকা হয়েছিল আমাকেও, সুন্দরী গুলনেহার পুলিশের সামনেই হুমকি দিয়েছিল আমাকে বা আমাদের দেখে নেওয়ার। এখনও সে জেলেই আছে বলে শুনেছি। 

এটাই বাংলা খবরে প্রথম স্টিং অপারেশন সে কথা আমি বলব না, তবে একেবারে প্রথমদিকের স্টিং অপারেশন সে কথা বলাই যায়। খুব কষ্ট করে, বেশ ঝুঁকি নিয়ে এই কাজটা করা হয়েছিল। এতে অবশ্য আমার চাইতে আমার সহকর্মীরা বেশি কৃতিত্ব পাওয়ার অধিকারি। আশিস মণ্ডল, রথীন সেন, পরিতোষ দাস, দীনবন্ধু দে, সঞ্জয় চক্রবর্তী, সুপ্রতিম দাস এরা সকলেই নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিল। এত বছর পরে এরা সকলেই এখন প্রতিষ্ঠিত নিজেদের কাজের সুবাদেই। তবুও আমার তরফে ধন্যবাদ ও ভালবাসা আবার সকলকে। আমার মনে রাখার মত খবরের তালিকায় এটিও একটি উজ্জ্বল তারা। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Sting operation)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours