তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

শুধু গয়না বিক্রি করে তো পথের পাঁচালীর তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কে প্রকাশ করবে এবং কিভাবে হবে শুনুন পথের পাঁচালীর প্রকাশিত হওয়ার পেছনের ইতিহাসটা।

ধূর মশাই! নিয়ে যান আপনার পান্ডুলিপি। পয়সা খরচ করে পাঁচালী ছাপবো নাকি? বিভূতিভূষনকে বললেন প্রকাশক।

তাহলে গল্পটা একটু খুলেই বলি। বিভূতিভূষণ তখন ভাগলপুরে, খেলাত ঘোষ এস্টেটের ম্যানেজারের চাকরী করতে গেছেন। সন্ধ্যের পর খাটিয়ায় শুয়ে থাকেন। চারপাশে অরণ্য। কত পাখির ডাক। দূর থেকে ভেসে আসে হাতি আরও কত জন্তু জানোয়ারের ডাক। চারিদিকে জ্যোৎস্না। সেই  আলোয় চোখে পড়ে নীলগাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যের পর কোনও কাজ থাকে না। কি করা যায়? লেখা শুরু হল এক উপন্যাস। কে জানতো তখন? আগামী দিনে জন্ম নিতে চলেছে বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ "পথের পাঁচালী"। এইভাবেই একদিন শেষ হল পথের পাঁচালী লেখা। "বিচিত্রা" পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা থেকে পথের পাঁচালী ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হতে শুরু করল। কিন্তু এবার তো বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। একদিন পান্ডুলিপি নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। প্রকাশকের দরজায় দরজায় ঘুরলেন। একজন প্রকাশক বললেন, ধূর মশাই পয়সা খরচ করে আপনার পান্ডুলিপি কেন ছাপতে যাবো? এতে না আছে প্রেম, রোমান্স, শুধু গাছগাছড়ার কথা। এতো বটানির বই লিখেছেন মশাই? ৫০ টাকা দিচ্ছি। রেখে যান। পরে দেখা করবেন। হায়! ঐ প্রকাশক কি তখন স্বপ্নেও ভেবেছিলেন? কি অমূল্য জিনিস তিনি ছাপলেন না! বিশ্বসাহিত্যের এক সেরা সম্পদের প্রকাশক হওয়ার সুযোগ তিনি হারালেন। আর এই পথের পাঁচালী হাত ধরে ভবিষ্যতে আর এক "মানিক" সৃষ্টি করবেন এক যুগান্তকারী সিনেমা "পথের পাঁচালী"। এত কিছু যদি জানতেন প্রকাশক তাহলে তিনি বিভূতিভূষণকে ফিরিয়ে দিতেন না। এরপর বিভূতিভূষণ মনের দু:খে আবার ভাগলপুরে ফিরে যাওয়া ঠিক করলেন। যাওয়ার আগে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, আজও অনেক  বাঙালি যাঁকে গালাগাল দিয়ে থাকে সেই নীরদ সি চৌধুরীকে, বিভূতিভূষণ মনের দু:খর কথা বললেন। নীরদ সি চৌধুরী পান্ডুলিপিটা চেয়ে নিলেন। সেটা নিয়ে "শনিবারের চিঠি"-র সজনীকান্ত দাশের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সজনীকান্ত বিভূতিভূষণেরও বন্ধু ছিলেন। সজনীকান্ত সারা রাত জেগে পথের পাঁচালী পড়ে শেষ করলেন। এ কি লিখেছে বিভূতি! তখন ভোরের আলো সবে ফুটেছে। সকালবেলায় স্থির করলেন আজই একটা প্রকাশনী সংস্থা খুলবেন। নামও ঠিক করে ফেললেন "রঞ্জন প্রকাশনী"। রঞ্জন নামের একটা ইতিহাস আছে। সজনীকান্তের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। তিনি তাঁর ভাবী পুত্রের নাম ঠিক করে ফেলেছিলেন আগে থেকে। পুত্র হলে রাখবেন। সেটা হল রঞ্জন। সেই নামেই নামকরণ করলেন প্রকাশনীর। এবার কে দেবে টাকা প্রকাশনী খোলার। সাহিত্যিক গোপাল হালদারের বাবা এগিয়ে এলেন। দিলেন সজনীকান্তকে প্রকাশনী খোলার টাকা। সব যেন পি সি সরকারের ম্যাজিকের মত ঘটছে! ১৯২৯ সালে মহালয়ার দিন রঞ্জন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হল "পথের পাঁচালী"। তারপর? তার আর পর নেই, নেই তার ঠিকানা। বাকিটা শুধু ইতিহাস! আর এরপর ১৯৫৫ সালে এই পথের পাঁচালীর হাত ধরে পেলাম আর এক অমূল্য মানিকের সন্ধান... সত্যজিত রায়!

ক'দিন আগে বনগাঁয় গোপাল নগরে বিভূতিভূষণের বাড়ি ঘুরে এলাম। যেখানে বসে বিভূতিভূষণ লিখতেন সেই সিমেন্টের বেদীতে একটু স্পর্শ করেছিলাম। শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল। এখানে বসে বিভূতিভূষণ লিখতেন!

শেষে বলি, হে বাঙালী! তুমি চিরকাল নীরদ সি চৌধুরী আর রবীন্দ্র বিদ্বেষী বলে সজনীকান্তকে নিন্দা করে গেলে, আজ বিভূতিভূষণের জন্মদিনে বিভূতিভূষণকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি একটি বার একটি প্রণাম না হলেও একটি নমস্কার জানাও সাহিত্য জগতের এক জহুরী "শনিবারের চিঠি"-র সজনীকান্ত আর বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের নীরোদ সি চৌধুরীকে।

আর একটি বিষয় রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার যাবতীয় ব্যবস্থা কিন্তু সজনীকান্তই করে ছিলেন। নিজের হাতে ফুল দিয়ে খাট সাজানো থেকে শুরু করে, যাবতীয় কাজ তিনিই করেছিলেন। আকাশবাণীতে কবির শেষযাত্রার ধারাবিবরণীর ব্যবস্থা করেছিলেন সজনীকান্ত দাশ। সেই প্রথম রেডিও থেকে কোন ডাইরেক্ট ধারাবিবরণী দেওয়ার ঐতিহাসিক শুরু। ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।জন্মদিনের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথা বলতে হল, এটুকু না জানালে একটু অপরাধ থেকে যেত হয়তো।

এই পুরো লেখাটা  আমার নয় আমাকে পাঠিয়েছেন সজনীকান্ত দাসের কন্যা সোমা বসু। কিন্তু সোমা বসু যেটা বলতে চেয়েছেন সেইটা একেবারে ঠিক কিন্তু আমি কিছু যোগ করতে চাই ইতিহাসের পাতা থেকে...

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে প্রথম যিনি আবিস্কার করেন তাঁর নাম উপেন্দ্রানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ইনি পেশায় উকিল। উনি ভাগলপুর এ আসেন ওকালতি প্র্যাক্টিস করার জন্য। কিন্তু উনার নেশা ছিল বই পড়া। শুধু পড়া সাহিত্য চর্চা করা। নিয়মিত বাড়িতে বৈঠক হতো। প্রচুর উদীয়মান সাহিত্যিকরা আসতেন। সেই সূত্রে বিভূতিভূষনও এসেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার কি লেখার নেশা আছে নাকি। বিভূতিভূষন বললেন না সেরকম কিছু নয়। একটা উপন্যাস লিখলাম। কি হবে জানি না। উপেন্দ্রনাথ বললেন পাণ্ডুলিপিটা আমাকে দেবেন আমি পড়বো। বিভূতিভূষণ পাণ্ডুলিপি দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে এলেন। কিন্তু চার দিন হয়ে গেল কিন্তু  উপেনদা তাঁকে তো কিছু জানালেন না। তিনি ভাবলেন হয়তো সেরকম ভাল কাজ হয়নি। হঠাৎ একদিন উপেন্দ্রনাথ বিভূতিকে বললেন- ভাই আপনার হবে। হবে বলছি কেন? আপনার হয়েছে। কী এক অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন আপনি। পড়েই মনপ্রাণ দুটোই জুড়িয়ে গেছে আমার। যাইহোক এবার আসল কথা বলি- আমি ভাগলপুরে আর থাকছি না। কলকাতায় চলে যাচ্ছি। তবে আমার কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেখান থেকে একটি পত্রিকা বের করব 'বিচিত্রা' নামে। সেখানেই আমি ছাপাব আপনার এই উপন্যাসটি। আপনার এই উপন্যাস দিয়েই যাত্রা শুরু করবে 'বিচিত্রা' পত্রিকাটি। এর কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল বিচিত্রা পত্রিকাটি এবং বিভূতিভূষণের উপন্যাসও কিস্তিতে কিস্তিতে বের হতে লাগল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যরসিক পাঠক মহলে গুঞ্জন শুরু হলো- কে এই লেখক? যে এত দরদ দিয়ে সমাজ ও দেশ গ্রামের তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিসগুলো এত মনোমুগ্ধ করে তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। হঠাৎ একদিন সেই বিখ্যাত পত্রিকা 'শনিবারের চিঠি'র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস অনেক খোঁজখবর করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এসে উপস্থিত। নব্বইটি টাকা তার হাতে গুজে দিয়ে বললেন- বিভূতিবাবু আপনি যদি অনুমতি দেন তবে পথের পাঁচালী উপন্যাসটি বই আকারে আমি ছাপবো। এরপর বিভূতিভূষণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পথচলা কেউ আর থামাতে পারেনি। দুহাতে লিখেছেন এবং যা লিখেছেন মোটামুটি সবই বিখ্যাত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আরণ্যক, অপরাজিতা, অশনি সংকেত, ইছামতি, দেবযান ইত্যাদি।

অর্থাৎ দুটো মানুষের অবদান খুব গুরুত্তপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক এক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় শেষে সজনীকান্ত দাস যাদের কথা না বলাটা শুধু অপরাধ নয় অনৈতিহাসিকও বটে। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Sajanikanta Das)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours