পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
রাত দেড়টা, পুজো বার্ষিকীর একটা উপন্যাস শেষ করে ঘুমাতে যাব ভাবছি। একটু বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। শুনশান রাস্তা, নিথর চারিদিক। অক্টোবরের মাঝামাঝি, হালকা ঠান্ডায় সিটিসেন্টার তখন ঝিম মেরেছে। দুর্গাপুরে আমার এই পাড়াটার সঙ্গে সল্টলেকের বেজায় মিল। দারুণ সুন্দর সুন্দর সব দোতলা তিনতলা বাড়ি। সাজানো গোছানো সবুজে ভরা ছিমছাম এলাকা। কিন্তু প্রায় সব বাড়িতেই এক জন বা দুজন বয়স্ক মানুষ ছাড়া আর কেউ থাকেন না। সেই সুযোগে বাড়িগুলি ভরিয়েছে কিছু পরিযায়ী ছাত্র বা চাকুরে। এরা খুব একটা মেশেন না, নিজেদের মতই থাকেন। তাই দিনের বেলাতেও এ পাড়াতে তেমন শোরগোল শোনা যায় না। রাস্তার আলোয় বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম বাড়ির সামনের মোড়ে দুটি কুকুরের ঠান্ডা লড়াই। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। মোবাইল নয় ল্যান্ডলাইন। আমার পাশের জেলার সহকর্মী সমীরণের অবশ্য এমন অদ্ভুত সময়ে ফোন করবার অভ্যেস আছে। এই রাতে ফোন করে ঘন্টা দুয়েক গেঁজাতে সমীরণের জুড়ি নেই। নিস্তব্ধ বারান্দায় একাকী বসে থাকতে মন্দ লাগছিল না। ভাবলাম ফোনটা তুলব না। কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার রিং শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়েই তুললাম, একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম, কি যে করিস না… ‘আপনি রিপোর্টার সাহেব বলছেন?’ একটা সন্ত্রস্ত গলা, সমীরণ তো নয়। বেশ একটু লজ্জা পেয়েই বললাম হ্যা, কে বলছেন? আমার কথার উত্তর না দিয়ে উত্তেজিত গলায় আর্তি ‘এখানে শিগগিরি আসুন খুন করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে কয়লা পার্টি, সাংঘাতিক অবস্থা।’ জিজ্ঞাসা করে জানলাম পান্ডবেশ্বরের কাছে একটি জায়গার ঘটনা। দেখছি, বলে ফোন নামালাম।
ফোন নামিয়েই পান্ডবেশ্বর থানায় ফোন, কিছু একটা হয়েছে ঠিকই কিন্তু পুলিশ নিজেও ওই এলাকায় এখনও ঢুকতে পারেনি। প্রথমেই চিন্তা করে নিলাম এত রাতে ওদিকে গেলে রাস্তা চেনাটা একটা সমস্যা হতে পারে। আমার বসকে ফোন করলেই বলবেন চলে যা শিগগিরি, তাই তাকে আর ঘুম থেকে না তুলে ডেকে নিলাম আমার ক্যামেরাম্যানকে। কাছেই থাকে সে, মিনিট পনেরোর মধ্যেই চলে এল। অন্য রিপোর্টার বলতে খবরের কাগজের কাউকে ডেকে লাভ নেই, কারন তাদের সকালে গেলেই হয়, তাই তারা এই রাতে কোথাও যেতে চায় না। আগেও ডেকে দেখেছি, যায়নি। টিভির তখন এত চ্যানেল নেই, রিপোর্টারও নেই। তাই আমাকেই বেরতে হবে। গাড়ি নিয়ে যখন বেরলাম রাত তখন দুটোর ঘরে পড়েছে। প্রায় কুড়ি বছর আগের দুর্গাপুর, এমনিতেই সিটিসেন্টার ফাঁকা, তার উপরে নরম শীতের আমেজে ডুবে চারিদিক। উখড়া ছাড়িয়ে পান্ডবেশ্বরের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম দমকলের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। কি হল, জিজ্ঞাসা করতেই ভিত সন্ত্রস্ত জবাব ভয়াবহ অবস্থা, যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে আছেন ওরা।
এর মধ্যেই ফোনাফুনিতে জেনে গিয়েছি কয়লা পার্টির নিজেদের মধ্যেই লড়াই এটি। বেআইনি খাদানের কয়লার বখরা নিয়ে লড়াই। তারই জেরে বেশ কয়েকজনকে নাকি খুন করে কয়লার আগুনেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এলাকায় বন্দুক পিস্তল হাতে ঘোরাঘুরি করছে আততায়ীরা। ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন স্থানীয় মানুষজন। তাদেরই একজন ফোন করেছিলেন আমাকে। পুলিশও যেতে ভরসা পাচ্ছে না ঘটনাস্থলে। পরিস্থিতি যাই হোক এতদূর যখন এসেছি আরও একটু যাওয়ার চেষ্টা তো করতেই হবে। কিন্তু গাড়ি নিয়ে যাওয়াটা সমস্যা। তাই আরও খানিকটা গিয়ে একটি পেট্রোল পাম্পে গাড়িটাকে রেখে অগ্রসর হলাম আমরা। যোগাযোগ রেখে চলেছি যিনি ফোন করেছিলেন আমাকে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। উনিই জানালেন গ্রামের পিছনদিকে মাঠের মধ্যে দিয়ে এলে ওর বাড়ির কাছাকাছি যাওয়া যাবে। সেই মত পিছন দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দমকলের লোকেরা আর আসতে চাইল না। আমরা দুজনেই অগত্যা হাঁটছি। অন্ধকার গ্রাম থেকে মাঝে মধ্যেই ভেসে আসছে উল্লাস। হঠাৎ দেখি অন্ধকারের বুক চিরে একটা গাড়ি ছুটে আসছে আমাদের দিকে। তার পিছনে ছুটছে বেশ কিছু মানুষ। মাঝে মধ্যেই গাড়ি লক্ষ্য করে ছুঁড়ছে বোমা। ক্যামেরাম্যান নবকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম রাস্তার পাশে ক্ষেতের মধ্যে। ক্ষেতের বেড়ার কাঁটায় ছড়ে গেল হাত মুখ। চুপ করে বসে রইলাম। একটাই আশঙ্কা হচ্ছিল এলোপাথাড়ি ছোড়া বোমাগুলির একটাও যদি আমাদের উপরে এসে পড়ে তাহলেই গিয়েছি। কাছে আসতে দেখলাম ওটা পুলিশের জিপ। গোটা কয়েক পুলিশকর্মী প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছেন, পিছনে উন্মত্ত দুস্কৃতীরা তাদের তাড়া করেছে। ওরা চলে যেতেই চোখ পড়ল নবর দিকে, অন্ধকারেও বেশ দেখলাম ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছে মুখটা। বুঝলাম এবারে ফেরবার পথও নেই, ফেঁসে গিয়েছি আমরা। এভাবে বসে থাকাও মুশকিল, হাতে পায়ে লেগেছে, জ্বালা করছে, তাছাড়া মাঠের মধ্যে সাপ, পোকাও থাকতে পারে। ওই মাঠের মধ্যে দিয়েই নিচু হয়ে হয়ে কোনওক্রমে পৌঁছলাম গ্রামের পিছনদিকে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল আগুন জ্বলছে তবে ওটাই মৃতদের চিতা কিনা বুঝে উঠতে পারিনি। বেশ বুঝতে পারছিলাম পুলিশকেই যারা রেয়াত করে না, তারা যদি জানতে পারে আমরা তাদের কীর্তি দেখতে বা দেখাতে এসেছি কি করতে পারে আমাদের। প্রাণ হাতে করেই পৌঁছলাম ওই ভদ্রলোকের বাড়িতে। তারাও দেখলাম ভয়ে জড়সরো। ছাদের উপর থেকে ছবি নেওয়ার চেষ্টা করা হল বটে তবে তা খুব স্পষ্ট হচ্ছে না। এদিকে মাঝে মধ্যেই টহল দিচ্ছে দুস্কৃতীরা। আমাদের উপস্থিতি টের পেলে শুধু আমরা না বিপদে পড়বেন আশ্রয় দেওয়া গৃহকর্তাও।
ভোরের আলো ফুটতেই বিশাল বাহিনী নিয়ে এল পুলিশ। পিছু হটল দুস্কৃতীরা। পরে জানলাম প্রায় দশ থেকে পনেরো জনকে খুন করা হলেও পুলিশ দেহ পেয়েছে দুজনের। এমনই হয় এদিকে। পরিত্যক্ত খাদানগুলি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে চলে বেআইনি ব্যবসা, মৃত্যুর মিছিল। কিছুটা শোনা, কিছুটা পড়া ছিল এগুলি নিয়ে। কিন্তু সেই রাতে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হলাম আমরা তা জীবনের এক অধ্যায় হয়ে থাকবে। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল, আমি সিউড়ী বদলি হয়ে গেলেও ওর বাড়িতে এসেছি নানা অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেই রাতে তিনিই যে আমায় ফোন করেছিলেন বা বিপদে আশ্রয় দিয়েছিলেন তা জানি শুধু আমি এবং ওই পরিবারের সকলে। পরে শুনে খুব বকেছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা। এটা নাকি চরম বোকামির কাজ করেছি আমরা, ধরা পড়লে আর খুঁজেও পাওয়া যেত না আমাদের লাশ। তবে এটা ঠিক আমার প্রতি তাদের ভালবাসা এবং সমীহ ভাবও বেড়ে গিয়েছিল অনেকটা। সেটা এখনও টের পাই দুর্গাপুরে গেলে। আজও যেমন পান্ডবেশ্বরে কয়লা খাদানে কোনও মৃত্যুর খবর দেখলে চোখে ভেসে ওঠে বছর কুড়ি আগেকার সেই রাতের ছবিটা। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Pandabeshwar coal mine)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours