তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এখন যে কথা বলা হচ্ছে প্রায় বিভিন্ন চ্যানেলে ঘন ঘন হাত ধুন সাবান দিয়ে কারণ হাতের মধ্যে দিয়ে ভাইরাস প্রবেশ করে। আগে মানুষ হাত ধুত বা মুছত মাটি দিয়ে আর কেউ নদীর জলে। কারণ সাবান খুব অল্প মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল দামের কারণে।

আমরা যে সাবান ব্যবহার করি তা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮২৩  সালে। তাঁর পরেই মানুষ হাত স্যানিটাইজ করা শিখলো। কিন্তু স্যানিটেশন এর কথা বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা যে বিজ্ঞানি প্রথম বলেছিলেন ভাইরাস থেকে বাঁচতে তাঁকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে গার্ডেরা পিটিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। অবশ্য ফ্লোরেন্স নাইট এঙ্গেলও ওই একই কথা বলেছিলেন। একই সময় মানে ১৮৫৩ সাল। উনি ছিলেন প্রথম শিক্ষিত নার্স। ক্রী মিয়ার যুদ্ধের সময়ে সৈন্যদের চিকিৎসার সময়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু কেন এই পদ্ধতির কথা বললেন তা প্রমাণ করতে পারেননি।

১৮ শতকে জীবাণু ছড়ানোর বিষয়টি জানা ছিল না। হাত ধোয়ার প্রচলনটা ছিল কদাচিৎ। টয়লেট থেকে এসে, এমনকি ক্লিনিক্যাল প্রসিডিওর কিংবা অপারেশনের আগে ডাক্তাররাও হাত ধুতেন না। ডাক্তাররা মর্গ থেকে এসে যখন রোগী দেখতেন তখন মৃতদেহ থেকে ভয়ংকর পার্টিকল জীবিত রোগীদের মধ্যে সংক্রমিত হত এবং তাদের মৃত্যু ঘটত। হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক 'ইগনাজ স্যামেল ওয়াইজ' প্রথম এ বিষয়ে নজর দেন। জন্ম ১৮১৮।

১৮৪৭ সালে স্যামেলওয়াইজ পুরুষ গাইনি ডাক্তারদের নির্দেশ দেন প্রসূতি বিভাগে সুস্থ মায়েদের পরীক্ষা করবার আগে হাত ধুতে হবে এবং তাদের ইনস্ট্রুমেন্ট-গুলি ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুতে হবে। এর ফল হল অবিশ্বাস্য। ওই বছর একজন রোগীরও মৃত্যু হল না। তখন মৃত্যুর হার ছিলো ১৬ পার্সেন্ট। উনার নির্দেশে পরীক্ষা চলার পর মৃত্যুর হার দাঁড়ালো ১ পার্সেন্ট। অভাবনীয় সাফল্য। 

স্যামেলওয়াইজ এরপর হাত ধোয়ার উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর সহকারীরা তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ তাদের মনে হল ডা. স্যামেলওয়াইজ তত্ত্ব অনুযায়ী অর্থাৎ চিকিৎসকরাই রোগীর মৃত্যুর জন্য দায়ী।

প্রথম রুগীরাও বলতে শুরু করলেন ডাক্তাররাই দায়ী। ভিয়েনা হাসপাতালে মৃত্যুহার কমলেও, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও হাত ধোয়ার তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করল। উদ্বিগ্ন স্যামেলওয়াইজ ভিয়েনায় ১৮৬১ সালে নিজের কাজ প্রকাশ করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। সায়েন্টিফিক সোসাইটির লোকজন তখনও বিশ্বাস করত রোগ বালাই হয় খারাপ আত্মার মাধ্যমে।

স্যামেলওয়াইজ মরিয়া হয়ে সকল গাইনি ডাক্তারদের চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন, যেন তারা হাত ধুয়ে, ইনস্ট্রুমেন্টস ধুয়ে কাজ করেন। এতে জীবন বাঁচবে। তখন সব ডাক্তাররা তাঁকে পাগল আখ্যা দেন। আস্তে আস্তে তিনিও ডিপ্রেশনে চলে যান। সবাই তাকে পাগল মনে করছিল। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউনের পর স্যামেলওয়াইজকে পাঠানো হলো 'মেন্টাল অ্যাসাইলামে’। কেউ বললো তাঁর ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, কেউ বলল, বদ আত্মা ভর করেছে। মাত্র ১৪ দিন পর, মেন্টাল অ্যাসাইলামের গার্ডরা তাঁকে প্রচন্ড পেটাল।পেটানোর ফলে তাঁর হাতে-শরীরে ক্ষত থেকে ডান হাতে বিষক্রিয়া শুরু হয়। রক্তের বিষক্রিয়ায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৩ আগস্ট, ১৮৬৫ সালে মারা যান এই যুগান্ত সৃষ্টিকারী চিকিৎসক। ইগনাজ স্যামেলওয়াইজের কাজ লুই পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি। তার কাজ ও ব্যাখ্যা লুই পাস্তুরকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। অথচ তাঁর শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে কোন ডাক্তার এলেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যুর খবর ‘হাংগেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটি’ প্রকাশও করেনি তাদের পেপারে।

জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ রোগের উৎপত্তি জীবাণু থেকে হতে পারে আবিষ্কারের অনেক বছর পর তাঁর স্বীকৃতি মেলে ২০ শতকে। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ আজও বিরাজমান।

শুধু তাই নয়। ইগনাজ স্যামেলওয়াইজের স্ত্রী বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে তাঁর স্বামীও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সব চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছেন যখন তাঁর বস জন ক্লেইন ভিয়েনা থেকে চিঠিতে বললেন, তোমার কাজ আমাদের কথা শোনা, প্রজার মতো। নতুন কিছু বলা নয়। obey your teachers। তোমায় কে অনুমতি দিয়েছেন এই সব বলার? তোমার মানসিক সমস্যা আছে। তাঁকে ভিয়েনায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এবং জোর করে বুদাপেস্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং কোনো হাসপাতাল তাকে যেন চাকরি না দেন তার ব্যবস্থা ও করলেন। তিনি কাজ করতে না পেরে মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করলেন। পাগল বলে ফতোয়া জারি করা হলো।

একদম একা কেউ পাশে নেই। ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ রাস্তায় লিফলেট বিলি করে বলতে শুরু করেছিলেন শেষের দিকে যে ডাক্তাররাই খুনী। কারণ তাঁরা হাত স্যানিটাইজ না করে রোগীদের কাছে গিয়ে রোগ ছড়াচ্ছেন। ডাক্তাদের দায়িত্বজ্ঞান হীনতার জন্যই এত মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। ডান হাতে গাংরিন হয়ে গিয়েছিল। প্রচার করা হলো উনি গাংরিন এর কারণে মারা গেছেন। আসলে খুন হলেন। ওই সময়ে তাঁর বন্ধু বান্ধব আত্মীয় সবাই এমন কি তাঁর তাঁর স্ত্রীও তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি জানতেও পারলেন না যে কত বড় কাজ করে গেলেন।

আজ ভিয়েনা এবং বুদাপেস্টে তাঁকে নিয়ে স্মরণ সভা হয়। তাঁর বাড়িটাই এখন একটা ঐতিহাসিক মিউজিয়াম। আজও ভিয়েনা ও বুদাপেস্টের সব ডাক্তাররা তাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। তিনি মারা যান অর্থাৎ খুন হন ৪৭ বছর বয়সে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি ডাক্তার হিসেবে যোগ দেন

ভিয়েনা হাসপাতালে। ১৯৬৪ সাল থেকে তাঁর বাড়িটাই এখন টুরিস্ট স্পট। প্রতি বছর ৫ লক্ষ মানুষ আসে মানে টুরিস্ট তাঁর মুর্তি ও বাড়ীটা দেখতে।

করোনা প্রসঙ্গে এই গল্প আজও প্রাসঙ্গিক এবং হাত ধোয়া ইতিহাসের এক অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি।

(www.theoffnews.com - hand washing sanitation)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours