পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

(মৃত্যুর মুখোমুখি)

শালের জঙ্গলে বসন্তের ছোঁয়া। নিচে ঝরা পাতার ধুসরতা, উপরে সদ্য গজানো কচিপাতার আদুরে উল্লাস। হাঁটলেই শুকনো পাতার মড়মড়ে আওয়াজ। তাই পাতা এড়িয়ে খুব সন্তপর্ণে এগোচ্ছি আমরা। এদিক ওদিক থেকে সামান্য আওয়াজ হলেই চমকে চমকে উঠছি। যেতে হবে আরও মাইল খানেক। মাথার উপরেই ঝটাপটির আওয়াজ, বাপরে বলে আঁতকে উঠল আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান। আমিও ছিটকে গিয়ে উপরে তাকাতেই দেখতে পেলাম গোটা চারেক বাঁদর। একটু যেন নিশ্চিন্ত হলাম। যাক অন্য কিছু নয়। পা চালিয়ে চল্, সঙ্গীকে বলে সামনে এগোতেই খালি হয়ে গেল বুকটা। শ পাঁচেক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যু। এদিকেই মুখ করে নিশ্চল। একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। আমরা দুজনেই পাথর, নিজেদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ নিজেরাই পাচ্ছি আমরা। প্রায় ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ড পর বুঝলাম তার চোখ সরাসরি আমাদের দিকে নয়। বরং আমাদের ছাড়িয়ে আরও খানিকটা গিয়ে নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। সে কি দেখছে তা দেখার চেষ্টা না করে সঙ্গীকে খুব নিচু গলায় বললাম পাশের দিকে এগিয়ে চল। বড় গাছটার আড়ালে যা। চোখ না সরিয়ে ধীরে ধীরে বড় একটা শাল গাছের আড়ালে যেতেই নজরে এল দৃশ্যটা। তারপরে আরও একবার ঠান্ডা স্রোত। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার একশো ফুট দূরে পিছনেই ফনা তুলে আরও এক সাক্ষাৎ মৃত্যু। আমরা তো হাঁটতে হাঁটতে ওখান দিয়েই এসেছিলাম… 

কি ভাবে সেদিন প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছিলাম মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে ফেরবার খুব একটা কথা ছিল না। এটাও বছর কুড়ি আগেকার কথাই। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের কাছে একটি গ্রামে হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। পাঞ্চেত বনবিভাগের ডিএফও-কে ফোন করতেই তিনি জানালেন অবস্থা বেশ খারাপ। হাতিটি প্রায় পাগল হয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তিন জন নয় ইতিমধ্যেই সে চার জনকে হত্যা করেছে। সকলেই নিরীহ গ্রামবাসী। বনের মধ্যে প্রত্যন্ত সেই সব গ্রাম। বনকর্মী বা হুলা পার্টিরা চেষ্টা করছে হাতিটিকে তাড়ানোর। কিন্তু তার দেখা পাওয়া মুশকিল। দুস্কর্ম সেরেই সে লুকিয়ে পড়ছে বনের গভীরে। 

পরের দিনই পৌঁছলাম বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সেই গ্রাম। সেখানে যাওয়ার কোনও বন্দোবস্ত নেই। ডিএফও বলেই দিলেন ওখানে না যাওয়াই ভাল। কখন কি হয় বলা মুশকিল। গাড়ি কেউ যেতে রাজি নয়, কিভাবে যাওয়া যায় সেটাই ভাবছি। এমন সময় এগিয়ে এলেন স্বপনদা। স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি একসময় আজকালে ছিলেন কলকাতায়, পরে অবশ্য ইটিভি এবং আনন্দবাজারের বাঁকুড়ার প্রতিনিধিও হন। তো স্বপনদার একটি বাজাজ এম এইটটি স্কুটার ছিল। তাতে করেই তিনি আমাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছে দিতে রাজি হলেন। তবে পৌঁছে দিয়েই চলে আসবেন জানালেন। আমরা তাতেই রাজি। ডিএফও বললেন ওখানে একটি ছোট্ট ক্যাম্প অফিস মত আছে সেখানে আপাতত দু তিনজন আছেন তবে রাতে তারাও থাকবেন না। যাওয়া হল সেই ক্যাম্প অফিসেই। বিষ্ণুপুরের জঙ্গলের মাঝে একটা পরিত্যক্ত রানওয়ে আছে তা জানলাম সেই দিনই। 

যাই হোক কোনও মতে স্কুটারে চেপে তো যাওয়া হল। গিয়ে দেখা গেল ক্যাম্প অফিসের কর্মীরা এতটাই ভয়ে আছেন যে পারলে তারা তখনই শহরে ফিরে যান। শোনা গেল খুনে হাতি কাছেই একটা গ্রামে ফের হামলা চালিয়েছে। মারা গেছে আরও একজন। কাছে মানেও তা প্রায় তিন চার কিলোমিটার হবে ওদের একটা গাড়ি ছিল, তাতেই যাওয়া হল। গ্রামে যেতেই ছুটে এল সকলে। একটাই কথা হাতিকে মেরে ফেলতে হবে। তখনই বনকর্মীদের কাছে শুনলাম কলকাতা থেকে হাতি মারতে শিকারি আসছে। একটু আড়ালে গিয়ে একজনকে চেপে ধরতেই স্বীকার করলেন তিনি, সত্যিই সুব্রত পাল চৌধুরীর আসার কথা কলকাতা থেকে। কাল ভোরেই এসে যাবেন তিনি। ব্যস এবার আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জানিয়ে দিলাম আমরা আজ থেকেই যাব এখানে। কাল হাতি মারা দেখে ফিরব। বনকর্মীরা তো শুনেই আঁতকে উঠলেন। খেপেছেন নাকি? এখন ফিরে চলুন কাল আবার আসা যাবে। কিন্তু আমি বেশ বুঝে গিয়েছি একবার এই বন থেকে বেরলে ফের আসা খুব কঠিন। বন দফতরও এলাও করবে না। তাই স্রেফ জেদ ধরে বসে গেলাম রাতে এই ক্যাম্প অফিসেই থাকছি। আপনারা যান। ওয়াকিটকিতে ডিএফও-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। তিনিও অনেক বোঝালেন, তবে তখন তো সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের একটা অন্য সমীহ ছিল তাই খারাপ ভাবে অতি জোরাজুরি করলেন না। বরং একটু সাহায্যই করলেন। বললেন ‘ঠিক আছে, আপনাদের সঙ্গেই ওই বনকর্মী দুজন থেকে যাবেন। বাকি কাছাকাছির গ্রামে হুলা পার্টিরা থাকছে, কাল সকালে আমরা এখান থেকে যাব’। 

বনকর্মী দুজনের মুখ তো দেখার মত। আমাকে পারলে তখনই হাতির মুখে ছেড়ে দেন আর কি। আমি ওদের দিকে তাকাচ্ছিইই না। বরং এবার মনে হল কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু এখানে খাবারের কোনও যোগাড় নেই। ওরা টিফিন নিয়ে এসেছিলেন তা শেষ। কুয়োর জল আছে খাওয়ার জন্য। অগত্যা তাই খেয়েই সেই দিনটা কাটিয়ে দিলাম আমরা। একটাই তো রাত। রাতটা অবশ্য স্মরণীয় তার গা ছমছমে সৌন্দর্যের জন্য। ঘন জঙ্গলের ভিতরে ওই ভাবে রাত কাটানো, সেটাই প্রথম অভিজ্ঞতা আমার। বাতাসের নিজস্ব শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকার আবহ, মাঝে মধ্যে বন্য জন্তুদের অচেনা আওয়াজ। এক সময় একটু যেন ভয় ভয়ই করতে লাগল। যাই হোক কাটিয়ে দিলাম সে রাত। পরের দিন সকালে একটা ছোট্ট দুঃসংবাদ। শিকারি আসবেন আগামী কাল। ব্যস আজ আর কিছুই করার নেই। সব থেকে যেটা সমস্যার সেটা হল খাবার। কাছের গ্রামটি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। সেই গ্রামে গিয়ে দেখলাম একটাই দোকান সেখানে। কিছুই প্রায় নেই, সামান্য একটু চাল, ডাল, খুব শুকনো দু তিনটি আলু পাওয়া গেল। আর একটু মুড়ি এবং গাড় হলুদ রঙের অদ্ভুত এক চানাচুর নেওয়া হল, সঙ্গে একটা করে লাড্ডু। কোনও রকমে দুপুরে সেই সিদ্ধ ভাত খাওয়া হল। দুপুরে খেয়ে বনকর্মীরা একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেই ফাঁকে আমরা জঙ্গলের ভিসুয়াল নিতে বেরিয়েছি। ঘন্টা খানেক ঘুরে ফিরবার পথে ওই কাণ্ড। 

সামনে দাঁড়িয়ে বহু প্রতীক্ষিত সেই খুনে দাঁতাল। যার নামে পাঁচ পাঁচটি খুনের পরোয়ানা রয়েছে। হঠাৎ করে সামনে খুনি হাতিকে দেখে ক্যামেরা তাক করতেও ভুলে গেছি আমরা। ত্রিসীমানায় কেউ নেই। আমাদের কিছু হলে সাহায্য পাওয়ারও কোনও আশা নেই। কিন্তু অবাক হলাম দাঁতালের ভাবভঙ্গি দেখে। কেমন যেন উদাসী বাউলের মত; দেখছে, কিন্তু দেখছে না। পরে বুঝলাম ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় আমাদের থেকেও বিপদজনক কিছু খুঁজে নিয়েছে। তাই ওই বিষধর সাপটির অস্তিত্বের কথা আমরা না বুঝলেও ঠিক বুঝেছিল হাতিটি। আমাদের কি তাই ছেড়ে দিল নাগালে পেয়েও? 

সম্বিৎ ফিরতেই এবার পালানো পালা। কিন্তু আমাদের ক্যাম্প তো সামনের দিকে, যে দিকে হাতি দাঁড়িয়ে। অনেকটা ঘুরে যেতে হবে তাই করলাম। সন্তপর্ণে যতটা আওয়াজ বাঁচিয়ে চলা যায়, সেভাবে বেশ খানিকটা এগোতেই দেখি আমাদের খোঁজে দুই বনকর্মী আসছেন। তাদের দেখে একটু প্রাণ এল ধড়ে। ঘটনার কথা বলতেই তাদের মুখও দেখালাম সাদা, বললেন অলৌকিক উপায়ে রক্ষা পেয়েছেন। রাতের বেলা সেদিন ওই মুড়ি আর হলুদ চানাচুর দিয়েই ডিনার সারা হল। লাড্ডুটায় এতটাই তেলচিটে গন্ধ, যে মুখে দিয়েই ফেলে দিতে হল। 

পরদিন এলেন শিকারি। শুরু হল অভিযান। সেদিনও মিলল না সেই দাঁতাল। তবে কেন জানি না আমার খালি মনে হচ্ছিল দাঁতালটিকে না পেলেই ভাল হয়। কাছ থেকে দেখে আমার তো অন্তত ওকে খুনে বলে মনে হয়নি। তাই যে হাতির শিকার দেখব বলে জেদ ধরেছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম, ক্রমশ যেন তা না দেখার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠছিল। চাইছিলাম না অমন জলজ্যান্ত একখানি প্রাণীকে হত্যার সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে। কলকাতায় ফোন করে অনুমতি নেওয়ার উপায় নেই, জঙ্গলে টাওয়ার অমিল। ফেরবার ইচ্ছাপ্রকাশ করতে অবাক ডিএফও, বললেন এত দিন এত কষ্ট করে ছিলেন এখানে, আর এক দুদিন দাঁড়ালেই তো কাজ হয়ে যেত। কিছু বলিনি, সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে এলাম বিষ্ণুপুরে। অফিসকে জানিয়ে দিলাম আর থাকতে পারছি না। আমার বসও কি বুঝেছিলেন জানি না, তবে জোর করেননি।

সাংবাদিক জীবনে পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে এটা একটা ব্যর্থতা, অনস্বীকার্য। যে কাজ করতে গিয়েছিলাম, তা অসম্পূর্ণ রেখেই চলে এসেছি। কিন্তু আমি মনে করি যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে অথবা প্রাণ নেয়নি তার প্রাণ নেওয়াটা উল্লাসভরে দেখাটা আমার কাছে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। পরে জেনেছি ওকে মারা হয়েছিল দিন দুয়েক পরে। ঘুম পাড়ানি গুলি করে, পরে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দিয়ে। কিন্তু আমি যাইনি, স্থানীয় ক্যামেরাম্যানকে বলে ফলো আপ স্টোরিটা করিয়েছিলাম। তাই তো সাংবাদিকতার জীবনে সব গল্পই সফল হয় না; কিছু কিছু ব্যর্থতার কাহিনীও আসে বৈকি। কিন্তু সেই ব্যর্থতার গল্পগুলিও মাঝে মধ্যে তৃপ্তি জাগায় মনে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - elephant)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours