পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

সাংবাদিকতার চাকরিতে আমি তখন নবীন। ছ'মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ইটিভিতে প্রবেশনে কাজ যোগ দিয়েছি মাস পাঁচেক হল। এমন সময়েই লোকসভা নির্বাচন ১৯৯৯। তখন তো এত টিভি বা মিডিয়ার জঙ্গল নেই। তাই শান্তিপূর্ণভাবেই সব পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আশিস ঘোষ আমাদের সেনাপতি। আমরা এক ঝাঁক তরুণ তুর্কি তার নির্দেশ মত প্রথম নির্বাচন কভারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইটিভির স্কুলিং ছিল অসাধারণ, অনবদ্য। আশিসদারা সেই সময় ভেবেওছিলেন খুব আন্তরিক ভাবে নিজেদের মত করে। মালিকদের অকারণ হস্তক্ষেপ, পয়সার টানাটানি বা সময়ের অভাব এসব নিয়ে ভাবতে হত বলে মনে হয় না। স্বাধীন ভাবেই ভাবনাচিন্তা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন তারা। তাই তো আমাদের প্রশিক্ষণে রাজনৈতিক পাঠ দেওয়ার জন্য অফিসে এসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, বিমান বসু, গীতা মুখোপাধ্যায়ের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। এসেছিলেন পুলিশ বা প্রশাসনে থাকা কর্তা ব্যক্তিরা। যা এখনকার টিভি চ্যানেলগুলির কর্তা বা মালিকরা ভাবতেই পারেন না। যাই হোক ভোটের নানা দিকের কথা, সম্ভাবনা, আশঙ্কা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যদি নিয়ে বড়রা মাঝে মধ্যেই বসতেন আমাদের সঙ্গে। 

শুরু হচ্ছে ভোটের প্রচার। কলকাতার মধ্যে নানা প্রচারে যাচ্ছি আমরা। কখনও আমি একা কখনও বা আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে। তখনও ইটিভি বাংলা আসেনি। বড় খবরগুলি যাচ্ছে ইটিভি তেলুগুতে। এর মধ্যে শোনা গেল প্রমোদ মহাজন আসছেন প্রচার করতে। মহাজন তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপির অন্যতম প্রধান মুখ। আমার ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ল প্রমোদ মহাজনের সভা কভার করবার। সভা হবে বহরমপুর।

তখনও এখনকার মত এত হেলিকপ্টারের চল হয়নি। কথা হল কলকাতা থেকে প্রমোদ মহাজনের কনভয়ের সঙ্গেই যাবে আমাদের গাড়ি। গোটা যাত্রাটাই কভার করা হবে। আমার সঙ্গে আরও একজন ছিল। আমরা দুজনে খুব উত্তেজিত, কলকাতার বাইরে সেই প্রথম নিউজ কভারে যাচ্ছি আমরা। সেই মত সকাল সকাল অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম আমরা। একটু এগিয়ে গিয়ে বারাসতের কাছে দাঁড়ালাম, যাতে কনভয়কে ধরে নিতে পারি।  কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল কনভয়, পিছু নিলাম আমরা। এখন যেমন প্রতি ১০০টি গাড়ির মধ্যে ৫০টিতেই প্রেস স্টিকার লাগানো থাকে, তখন ব্যাপারটা এমন ছিল না। তাই প্রেসের গাড়ি দেখে কনভয়ে ঢুকে যেতে অসুবিধা হল না। পথিমধ্যে একটা রেলগেটে থামল গাড়ি, ট্রেন আসতে কিছু সময় দেরি আছে, সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। প্রমোদ মহাজনের গাড়ির কাছে গিয়ে ডাকলাম তাকে। ছুটে এল কম্যান্ডোরা, কিন্তু প্রমোদবাবু হাত নেড়ে চলে যেতে ইশারা করলেন ওদের। গাড়ির কাঁচ নামালে জানালাম ওঁর নির্বাচনী প্রচার কভার করতে যাচ্ছি আমরা। আগে কিছু কথা বলে নিতে চাই। উঠিয়ে নিলেন গাড়িতে। কি কি জানতে চাই ভাল করে শুনলেন। পাশাপাশি আমার কাছ থেকেও বাংলার কিছুটা চিত্র নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমি তখন সদ্য সাংবাদিক, তার মত ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কতটা বলব বা কি বলব সেটাই ভাল করে যেন গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না। বিষয়টা বোধহয় আন্দাজ করলেন মহাজন। আমাকে বললেন ঠিক আছে, দুপুরে সার্কিট হাউজে থাকব আমি সেখানেই কথা হবে। 

নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। নামার সময় আমাকে বলে দিলেন “শুনিয়ে আজ আপ হামারা মেহমান হ্যায়, আপ ভি সার্কিট হাউজ মে হি চলিয়ে, খানা খা কে ওহিপে বাত করেঙ্গে। ফির একসাথই র‍্যালি মে চলে যায়েঙ্গে।” সঙ্গে থাকা পি এ-কে বলে দিলেন যাতে আমাদের কোনও অসুবিধা না হয়। আমাদের গাড়িকে ঢুকিয়ে নিলেন কনভয়ের মাঝে। সার্কিট হাউজে পৌছেও কিন্তু আমাদের খেয়াল রেখেছেন অনবরত। অন্য সাংবাদিক কাউকে দেখিনি। সভাস্থলে কয়েকজন ছিল অবশ্য কিন্তু সার্কিট হাউজে শুধুমাত্র আমরাই। খাওয়া হয়ে গেলে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎকার দিলেন। ততক্ষণে প্রশ্ন বা বিষয় ঠিক হয়ে গিয়েছে। চলল আড্ডাও, বললাম ৮৬ সালে আমার মা বিজেপি-র হয়ে একবার পুরনির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তখন বাংলাতে বিজেপি-র নামই সেভাবে কেউ শোনেনি। কিন্তু মায়ের জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক, তাই অন্য প্রার্থীদের আবদারে শেষ পর্যন্ত নাম প্রত্যাহার করে নেন মা। এ কথা শুনে বেজায় খুশি মহাজন। খুব দুঃখ পেলেন নাম তুলে নেওয়ার কথা শুনে। জানালেন মা রাজি থাকলে ফের যে কোনও নির্বাচনে দাঁড়াতে বলুন আমি সুপারিশ করব নাম। মা অবশ্য বিজেপি কর্মী ছিলেন না তাই ফের নির্বাচনে আর দাঁড়াতে চাননি। কিন্তু প্রমোদ মহাজন বেজায় খুশি, আমার আদর যত্ন আরও বেড়ে গেল যেন। বিকেলে সভায় দেখলাম বেশ ভিড়। বহরমপুর তখনও অধীরগড়, সিপিএমের জমানা। তবুও বিজেপি কর্মী সমর্থক দেখলাম সেই সময়েও ভালই ছিল। সে বারে অবশ্য বিজেপি বাংলা থেকে দুটি আসন জিতেছিল। 

ফেরার সময়েও আমাদের অভিভাবকের মত গার্ড করেই নিয়ে এসেছিলেন মহাজন। ভাল লেগেছিল, অত বড় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আমার মত একজন নবিশ সাংবাদিককেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন দেখে। কি খেলাম, কখন খেলাম, কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা সে সবই খেয়াল রেখেছেন নানা ব্যস্ততার মাঝেও। এখন যেটা দেখাই যায় না। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছুটা এই গুণ আছে। তিনিও সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের খেয়াল খবর রাখেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি চিনি যখন তিনি কংগ্রেস নেত্রী। পরে আলাপ বেড়েছিল বিরোধী দলনেত্রী হওয়ার পরে। সে গল্প আর একদিন করব।

(www.theoffnews.com - Pramad Mahajan)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours