তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

সজনীকান্ত দাস। ঠিকানা ছিল ৫৭ নং ইন্দ্র বিশ্বাস রোড, পাইকপাড়া, কলকাতা ৩৭। জন্ম: ২৫.৮.১৯০০, মৃত্যু: ১১.২.৬২। স্ত্রী সুধারানী দেবী।

সজনীকান্তের কর্ম জীবন প্রায় সবটাই শনিবারের চিঠি। প্রথম প্রকাশিত রচনা 'আবাহন' ছদ্ম নাম ভাব কুমার প্রধান। এরপর কামস্কাটকীয় ছন্দ কবিতা প্রকাশের ফলে ব্যঙ্গ সাহিত্যে সজনীকান্তের প্রতিষ্ঠা লাভ। পরে শনিবারের চিঠি পত্রিকার সম্পাদক হন। তাকে মুদ্রক ও প্রকাশকের ভূমিকায় দেখা যায় পরের দিকে। সজনীকান্তর বিশেষ অবদান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রকাশিত ভারতকোষ এর সংকলন ও পরিকল্পনা।

তার আক্রমণ থেকে কেউ বাদ যাননি। সর্ব প্রথম আক্রান্ত হয়েছেন নজরুল এবং জীবানন্দ দাস। আবার নজরুল এবং জীবনানন্দ যখন মৃত্যু পথ যাত্রী তখন একমাত্র  সজনীকান্ত সামনে এসে দাঁড়ান এবং চিকিৎসার ব্যাপারে যাবতীয় সহযোগিতা করতে থাকেন। হয়তো এটাও সত্য  উনি যাকে বেশি আক্রমণ করতেন তাঁরই বিপদের সময়ে উনি সামনে এসে দাঁড়াতেন। যার ওপর ভালোবাসা বেশী তার ওপরেই তো অভিমানও বেশী। সবই আসে ভালোবাসার অধিকার বোধ থেকেই। সজনীকান্ত এবং ব্রজেন্দ্র নাথ এরা দুজনে কত প্রাচীন পুঁথি বিশেষ করে রামমোহন বিদ্যাসাগর সম্মন্ধে অনেক তথ্য জন সমক্ষে এনেছিলেন যা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।

এটা বোঝা যাচ্ছে যে ব্যক্তিগত জীবনে উনি দয়ালু, উদার এবং বন্ধু প্রেমী ছিলেন। সজনীকান্ত মানেই মানবিকতার এক অনন্য নিদর্শন। তিনি সুগারে আক্রান্ত হলেও কর্ম চাঞ্চল্য ব্যাহত হয়নি। মৃত্যুর আগের দিনেও লিখে গেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ষাটের অধিক। সজনীকান্তের কবিতাগ্রন্থ এগারোটি । এগুলো হল:

পথ চলতে ঘাসের ফুল (১৯২৯),

বঙ্গরণভূমে (১৯৩১?),

মনোদর্পণ (১৯৩১?),

অঙ্গুষ্ঠ (১৯৩১?),

রাজহংস (১৯৩৫),

আলো-আঁধারি (১৯৩৬),

কেডস ও স্যান্ডাল (১৯৪০),

পঁচিশে বৈশাখ (১৯৪২),

মানস-সরোবর (১৯৪২),

ভাব ও ছন্দ (১৯৫২) এবং

পান্থ-পাদপ (১৯৬০)।

১৯৪৬তে প্রকাশিত সজনীকান্ত বিরচিত "বাঙ্গালা গদ্যের প্রথম যুগ" বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান সংযোজন। তারাশঙ্কর তাঁর স্মৃতি চারণায় বলেছেন যে সজনীকান্ত নামটা উচ্চারণে বা স্মরণে শঙ্কা মিশ্রিত শ্রদ্ধা ও বিস্ময় জাগে সর্বাজ্ঞে। সত্যই সজনীকান্ত ছিলেন একজন নির্ভীক অতিবিক্রম যোদ্ধা। সজনীকান্তের কবি হিসাবে পরিচয়-গবেষক-প্রবন্ধ লেখক হিসাবে তাঁর দানের মূল্য তো কম নয়। আমি বলব সেই পরিচয় সজনীকান্তের যোধ্যা পরিচয়ের চেয়ে অনেক বড়, অনেক সত্য পরিচয়। সুধারানী দাস ( স্ত্রী) তাঁর স্মৃতিচারণায় বলছেন, "আমার স্বামীর জন্ম ১৯০০ সালের ২৫শে আগস্ট শনিবার, বর্ধমান জিলার বেতালবনে ওর মামার বাড়িতে। দেশ ছিল বীরভূমের রায়পুর। ছেলেবেলা কেটেছে মালদা শহরে, তারপর পাবনা ও দিনাজপুরে।"

তিনি বলেন, আমাদের বিয়ে হয় ২৩ সালের ২৯শে জুন। তখন ওর বয়স ২৩, আর আমার বয়স তখন ১৩। প্রথমে আমরা থাকতাম মোহনবাগান রো তে, পরের দিকে চলে আসি ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে নিজেদের বাড়িতে।সুধারানী বলছেন, মানুষটি ছিলেন বিরাট শরীরে এবং মনেও। লম্বা লম্বা হাত, পা, চওড়া কপাল, বড় বড় চোখ, চেঁচিয়ে হাসতেন।মনের জোর ছিল খুব। কোনোদিনই উনাকে ভেঙে পড়তে দেখিনি। কম বয়সে দেখেছি, ওর ছিল খুব ছবি তোলার নেশা। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলেরই ছবি তুলে রাখতেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস "অজয়" (১৯২৯সাল)। তিনি ব্যঙ্গ কবিতাই লিখেছেন বেশি। তবে তাঁর আর এক স্বপ্ন ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে নিয়ে। শুধু লেখকই নন, সম্পাদক এবং প্রকাশক হিসাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। যেমন- বঙ্কিম রচনাবলী -১ম খণ্ড, আলালের ঘরের দুলাল, ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী ও অন্যান্য সমাজ চিত্র। এর মধ্যে অনেকগুলো বই ব্রজেন্দ্রোনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সুধারানী আরও বলেছেন, মানুষটা অর্থ উপার্জন এর জন্য কতরকম কাজই না করেছেন। একটা সময় হিস মাস্টার্স ভয়েস এ গান লিখে দিতেন, আর কাজী নজরুল সুর দিতেন, আবার কখনো অন্য কেউ সেই গানে সুরারোপ করতেন। তিনি গান লেখা ছাড়াও অনেক চিত্রনাট্য করেছেন। যেমন-নৌকাডুবি, দৃষ্টিদান, আঁধারে আলো, রাধারানী ও মুক্তি ছবি।লেখালেখির বাইরে তাঁর কাজ ছিল ছেলের নামে "রঞ্জন প্রেস" তৈরি করা। উনার প্রথম ছাপা বই ছিল বিভূতিভূষণ এর পথের পাঁচালি। যখন কেউ এই বই ছাপতে রাজী হননি, তখন তিনি এগিয়ে এসে ওই বইটি ছাপেন। সুধারানী বলেন, "আমার স্বামীর জীবনে একটা মস্ত অংশ জুরে আছে রবীন্দ্রনাথ।বিরোধ যত, শ্রদ্ধাও তত। কবির মহাপ্রয়ানের পর শেষ যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন উনি। চিতা ভস্ম এনে রেখে দিয়েছিলেন নিজের লাইব্রেরিতে। পরে লেডি রানু মুখার্জী এসে দেখে ওগুলো নিয়ে চলে যান একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। যেখানে কবির সমস্ত জিনিস সাজানো আছে।

সজনীকান্ত মহাশয়ের কন্যা সোমা বসু স্মৃতিচারণায় বলছেন, এহেন সজনীকান্তকে পিতারূপে পাওয়া যে ঈশ্বরের কত বড় দান, আমরা তাঁর অযোগ্য সন্তানেরা পদে পদে উপলব্ধি করি। তিনি ক্ষুরধার ব্যঙ্গ কবি, সম্পাদক, গীতিকার, গবেষক এবং একই সঙ্গে সাহিত্যের আঙিনায় নব নব প্রতিভার আবিষ্কার কর্তা ও এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভার কি সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে? না কি সমালোচনার পুঞ্জিভূত খবরে চাপা পড়ে গেছে তাঁর বাকি অন্য দিকগুলো।

কবির "আমি" কবিতায় স্বয়ংক্রিত ক্ষেদোক্তি- কেউ করিয়াছে ঘৃনা, কেউ মোরে বাসিয়াছে ভাল, কেউ আসিয়াছে কাছে, দূরে কেউ করে পরিহার-তাহাদের ঘৃণা আর ভালবাসার রূপ, রস, রঙ আমারে করেছে সৃষ্টি, সেই আমি সংসারের ঝি; সত্য পরিচয় মোর গোপন রহিয়া গেল, হবে না প্রকাশ কোনোদিন।

একবার তারাশংকর খুব রুষ্ট হয়েছিলেন। সজনীকান্ত শুনে বললেন ও বড়বাবু রেগে গেছেন বুঝি ও আমি গিয়ে ঠিক করে দেব। তারাশংকরকে একবার বড়বাবু বলেছিলেন তখন তারাশংকর বললেন তুমি তাহলে ছোটবাবু আর মেজবাবু হচ্ছে বনফুল। মানে বয়সের দিক থেকে উনি সবচেয়ে বড় তাই বড়বাবু আর সব চেয়ে ছোট হলো ছোটবাবু মানে সজনীকান্ত। যাই হোক সোমা বসু বললেন  তাঁর স্মৃতি চারণায় এই ইন্দ্র বিশ্বাস রোডের বাড়ির একতলায় (রঞ্জন পাবলিশিং হাউসের) অফিস ঘরটিতে কত জ্ঞানী গুণী জনের পদধূলি পড়েছে তাঁর কোন হিসেব নেই এককথায় চাঁদের হাট। কাজী নজরুল, মোহিত লাল, বিভূতিভূষণ, নীরোদ চৌধুরী, সুনীতি চট্টপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, বনফুল, প্রমথনাথ বিশী, তারাশংকর এবং আরো অনেকে। উনি বলছেন, বাবার নিজের লাইব্রেরিতে প্রায় ৬০ হাজার বই ছিল। পরে উনি ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে সব দিয়ে যান। উনার মুখস্ত ছিল যে কোন থাকে কোন বই এবং কত পৃষ্ঠায় কি লেখা আছে।অসাধারণ স্মৃতি শক্তির জন্য আকাশবাণীর পরিচালন সমিতি উনাকে রেডি রেফারেন্স বলে জানতেন।

তিনি বহু উদীয়মান লেখকের লেখা, পাণ্ডুলিপি পড়ে পরে প্রকাশ করেছেন পরে অনেকেই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠত হয়েছেন। আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ব্রজেন বন্দোপাধ্যায় সজনীকান্ত সম্মন্ধে বলছেন, সজনীকান্তের সাধনা, একক সাধনা নহে, বহুকে সঙ্গে লইয়া সাহিত্যের দুরূহ দুর্গম পথে তিনি অভিযান করিয়াছেন। তিনি এক বৃহৎ সাহিত্য গোষ্ঠীর গোষ্ঠিপতি ছিলেন। গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন মধ্যগগনে সূর্য। নায়ক হেঁটে যাচ্ছে। তার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে রাস্তায়। সজনীকান্ত এসে রবীন্দ্রনাথকে বললেন, মধ্যগগনে সূর্য থাকলে ছায়া কি করে পড়বে? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, সজনী, তুমি পারো বটে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ লাইনটি বদলে দেন। সজনীকান্ত যেমন নির্মম সমালোচক, তেমনি একইসাথে মানবিকতারও জীবন্ত দৃষ্টান্ত। সজনী কান্তের  অনুপ্রেরণায় এলেন বিভূতিভূষণ।পথের পাঁচালি প্রকাশিত হবার অনেক পরে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালি সিনেমাটি তৈরি করে বিশ্ববিখ্যাত হন। সজনীকান্তের জন্য পথের পাঁচালি আর পথের পাঁচালির জন্য সত্যজিৎ রায়। এইটাই হল ইতিহাস। শেষবিচারে এই ইতিহাসের উৎস মুখ হল পাইকপাড়া।

সুধারানী স্মৃতি চারণা করতে করতে শেষ যে লাইন গুলো বললেন সেটা পড়লেই চোখ ভিজে যায়। 'তিনি বললেন উনচল্লিশ বছর বয়সে আমায় একলা ফেলে চলে গেলেন। আর ভালো লাগে না কিচ্ছু ভালো লাগে না। খুব দেখতে ইচ্ছা করে সব্বাইকে আর দেবীপ্রসাদের গড়া ওঁর মুর্তিটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি-- একবার কি মনে পড়ে না আমায়'এখন শুনলাম সোমা বৌদির ( কন্যা) কাছ থেকে পথের পাঁচালি প্রকাশ করার জন্য সুধারানীর গয়না বন্ধক দিতে হয়েছিল। কত কষ্ট কত আত্মদান। পথ সহজ ছিল না, পথ ছিল রক্তাক্ত। চোখের জলের ইতিহাস বললে ভুল হবে না। (ক্রমশঃ)

(তথ্যসূত্র: অনুষ্ঠুপ পত্রিকায় প্রকাশিত সজনীকান্ত সংখ্যার সব লেখা বইহিসেবে প্রকাশিত হলো। এটা শুধু বই নয় এক মূল্যবান দলিল।)

(www.theoffnews.com - Sajanikanta Das)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours