পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

রাত প্রায় দশটা, শুনশান সিটি সেন্টার। দুর্গাপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্র তখনও এমন জমজমাট নয়। শপিং মল  তো দূরের কথা সাতটায় শিলিগুড়ির শেষ বাসটা চলে যেতেই নিথর গোটা চত্বর। মূলত অফিস পাড়া, তাই এমনিতেই সন্ধ্যার পর জনসমাগম কম, তার উপরে অক্টোবরের এই শেষ দিকে ঠান্ডাও পড়ে গিয়েছে। নিঝুম সিটি সেন্টারে সকলে চলে গেলেই বাসস্ট্যান্ডে সঞ্জয়ের চায়ের দোকানে বসত আমাদের আড্ডা। শুধু সাংবাদিক নয় নানান পেশার নানান ধরনের বা বয়সের মানুষেরা ওই আড্ডায় আসতেন। দুই তিন ঘন্টা জমাটি আড্ডা হত। সেই আড্ডা থেকেই ফিরছি, পায়ে হেঁটে। এমন সময় মোবাইলে ফোন, দেখলাম সদ্য আলাপ হওয়া এক পুলিশ আধিকারিক। কিন্তু তখন মোবাইল ধরলেই সাড়ে আট টাকা দিতে হত। বাড়ির কাছেই এসে গেছি। কেটে দিয়ে বাড়িতে ঢুকেই ফোন করলাম, কি ব্যাপার এই মাঝ রাতে কেন? চাপা উত্তেজনা গলায় উত্তর এল শিবপুরে মার্ডার হয়েছে, বেশ উত্তেজনা। চলে আসুন এখনও বডি পড়ে আছে। 

দুর্গাপুরে আমি তখন নতুন এসেছি, ভাল করে সব দিক চিনিও না, তার উপরে এমন ঠাণ্ডার রাত। কি করি? সদ্য চেনা কয়েকজন খবরের কাগজের সাংবাদিকদের ফোন করলাম। টিভির সাংবাদিক আমি ছাড়া আর নেই বললেই চলে। কিন্তু কাগজের সকলেরই প্রায় এক কথা, আমাদের এত রাতে গিয়ে কোনও লাভ নেই, আজ আর পাঠানো যাবে না, যা হবার কাল সকালেই দেখা যাবে। কিন্তু আমি তো তখন নবীন, ফোন করলাম আমার তৎকালীন বস আশিস ঘোষকে। আশিসদা প্রায় সব কিছুতেই যেতে বলেন, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। বললেন “এখুনি বেরিয়ে যা, এমন ব্যাপার হাতছাড়া করা যায় নাকি”? এসব করতে করতেই প্রায় এগারোটা। ডাকলাম আমার সদ্য নিযুক্ত ক্যামেরাম্যান সঞ্জয়দাকে। সঞ্জয়দাও তখন নতুন কিছু করবার উত্তেজনায় ফুটছে। বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। সঞ্জয়দার একটা স্কুটার ছিল বাজাজের। তাই নিয়ে রওনা দিলাম দুই মুর্তি। সঞ্জয়দার কাছেই শুনলাম শিবপুর জয়দেবের দিকে, অজয়ের ধারে একটা গ্রাম, রাস্তায় নাকি জঙ্গল আছে। কি আর করা। আমি পিছনে বসে আছি ঢাউস ভিএইচএস ক্যামেরার একটা সুটকেস ধরে। স্কুটার চালাচ্ছে সঞ্জয়দা।

মুচিপাড়া থেকে বাঁ দিকে বেঁকে যেতেই মুছে গেল সব আলোর রেখা। শুরু হল অসম্ভব খারাপ একটা রাস্তা। সঞ্জয়দার স্কুটারের হেডলাইটের আলো দেখার জন্য বোধহয় আর একটা আলো আনলে ভাল হত মনে হচ্ছে। কোনও রকমে গোত্তা খেতে খেতে দুই মক্কেল চলেছি। কয়েকদিন আগেই লোকসভা ভোট মিটেছে, এই খুন কি তারই ফল? ভাবতে ভাবতে বড় একটা গর্তে পড়ল গাড়ি, বিষম একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আঁক করে একটা আওয়াজ করে প্রায় উল্টে পড়লাম আমি। স্কুটারও গেল থেমে। গতি কম ছিল বলে তেমন ব্যাথা লাগেনি। সঞ্জয়দা আমাকে তুলে স্কুটারটাকে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে কাত করে আবার কোনও রকমে স্টার্ট দিল। ত্রিসীমানায় কোনও আলো নেই। ঠান্ডাও বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়াতে আবছা আবহ পাচ্ছিলাম জঙ্গলের। নীরব নিথর আবহে স্কুটারের আওয়াজটা যেন বিকট লাগছিল এক এক সময়। প্রাণ হাতে করে এগোচ্ছি ওই খানা খন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে, হঠাৎ সামনে কয়েকটা টর্চের আলো একটু প্রাণ এল বুকে। পুলিশ বুঝি। কাছে যেতেই ভাঙল ভুল, মুখে কাপড় বাঁধা কয়েকজন রাস্তা আটকে। হাতে সকলেরই অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র। স্কুটার থামতেই কাছে এসে শীতল গলায় প্রশ্ন “কে আপনারা? কোথায় যাচ্ছেন”? বললাম “আমরা সাংবাদিক, একটা কাজে যাচ্ছি”। ছুটে এল প্রশ্ন, “এখন কি কাজ? এখানে সব ঠিক আছে”। মনে মনে একটু ভয় পেয়েছিলাম বৈকি, কারন এখানে কিছু হলে সাহায্য পাওয়ার কোনও আশাই নেই। মুখে বললাম “সেটাই দেখে আসি তাহলে”। এবার একটু অধৈর্য হয়েই এগিয়ে এল একজন। “তখন থেকে বলছি চলে যেতে এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে”। সঞ্জয়দা আমার হাতটা একটু শক্ত করে ধরল। আমি বললাম “আমরা সাংবাদিক আমাদেরকে তো কেউই আটকায় না, আমরা কোনও পক্ষেরই নই। তাই একটা খুন হয়েছে সেটা দেখেই চলে যাব”। “যে খুন হয়েছে সে ভাল লোক ছিল না। এবারে না গেলে আপনাদের কিন্তু জঙ্গলে নিয়ে যাব” বলেই একজন এগিয়ে স্কুটারের হাতলটা ধরেছে। সত্যি সত্যিই টান পড়ল স্কুটারে, আর একজনের হাত সঞ্জয়দার ঘাড়ে, আমরা অসহায়। এমন সময় গায়ে পড়ল একটা গাড়ির হেড লাইট।

আলো পড়তেই ম্যাজিক, উধাও সেই মুখ ঢাকার দল, যারা আমাদের জোর করে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আমাদের মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়িটি থেমে গেল। গাড়ি থেকে নেমে এলেন এক যুবক, পুলিশের বড় কর্তা পোষাক দেখেই বোঝা যায়। হালকা আলোয় বেশ অল্প বয়স্কই মনে হল। ভাঙা বাংলায় বললেন কি হয়েছে? সব শুনে বললেন ভালই হল আমিও ওদিকেই যাচ্ছি, আমার ড্রাইভারেরও রাস্তাটা খুব ভাল জানা নেই, চলুন আমার সঙ্গে। বাকি ওদের এখন ছেড়ে দিন কাল সকালে দেখে নেব। ওদের গাড়ির আগেই যেতে লাগলাম আমরা। প্রায় এসকর্ট করে আমাদের একেবারে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেল পুলিশের সেই গাড়ি। আমরা বা পুলিশের গাড়ি পৌঁছতেই শশব্যস্ত ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশকর্তা বা কর্মীরা। সেই চেনা পুলিশ কর্তাটি যিনি আমাকে খবর দিয়েছিলেন তিনি আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে বললেন করেছেন কি? খোদ বড় সাহেবকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন? বড় সাহেব মানে পুলিশ সুপার? বর্ধমান তখনও ভাগ হয়নি তাই বর্ধমান থেকেই ছুটে এসেছেন। আমার অবশ্য তাতে একটা বড় উপকার হয়েছে, না হলে ওই সময় এসপি সাহেবের গাড়ি না এসে পড়লে এতক্ষণে কি যে হত কে জানে? 

গিয়ে দেখলাম একজন সিপিএমের স্থানীয় নেতা খুন হয়েছেন, এতদিন পরে নামটা আর মনে নেই। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হল জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর কাজ হতে পারে। জনযুদ্ধ আজকের মাওবাদীদের পুরনো নাম। তাহলে আমাকে যারা জঙ্গলে ধরেছিল তারা ওদের দলেরই কেউ? নাকি অন্য কেউ বা কারা? দলীয় কোন্দলও তো হতে পারে? নানা প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছিল নবীন সাংবাদিকের মনে। আলো তেমন নেই, এসপি-র গাড়ির আলোতেই শুট করা হল। বাইট নেওয়া হল এসপি-র। কাজ শেষ হলে ফিরে যাব ভাবছি, এমন সময় বড় সাহেবের ডাক। বললেন – “ফিরবেন তো? আমার সঙ্গেই চলুন। না হলে আবার সমস্যা হতে পারে। কিছু পুলিশ সঙ্গে নিয়ে নিচ্ছি। এত রাতে এমন ভাবে চলে এসেছেন দুজনে, দেখে তো আমার অবাক লাগছে। আপনি আমার গাড়িতে উঠে আসুন, রাস্তা ভাল না। মুচিপাড়ায় গিয়ে ছেড়ে দেব।” উঠে পড়লাম গাড়িতে সঞ্জয়দা স্কুটার নিয়ে আগে চলেছে। আবার সেই অরণ্য সঙ্কুল রাস্তা। এসপি সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগোচ্ছি। কোথায় থাকি, বাড়ি কোথায়, ইত্যাদি নানা কথা। এত অল্প বয়সেই এই পেশায় চলে এসেছি, কেমন লাগছে জিজ্ঞাসা করলেন। নিজের নানা কথা বলার পর বললেন “আমার তো বদলী হয়ে গিয়েছে কাল বা পরশু চলে যাব। আগের রাতেই এই কাণ্ড। যাই হোক আপনার সঙ্গে আলাপ হল, ভাল থাকবেন।” আমিও মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে ভাল থাকার বার্তা দিলাম। বললাম “আপনিও তো এত রাতে ছুটে এসেছেন, চলে যাওয়ার আগের দিনে। ভাল লাগল দেখে”। মুচিপাড়ায় গাড়ি থেকে নামার সময় আমাকে বললেন “এই পেশায় যখন এসেছেন তখন হয় তো আবার দেখা হবে। অনেক রাতের আলাপ তো, মনে থাকবে বহুদিন”। আমিও সায় দিলাম, “ঠিক বলেছেন, পরে দেখা হলে মনে করিয়ে দেব আপনাকে কিন্তু”। হেসে বললেন তাই হবে। চলে গেল এসপি সাহেবের গাড়ি। আমি সঞ্জয়দার স্কুটারে চেপে বাড়ির দিকে...

সেদিনের সেই এসপি-র সঙ্গে আমার আর সরাসরি দেখা হয়নি। কিন্তু তিনি বিখ্যাত পুলিশ আধিকারিক হয়েছেন। তার বাইট নিয়ে আমার কাছে এসেছে জুনিয়র রিপোর্টাররা। বিভিন্ন মহলে, সংবাদ মাধ্যমে তার নাম, সুনাম অথবা দুর্নাম। সম্প্রতি সিবিআই এর সঙ্গে বিবাদে তিনি আলোচনার শীর্ষে। আমার কিন্তু মানুষটিকে ওই কয়েক ঘন্টার আলাপে ভালই লেগেছিল। বছর কুড়ির আগেকার কথা, তবুও স্পষ্ট মনে আছে ওই গাড়ির ছোট্ট আড্ডা, হঠাৎ এসে আমার জীবন বাঁচানো। মানুষটির নাম – রাজীব কুমার, আইপিএস। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - IPS Rajib Kumar)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours