সোমা মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক ও নৃত্যশিল্পী, কলকাতা:

প্রাচীনকালে সেই আদিম সমাজে নৃত্যের প্রচলন ছিল। কিন্তু তারা হয়ত তখন তাকে নৃত্য বলত না, বলত পুজো। তাছাড়া শিকার করে ফিরে যখন গোল হয়ে বসে আনন্দ করত তখন শিকারী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নেচে বা অভিনয় করে দেখাত কিভাবে জন্তুটিকে মারা হল। এই ভাবে সবার অজান্তেই অথচ নিয়মমাফিকই গড়ে উঠতে লাগল সংস্কৃতি। প্রাক্ বৈদিক যুগে কলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ নৃত্যের সেরকম কোনও প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না। তবে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যে আমরা পাই কিছু নৃত্যরতা নারীমুক্তি এবং তন্ত্রবাদ্য, যার থেকে বোঝা যায় সেই সময়ে নৃত্যকলার চর্চা ছিল।

আর্তি কথার অর্থ আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্য। কৃষ্ণ-যজুর্বেদে এই শব্দটির উল্লিখিত প্রমাণ করে সে যুগেও নৃত্যের বিশেষ চর্চা ছিল। তবে এই সময়ের নৃত্যের  বিশেষ রূপ পাওয়া যায় না। অর্জুন নৃত্যকলায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন এবং বিরাট রাজকন্যার নৃত্য শিক্ষক রূপে নিযুক্ত ছিলেন। যে সমস্ত পুরাণে আমরা নৃত্যের উল্লেখ পাই, তার মধ্যে আছে ভাগবত পুরাণ, বরাহপুরাণ, পদ্মপুরাণ ইত্যাদি। কয়েকটি বিখ্যাত নৃত্যের কথা যেমন- শ্রীকৃষ্ণ এবং গোপীদের রাস্তার, কালীয়দমন নৃত্য ইত্যাদি।  বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র গ্রন্থেও চৌষট্টি কলার মধ্যে নৃত্যকে স্থান দিয়েছেন। কালিদাসের 'মালবিকাগ্মিমিত্রম্' নাটকে নায়িকার নৃত্যের যে পরিচয় মেলে তা শিব-পার্বতীর তান্ডব ও লাস্যের মিলিত রূপ। অজন্তা, ইলোরা, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি জায়গায় মন্দির স্থাপত্যে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মুর্তি দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন কালের বিভিন্ন মন্দিরের সামনে নাটমন্ডপ প্রমাণ করে যে দেবদাসীরা কোন এক সময়ে সেই মন্ডপে নৃত্য পরিবেশন করত। মৌর্য থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত সময়কালে বিভিন্ন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নৃতকলার সমধিক উন্নতি হয়েছিল, এই সময়কে নৃত্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়। দক্ষিণ ভারতে শাস্ত্রীয় নৃত্য নিয়ে সেই সময়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু হয় তা দেশের পরিধি ছাড়িয়ে এক বিশ্বময়তা লাভ করে।

তবে মধ্যযুগকে এক সংকটময় যুগ বলা যেতে পারে। এই মধ্যযুগের মধ্যেই পড়ে প্রাক মুসলিমযুগ এবং মুসলিমযুগ। প্রাক্ মুসলিমযুগে যদিও বা নৃত্যকলার মান বজায় ছিল কিন্তু মুসলিম আক্রমণ ও জয়লাভের পর স্বভাবতই নবাব বাদশাহের লোলুপ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল নৃত্যকলা বিশেষ করে মহিলা নৃত্য শিল্পীদের ওপর। নৃত্যকলা স্থান নিল রাজার দরবারে রাজার মনোরঞ্জনের জন্য যেখানে সাধারণের প্রবেশের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং এর গতি হল রুদ্ধ। কিন্তু এটি বিশেষভাবে ঘটেছিল উত্তর ভারতে। দক্ষিণ ভারত তিন দিক সমুদ্রবেষ্টিত বলে বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়, তাই সেখানে নৃত্যলক্ষ্মী তার সসম্মান অস্তিত্ব বজায় রেখে বিকাশ লাভ করেছিল।

অস্তমিত হল মুসলিম রাজত্ব, কায়েম হল ইংরেজ রাজ। এক প্রভুর হাত থেকে আর এক প্রভুর হাতে মালিকানা বদল। সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হল, সংগীত নৃত্য দরবার থেকে বিচ্যুত হয়ে কিছু বাঈজীদের অর্থ উপার্জনের চটকদারি কাজে ব্যবহৃত হতে লাগল। এবং স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর যোগাযোগ রইল না। সংগীত বা নৃত্যের দৌড় তখন রইল ধনী ও জমিদারদের বিলাসী বৈঠকখানা পর্যন্ত। সাধারণ ভদ্র শিক্ষিত সমাজ তখন নৃত্যকে খারাপ চোখে দেখত এমনকি যাঁরা তার চর্চা করত তাদেরও। এই সমস্ত কারণে স্বভাবতই নৃত্যের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল বা বলা চলে নৃত্যের বিবর্তনের গতি শ্লথ হয়ে পরল। এই পরিস্থিতি বেশি দিন রইল না। অষ্টাদশ শতক থেকে এই বাঈজীদের মধ্যে থেকেই বেরিয়ে এলো কিছু শিল্পী আশার আলো হয়ে, তার সঙ্গে যোগ দিলেন মুসলমান ওস্তাদ। বন্ধ দরজা আবার খুলতে লাগল, যে আলোর গতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তা আবার উন্মুক্ত হতে শুরু করল, সংগীত ও নৃত্য নিজের আসন ফিরে পেল সসম্মানে। এবার আগের চেয়েও এর ভিত্ হল শক্ত। এই পুনরুদ্ধার ও বিবর্তনের পেছনে যাদের দান আছে তারা হলেন ঈশ্বরপ্রসাদজী, ভানুজী, বিন্দাদীন, কালকাপ্রসাদ ও আরও অনেকে। যে উন্নতসাধন সেদিন শুরু হয়েছিল সেই কর্মশালা আজও চলছে এবং এর জন্য আমরা অবশ্যই নাম করব উদয়শঙ্কর, রুক্মিণী দেবী আরুন্ডেল, বিরজু মহারাজ, বালা সরস্বতী,  গোগীকিষণ, গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র, গুরু বিপিন সিংহ, গুরু গোবিন্দন্ কুট্টি ও আরও অনেক প্রথিতযশা শিল্পী এবং শিক্ষকের।

(www.theoffnews.com - Indian dance)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours