তানজিন তিপিয়া, লেখক ও রন্ধন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ:
মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখিনি। দেখার সেই সাহসও নেই। এই মুহূর্তে যদি যুদ্ধের ডাক আসে হয়তো আমি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ নাও করতে পারি কারণ ইট সিমেন্টের তৈরি সোনার চামচে জন্মে আমি সেই ক্ষেত্রে খুব ভীরু। জীবনের মায়া অভ্যাসে পরিণত এখন। কিন্তু যখন নিজের বাবাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখি তখন খুব বিস্মিত হয়ে শীতল হয়ে যাই ভাবি এই মানুষটি যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের বর্বরতা দেখেছেন। যুদ্ধের মৃত্যুর ভয়কে বাস্তবে অনুভব করেছেন। মানুষ ক্ষুদ্র জীবনে কত কিছুই না করেন।
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা নিজেকে যাহির না করে নীরবে, নিভৃতে সমাজসেবা তথা দুর্বল মানুষের পাশে ছায়া হয়ে থাকেন। তেমনি একজন সাদা মনের মানুষ আমার পিতা আলহাজ আবু মোহাম্মদ খালেদ।
যিনি শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও সংগঠক।
পরিবারের বড় জন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালে আবু মোহাম্মদ খালেদ পরিবারের হাল ধরেন। তিনি শহর ও গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন ও মুক্তিযুদ্ধের সকল সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতার কারণে তাকে অনেক প্রতিকূলতার স্বীকার হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি একটুও ভীরুতার আশ্রয় নেননি। তিনি তৎকালীন গ্রাম রাউজানের সুপরিচিত সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান “জাগরণী” সংস্থার সভাপতি ছিলেন।
এভাবেই একদিন আব্বাকে বললাম- আব্বা মুক্তিযুদ্ধের কোন বিশেষ স্মৃতি থাকলে আমাকে একটু লিখে দিয়েন সময় হলে।
লিখেও দিলেন আব্বা উনার মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা-
"১৯৬৬ সালে সিটি কলেজে পড়া অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হই। প্রাক্তন মন্ত্রী মরহুম এম এ মান্নান সহ ডিগ্রীতে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবী দেন। তখন আমি ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ৬ দফা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ শুরু হয়ে যায় সারাদেশে সেই বর্বরতা। ২৬ শে মার্চ সকালে জীবিকার তাগিদে প্রাণ নিয়ে ৮ ঘটিকায় অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসি এবং দেখি চারদিকে নিঃস্তব্ধ। লোকজন চারদিকে ছুটোছুটি করছে এবং যার যার বাড়ি ঘরের দিকে রওনা হচ্ছে তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমি তখন দি জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিঃ এ অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলাম। অফিসে গিয়ে আমরা কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে আলাপ আলোচনা করে যার যার বাড়ি ঘরের দিকে রওনা হলাম। গাড়ি না চলাতে হেঁটে কালুরঘাট গিয়ে নৌকা যোগে কর্ণফুলী নদী পাড় হয়ে দক্ষিণ রাউজান দিয়ে আমাদের মোহাম্মদপুর গ্রামে পৌঁছলাম।
পরদিন ২৭ শে মার্চ আমার পরিচিত নিজাম উদ্দিনের নেতৃতে ১০/১২ জন ছাত্র আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। আমি আর ওরা সহ রাত্রে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। তাদের সবাইকে রাজাকারদের ত্রিসীমানা থেকে বাঁচিয়ে খাওয়া দাওয়া করিয়ে পরদিন খুব ভোরে ২০০ টাকা দিয়ে ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিই। তারা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফটিকছড়ি দিয়ে রামগড় হয়ে ভারতের দিকে চলে যায়। ওরা আমাকে এখানের সকল দায়িত্ব সঁপে যায়। কয়েকদিন পর দেখি আমাদের হিন্দু বাড়িতে মুসলিম লীগের লোকেরা বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট শুরু করল। হিন্দুরা প্রায় গ্রাম শূন্য হয়ে ভারতে চলে গেল। ইতিমধ্যে মে মাসে পাকিস্তান রেডিও থেকে যার যার কাজে যোগ দিতে এবং দোকান- পাট, অফিস আদালত খুলতে রেডিওর মাধ্যমে প্রচার শুরু করল। ২৫শে মে থেকে আমি কাজে যোগ দিলাম। চট্টগ্রাম এসে দেখি সব হিন্দু বাড়ি ও দোকান পাট লুট হয়ে গেছে। কিছু কিছু বাড়ি ও দোকান মুসলিম লীগের লোকেরা দখল করে রেখেছে। গ্রামে গিয়ে দেখি আমাদের মোহাম্মদপুর গ্রামের মতিলাল শীল ও নতুন চন্দ্র সহ আরো কয়েক জনের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওদেরকে আমি খাওয়ার জন্য তখন ৫০০ টাকা করে দিয়েছিলাম। আমাদের পশ্চিম পাড়ার হিন্দু বাড়ির বিধবা দুলালের মাকে ঘর তৈরি করে দিয়ে খাওয়া দাওয়ার জন্য সকল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। নিজাম ভাই ভারত থেকে কয়েকবার পাকিস্তানী সেনাদের রাউজান ও শহরের মুভমেন্ট এর খবরা- খবর নিত আমার কাছ থেকে। আমি রাউজান, মুন্সীর ঘাটা, সত্তর ঘাট ও হাটহাজারী স্কুলে পাকিস্তানী সেনা অবস্থানের খবরা খবর চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিতাম। পাকিস্তানী সেনারা আমাদের বাস থেকে নামিয়ে পুরো শরীর চেক করত। শহরে গাড়ির মধ্যে বন্দুক তাক করে সেনারা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করত। আমাদের গ্রামের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মুছা ও আমি একসাথে সব সময় থাকতাম। রাজাকাররা যখন জানতে পারলো আমিও মুক্তিযোদ্ধা তখন একদিন ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসে আমাকে আর মুছাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে কাগতিয়া বাজারের পাশে পাকিস্তানী সেনার হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুছা মারা যান। অল্পের জন্য আমি কোনোভাবে বেঁছে যাই। কিছুদিন পর আমি আমার আর মুসার অস্ত্র লুকিয়ে রাখি আর এদিক সেদিক পালিয়ে বেড়াই। এরপর বাড়ি ফিরে দেখি সব দিকে হাহাকার। আমি ডাবুয়া জাফরের কাছে মিলিত হয়ে পাকিস্তানীদের আক্রমণ করার জন্য নতুন করে বৈঠক করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাকিস্তানীদের হাতে জাফরও মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ৫/৬ দিন পূর্বে ভারতীয় আর্মি প্রবেশ করেছে এবং আমাদের দেশের সকল মুক্তি বাহিনীও ভিতরে ঢুকেছে। এরপর তাদের সাথে সাথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দেশ স্বাধীন হল। সকলে ঘরে ফিরে গেল।"
(ছবি সৌজন্যে: বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা আমার পিতার সঙ্গে আমি প্রতিবেদক)
(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours