সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
সেই সকাল থেকেই ভাবছি নববর্ষ নিয়ে কিইবা লিখি। কিন্তু থিম কি বাছবো সেটাই তো ঠিক মনে ধরছে না। অথচ মন তখন থেকেই একটু লিখি লিখি উষ্কানি দিচ্ছে। ওই এসো হে বৈশাখ মার্কা বহুল চর্চিত অআকখ চর্চা আর ভালো লাগছে না। চিন্তার জট আর কলমের অতি উৎসাহের দ্বন্দ্বে আমি যেন ক্রমেই স্যান্ডউইচ বনে গেছি। এমনই সময় ইউরেকা বলে মনমন্থনে যেন আচমকা সুনামি বয়ে গেল। পেয়েছি পেয়েছি নববর্ষের মিল গ্যায়া থিম।
গত সপ্তাহে আমার এক বাংলাদেশের বন্ধু তার ফেসবুক ওয়ালে একটা পোস্ট দিয়েছিল। আমিও তাতে যথারীতি কমেন্ট করি। আসলে তার পোস্ট আর আমার কমেন্ট--দুটি ক্ষেত্রেই ছুঁয়ে গেছে নববর্ষের প্রসঙ্গ। তাই মনে হল আচ্ছা তার পোস্ট আর আমার কমেন্টটাই তো আমার আজকের লেখার উপপাদ্য যদি হয় তবে আপত্তি কোথায়?
যেই ভাবা সেই কাজ। নীতিগত প্রশ্নে সকালেই তার পোস্ট আমার লেখার জন্য ব্যবহার করবো কিনা বন্ধুর কাছে অনুমতি চাইলাম। উদারচেতা বন্ধুটি আমার, শত ব্যস্ততার মধ্যেই আমাকে সদর্থক উৎসাহ দিলেন ক্ষাণিক পরেই। একইসঙ্গে উনি বললেন, পোস্টটা আসলে হুমায়ূন আজাদ স্যারের একটা উক্তি। আমি বললাম নো প্রবলেম।
আমার প্রিয় বন্ধুটির পোস্টটা ছিল এরকম,
"একজন বাঙালি একই সাথে ধর্ম চায়, মদ চায়, নারী চায়, জুয়া খেলতে চায়, শিক্ষা চায়, আধুনিকতা চায়, যৌতুক চায়, পয়লা বৈশাখ চায়, ইসলামি রাষ্ট্র চায়, এরকম ভন্ডামি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।"
এই পোস্ট পড়ে আমিও কমেন্টটি দিই তাকে গভীর রাতে। পোস্টের প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ধরে। আমার মতো করে।
"আমি কিন্তু মনে প্রাণে একেবারে খাঁটি বাঙালি। এক্কেবারে হোক কথা কইলাম। বাঙালি আমার পরিচয়। আমার এটা দাম্ভিকতাও।
ধর্মভীরু আমি মোটেও না। তবে সকল ধর্মের মূল মানবিক ভিত্তিগুলি আমি বিশ্বাস করি। ধর্মীয় গোঁড়ামি দুচোখের বিষ। আবার সব ধর্মের আধ্যাত্মিক আচারে আমার উপস্থিতি বেশ উৎসাহের।
মদ বা কোনও নেশা নৈব নৈব চঃ। এই বিষয়ে আমার ব্যর্থতা চিরদিনের। এইসব আসক্তি আমাকে কোনও কালেই একবারের জন্যও প্রভাবিত করতে পারেনি আর পারবেও না। সেই মানসিক জোড় আমার আছে।
নারী? হ্যাঁ, একটু তো আকর্ষণ বোধ করি মনে মনে। মিথ্যে বলে ভন্ড হতে নারাজ। তবে বহুগামিতার রাস্তায় হেঁটে নয়। মর্যাদা ভরসা ভালোবাসা বিশ্বাসের সুষমায় একটিমাত্র নারীসঙ্গ কে না চায়? আমিও যে প্রকৃতির সন্তান। কপালে না জুটলেও আকাঙ্খার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত হতে পারলাম না আজও।
জুয়ার ঠেকে সাংবাদিক হয়ে নিশ্চয়ই গিয়েছি। কিন্তু খেলতে নয়। খবর সংগ্রহের তাগিদে। প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরেছিলাম এটাই অনেক। অবশ্য ক্যাসিনো ও ঘোড়দৌড়ের জুয়ায় একবার করে দুটি ক্ষেত্রেই মিনিমাম টাকা লাগানোর ইচ্ছা বহুদিনের। হারি বা জিতি ওই একবারের জন্য। কিন্তু সমায়াভাবে এই শখ আর পূর্ণ হল না এখনও।
শিক্ষা? শিক্ষিত আমি মোটেও না। প্রত্যেক সময় নিজেকে মনে হয় আমি অশিক্ষিত। কত কি জানার আছে। সবাই কত কি জানে। আর আমি কিছুই তো রপ্ত করতে পারলাম না। তাই খাই না খাই, কিছু করি বা না করি, কিছু না কিছু বিষয়ে পড়ার চেষ্টটা রোজ নিয়মিত করি। সেই ছাত্রাবস্থা থেকে এখনও। একটি দিনও বাদ দিই না। তবু জানাটা আর সেরকম হল না। জানি না এজন্মে শিক্ষিত আর কবে হবো। এই আফসোসটা রয়েই গেল।
আধুনিকতার আমি আবার দারুণ ফ্যান। যদিও আমি অত আধুনিক পোষাক পরি না। সাধ থাকলেও সেই যোগ্যতার সামর্থ্য আমার নেই। তবুও যে কোনও আধুনিকতার সুন্দর নির্যাসের আমি চরম সমর্থক। সময় পাল্টে যাচ্ছে। প্রজন্ম পরিবর্তন হচ্ছে। জীবনধারা পরিবর্তনশীল। রুচি পাল্টে যাচ্ছে। এই সরল সত্যকে আমি নিজের মতো করে মেনে নিতে ও মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি। আসলে যুগের সঙ্গে চলতেই হবে। আমি তাই বরাবরই আধুনিকতার পক্ষে। যদিও আধুনিকতার নামে অমনুষ্যত্ব আমার ধাতে সয় না।
যৌতুক আমি চাই না। নিজের জীবনে ঐশ্বর্য কম দেখিনি। ক্ষমতার ভড় কাকে বলে তাও জীবন দিয়ে দেখেছি। আবার আর্থিক কষ্টটাও খুব কাছের থেকে দেখে চলেছি। তথাপি আমি মানসিক ভাবে ভিখারী নয়। আমি খিদে সহ্য করে থাকতে শিখে গেছি। কিন্তু যৌতুক নেওয়া বা ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনে আমি বিশ্বাসী নয়। এই জীবনপাঠ্যটা আমাকে বাবা মা অল্প বয়স থেকেই শিখিয়ে ছিল। যা আজও আমি পালন করে চলেছি অক্ষরে অক্ষরে।
পাগল নাকি? ইসলামিক রাষ্ট্র, হিন্দু রাষ্ট্র এসব কুক্ষণে শব্দের মুখে সপাটে থাপ্পর মারি। অসভ্য পশু সমর্থকদের সঙ্গে আমি পা মেলাতে রাজি নই। রাষ্ট্র হোক মানুষের। সমস্ত ধর্মের সম্মানজনক সহবস্থানের ভূমি হোক পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র।
এটা কিন্তু ঠিক। পয়লা বৈশাখ মানে এসো হে বৈশাখ এসো এসো। আমার প্রাণের সুরের বাঙালিয়ানার এই বঙ্গ বর্ষপূরণ হোক শান্তির আনন্দের। বাঁচার পূন্য সহবস্থানের। এমন সার্থক পয়লা বৈশাখ যে আমার স্বপ্ন আমার নিশ্বাস।"
আসলে পোস্টে ও কমেন্টে অনিবার্য ভাবেই চলে এসেছে নববর্ষের প্রসঙ্গ। এই শুভ নববর্ষের সন্ধিক্ষণে আমি এটুকুই শুধু ভাবি আমার এই বন্ধুটি কত উদার, কত নম্র, কত নমনীয় অথচ উগ্রপন্থা বিরোধী, অনৈতিকতা বিরোধী, অমনুষ্যত্বের বিরোধী। আচ্ছা আমরা যদি আমার এই বন্ধুটির মতো সবাই এমন মানবিক হতে পারতাম, তবে? তাহলে নিশ্চিত দুই বাংলার আমরা এক বাঙালি জাতি আবশ্যই হতে পারতাম। জানি না এই স্বপ্নপূরণের জন্য আমাদের আর কটা নববর্ষ অপেক্ষা করতে হবে।
(www.theoffnews.com - Bengali nababarsha)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours