তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

ক্ষেউর কবি গান থেকে পাঁচালী গানে রূপান্তর ছিল এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। এই ঐতিহাসিক লোকায়ত রূপান্তরের প্রথম সফল মানুষ হলেন দাশরথি রায়।

এটা ভালো করে বুঝতে হবে যে তিনি যখন বাংলা গানের জগতে আসছেন তখন এই বঙ্গে রাগাশ্রয়ী গানের ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে, মানে শ্রোতার কান তৈরি হয়ে গেছে। আর এর মূল কারিগর ছিলেন টপ্পা গায়ক নিধুবাবু যিনি এই জমিটি তৈরি করলেন। নিধুবাবুর যুগের অবসান আর তাঁর পরেই এলেন দাশরথি রায়। মানুষের কানে ছিল টপ্পার সুর (রাগদারী)। তবে সেই সুর সাধারণের জন্য নয়।

অর্থাৎ এক দিকে কীর্তন, ভক্তিমূলক গান ( বৈষ্ণব পদাবলী), দুই রাগ সংগীত তিন আর একদিকে ক্ষেউর ও লোক সংগীত। এই ত্রিবেণী সঙ্গমের রূপকার ছিলেন দাশু রায়। তাঁর গানের স্টাইলটা ছিল ক্ষেউর কিন্তু রস ছিল ভক্তি ও কীর্তনের, অর্থাৎ উনি সচেতন ভাবে রাগকে ব্যবহার করেছিলেন। উনি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন ক্ষেউর গানের পদ লিখতে লিখতে। উনি শুধু গান বাঁধতেন প্রথম দিকে। তাঁর পরে ১৮৩৬ সালে পাঁচালি গানের প্রথম আখড়া তৈরী করলেন।

"দোষ কারো নয় গো মা।" এই গানটি উনারই লেখা। অনেক পরের দিকে গানটি গেয়েছেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। সুরকার চিত্ত রায়।

উনিশ শতকের পাঁচালী ও দাশরথি রায়ের কথা স্মরণে এলে বলতেই হয়, বর্ধমানের বাঁধমুড়া গ্রামে দাশরথি রায়ের জন্ম। কিন্তু সেই সময়ে বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। এই সব কিছুর আলোড়ন তাঁর চেতনায় পাঁচালীর গান জাগিয়ে তুলেছিল কথার চটকে, শব্দের ঝঙ্কারে, আসর মাতানো সঙ্গীতের রেশে। উনিশ শতকের মধ্যদিগন্তেও তিনি অষ্টাদশ শতকের কাব্যিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরী। তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’ (দ্বিতীয় পর্যায়) গ্রন্থে উনিশ শতকের পাঁচালীকার দাশরথি রায়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমন মন্তব্যই করেছিলেন ভূদেব চৌধুরী। শুধু তিনিই নন, সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেনের মতো প্রায় সব সাহিত্য গবেষকরাই মনে করেন, উনিশ শতকে যে পাঁচালীর ধারা বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল তার মূল ভগীরথ ছিলেন বর্ধমান জেলার বাঁধমুড়া (বাঁদমুড়া) গ্রামের সন্তান দাশরথি রায়।

দাশরথি রায়কে নিয়ে প্রথম আলোচনা করেছিলেন ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পরে তাঁর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে হরিপদ চক্রবর্তীর ‘দাশরথি রায় ও তাহার পাঁচালী’, ‘দাশরথি রায়ের পাঁচালী’, নিরঞ্জন চক্রবর্তীর ‘উনবিংশ শতাব্দীর পাঁচালীকার ও বাংলা সাহিত্য’ প্রভৃতি গ্রন্থে। সাহিত্য গবেষকরা মনে করেন, ১৮০৬ সালের (১২১২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে) অধুনা কাটোয়ার নিকটবর্তী বাঁদমুড়া বা বাঁধমুড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা দেবীপ্রসাদ ও মা শ্রীমতী দেবী। দাশরথির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারও মতে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড় খুব বেশি ছিল না। সংস্কৃত ভাষায় লেখা পুরাণ, দর্শন প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন না। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী থেকে তিনি নাকি তাঁর গল্পের বা পাঁচালীর উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, মূল সংস্কৃত না জানলে তাঁর পক্ষে খুঁটিনাটি পৌরাণিক তথ্য পাঁচালীর কাহিনী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হত না।

দেবীপ্রসাদের চার পুত্রের ভিতর দাশরথি (১৮০৬-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন দ্বিতীয়। কবিয়াল ও পাঁচলীর এই রচয়িতার অন্য নাম দাশু রায়। শৈশব থেকে তাঁর মামা রামজীবন চক্রবর্তীর কাছে প্রতিপালিত হন। স্থানীয় পাঠশালায় বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষালাভ করেন। শৈশব থেকে তিনি সেকালের জনপ্রিয় কবিগানে আসক্ত হয়ে পড়েন। এই সূত্রে তিনি অল্প-বিস্তর গানও রচনা করেন। যৌবনের প্রারম্ভে বাঁধমুড়া গ্রামের অক্ষয়া পাটনি নামক একজন নারী কবিয়ালের দলে যোগদান করেন। এখানে তিনি দলের জন্য গান রচনা করতেন। তাঁর মামা এতে বিরক্ত হয়ে, তাঁকে কবিগানের দল থেকে এনে সাকাই গ্রামের নীলকুটিতে মাসিক তিন টাকা বেতনে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কিছুদিন চাকরি করার পর, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার অক্ষয় পাটনির কবিগানের দলে যোগদান করেন। কবির লড়াইয়ে তিনি একবার প্রতিপক্ষ রামদাস স্বর্ণাকরের দ্বারা তিরস্কৃত হয়ে দলত্যাগ করেন। এরপর তিনি পাঁচালী রচনায় হাত দেন। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাঁচালীর আখড়া স্থাপন করেন। তিনি প্রচলিত পাঁচালীর রীতি ত্যাগ করে, কবি গানের মতো চাপান-উতোর ভঙ্গীতে পাঁচালীকে সাজান। একই সাথে উৎকৃষ্ট ছড়া যুক্ত করেন। তাঁর পাঁচালী অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। নবদ্বীপের পণ্ডিতরাও তাঁর পাঁচালীর প্রশংসা করেন। স্বভাবকবির গুণে তিনি একদিন আত্মীয়বর্গের আপত্তি সত্ত্বেও আকা বাঈর (অক্ষয় কাটানী) কবিয়াল দলে যোগ দেন এবং বিখ্যাত কবিয়াল নিধিরাম শুঁড়ির সঙ্গে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। এরূপ প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগত আক্রমণে অপমানিত ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি কবিগান ছেড়ে দেন এবং ১৮৩৬ সালে আখড়া গঠন করে ছড়া ও  পাঁচালী রচনায় মনোনিবেশ করেন।

অল্পদিনের মধ্যেই দাশরথি খ্যাতনামা পাঁচালীকার হিসেবে নবদ্বীপের পন্ডিতসমাজে উচ্চ প্রশংসিত হন। তিনি নিছক পৌরাণিক কাহিনী আশ্রিত ধর্ম ও ভক্তিরসের পাঁচালীকাব্য রচনা করেননি বরং অনুপ্রাসাদি অলঙ্কারযোগে ছড়ার চটুল ছন্দের ঝংকার, সঙ্গীতের সুরেলা মাধুর্য এবং রঙ্গ-ব্যঙ্গরস যুক্ত করে পাঁচালীকে বিভিন্ন শ্রেণির শ্রোতাদের উপভোগ্য করে তোলেন, যা ‘দাশুরায়ের পাঁচালী’ নামে খ্যাত। ধর্ম, সমাজ, নীতিশিক্ষা, রঙ্গ-কৌতুক, শ্লীল-অশ্লীল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করে নিজেই পরিবেশন করতেন। তাঁর গানগুলি রাগসুরে রচিত এবং তাতে টপ্পা অঙ্গের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বর্ধমানের মহারাজা এবং কলকাতার শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেব তাঁর গান শুনে তাঁকে পুরস্কৃত করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ক ৬৪টি পালাভুক্ত প্রায় ৬৭৫টি গান রচনা করেন। সেগুলি সংকলিত ও সম্পাদিত হয়ে ১৯৫৭ সালে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। হরিমোহন মুখোপাধ্যায় ৬৪টি পালার এক বৃহৎ সংস্করণ প্রকাশ করেন।

এই সূত্রে তিনি প্রচুর সম্পত্তির মালিক হন এবং পীলাগ্রামে একটি পাকা বাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। নানা ধরনের গানের পাশাপাশি তিনি ৬৮টি পালা রচনা করেন। তাঁর পাঁচালি সেকালের লোকশিক্ষা, ধর্মবোধ, সমাজচেতনা জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত 'বাঙালির গান' গ্রন্থে এঁর ২৭৫টি গান পাওয়া যায়।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কে নিয়ে আসেন এই স্বভাব কবি দাশরথি রায়কে এই কবি গানের আসরে? হ্যাঁ আমি আসছি অকা বাইজির কথায়। উনি যখন এসেছেন গাইতে তখন এই বাংলা বাইজি গানে স্নাত হয়েছিল। দাশু রায়ের অনেক আগে থেকেই পল্লী বাংলার এবং উড়িষ্যার বৈষ্ণব সম্প্রদায় এ গান গাইতেন। পরে নব্য বাবু সমাজের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ‘পাঁচালী’ গায়ন রীতি ও সুরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে, কৃষ্ণ উপাখ্যান থেকে রামায়ণ, মহাভারত ও মঙ্গল কাব্য এ গানের বিষয় বস্তু হয় এবং কীর্তন, আখড়াই, টপ্পা ও কবি গানের কিছু সংমিশ্রণ ঘটে। আধুনিক ‘পাচালী’ গানের প্রথম রূপকার ছিলেন লক্ষীকান্ত বিশ্বাস। আনুমানিক ১৮২০তে লক্ষীকান্তর মৃত্যু হয়, দাশরথি রায় তখন কিশোর। আর লক্ষীকান্তর পরেই এলেন দাশু রায়। ঠাকুর পরিবারের সবাই উনার গান শুনতেন। উনি ছিলেন বাংলার লোকায়ত সংগীতের একজন শ্ৰেষ্ঠ রূপকার। এই দাশু রায়কে নিয়ে এলেন আসরে অকা বাইজি। একজন বাইজির সাথে এত দহরম মহরম শিল্পীরা মেনে নিতে পারছিল না। অকাবাই এর গলা শুনে এবং রূপে দাশরথি রায় মুগ্ধ হলেন।

অকাবাই বললেন তুমি আমাদের দলের হয়ে গান বাঁধ। গায়করা আসরে ঘুরে ঘুরে গান গাইতো আর বাঁধনদার তাঁর কথা লিখে দিতেন। এই ভাবে পথ চলা শুরু হয়। দাশরথি রায় এবং অকাবাইকে সবাই প্রায় ঘেন্না ও বিদ্বেষের সুরে শুধু গানের মধ্যে দিয়ে নয় ,আসরের বাইরেও অপমান করতে লাগলেন।তাঁরা কেউ সেইদিন বোঝেনি এই জবাব সে একদিন দিয়ে দেবে।

যাই হোক অকাবাই তাঁকে বললেন, ‘রায়, তুমি ফিরে যাও। আমার জন্য এত কলঙ্ক তুমি মেখো না।তোমার কলঙ্ক তো আমার পাপ থেকেই।’ দাশরথী বললেন, ‘আমাকে ছেড়ে অকা তুই বাঁচতে পারবি?’ অকা বললেন, জানি রায় সে খুব কষ্টের। কিন্তু আমাকে পারতেই হবে। তোমাকে ভালবাসি কিনা।’ দাশরথী বললেন, ‘আমি গেলে তুই কী করে বাঁচবি অকা?’ অকাবাই বললেন, ‘আমার কথা ভেবো না রায়। আমি ভিক্ষে করে বাঁচব। আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তুমি আমারই থাকবে। কিন্তু তোমার এমন দশা আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি অনেক বড় কবি হবে রায়। কিন্তু আমার কাছে থাকলে তুমি সব হারাবে। যাও রায়। তোমার সামনে অনেক বড় কাজ।’ দাশরথী বললেন, ‘তোকে আমি বাঁধমুড়ায় নিয়ে যাব অকা।’ অকাবাই বললেন, ‘সে হয় না রায়, আমার এ মুখ তোমার বাড়ির লোকেদের কি আমি দেখাতে পারি!’ দাশরথী চুপ করে থাকেন। কোন কথা বলতে পারেন না। একটু পরে তিনি গান ধরলেন, ‘দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা...’ চোখের জলে ভাসেন অকাবাই। দাশু রায়ও ব্যথায় কাতর হয়ে ওঠেন। অন্ধকার রাত্রি আরও অন্ধকারে ডুবল দুটি ব্যথিত প্রাণের অস্ফুট কান্নায়। এরপর বাকিটা তো ইতিহাস।

তাঁর গানে কি এমন ছিল যে ইতিহাস গড়ে তুললেন। তাঁর গান 'নবরসের' ভাণ্ডার। তাঁর গান বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত হয়ে পড়ে। বালক থেকে বৃদ্ধ, প্রাসাদবাসী থেকে কুটিরবাসী, গ্রামের মানুষ থেকে শহরের মানুষ সবার কাছেই তাঁর গান ছিল উপভোগ্য। তিনি যে দল তৈরি করেন বাদক দুয়ারী নিয়ে তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রথমে তিন টাকা থেকে পরে শত মুদ্রাতেও তাঁর দল দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। তাঁর পাঁচালী নানা পালায় বিভক্ত ছিল। সবই পুরাণ ও ঐতিহ্যের কাহিনি।  ঝাঁপতাল, যৎ, ঢিমে তেতালা, একতালা, আড়া, পোস্তা, খয়রা, কাওয়ালি প্রভৃতি তালের সাথে সিন্ধু মল্লার, ললিত, ঝিঁঝিট, সুরট, সিন্ধুভৈরবী, খটভৈরবী, আলিয়া, অহং, খাম্বাজ, জয়জয়ন্তী প্রভৃতি রাগ রাগিনীতে গান বেঁধেছিলেন। প্রায় চৌষট্টি ধরণের পাঁচালী রচনা করেছিলেন। বৈচিত্র্য তাতে অনেক বেশি। গোষ্ঠলীলা, কালীয়দমন, মাথুর, কলঙ্কভঞ্জন, গোপীগণের বস্ত্রহরণ, বামনভিক্ষা, তরণীসেনবধ, মহিষাসুর বধ প্রভৃতি পালাগুলি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিদ্যাসাগর মশাইকে তিনি প্রশংসা করেছেন। ঈশ্বর গুপ্তের নিন্দা করেছেন।

"এলেন গুণের সাগর বিদ্যাসাগর, বিধবা পার করতে তরির, তরির গুণ ধরেছে গুননিধি।..."

"ঈশ্বর গুপ্ত অল্পেয়ে, নারীর রোগ চেনে না বৈদ্য হয়ে

হাতুড়ে বৈদ্যতে যেন বিষ দিয়ে, দেয় প্রাণে বধি।"

দাশরথি রায়ের কিছু গান তো অমর হয়ে আছে। তিনি শব্দ ব্যবহারের কৌশলে মোহিত করেছেন। সিন্ধুমল্লারে রচিত তাঁর সেই গানের পঙক্তি:

"সেকি কাল দেখে এলি কাল সায়

কালের কাল যায়, যে কালপূজায়

সেই কাল দরশনে, জীবের কাল দরশন যায়।"

তাঁর গানে অনেক চটুল আদিরস থাকলেও ভক্তিতেও তিনি ভরপুর ছিলেন

"দোষ কারো নয় গো মা।

আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।"

বঙ্কিম চাটুজ্যে যিনি সাহিত্যকে শ্লীল ধারায় স্থাপন করেছিলেন তিনিও। দাশরথি রায় সম্পর্কে দরাজ ভাবে বলেছেন "যিনি বাংলা ভাষায় সম্যকরূপে ব্যুৎপন্ন হইতে বাসনা করেন তিনি যত্নপূর্বক আদ্যোপান্ত দাশু রাযের পাঁচালী পাঠ করুন।" দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বালক রবীন্দ্রনাথও দাশু রায় শুনতেন।

বাংলা গানে পাঁচালীর সাথেই হেঁয়ালি ছড়ায় উত্তর- প্রত্যুত্তরে যে গান প্রচলিত হয় তাকে আর্যা বলা হয়। এই আর্যা গান রূপ বদলে হয় তর্জা গান। মানুষকে আনন্দ দেওয়াই ছিল এই গানের উদ্দেশ্য। এই গানের পরম্পরা আজও চলে আসছে। এটি বাংলা গানের খাঁটি লৌকিক পর্যায়। অদ্ভুত কথা হলো এই গোপাল উড়ে আর দাশু রায়, এই দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল একই সালে ১৮৫৭। ঠিক সিপাহী বিদ্রোহের এক বছর আগে।

মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, দুর্বাসার আহার প্রভৃতি বিষয় নিয়েও তিনি পালা লিখেছেন। সে কালের শাক্ত বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব, বিধবা বিবাহ, কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উপাসনা পদ্ধতি, প্রভৃতি বিষয় নিয়েও তিনি পালা লিখেছেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, নবীনচাঁদ ও সোনামণি, নলিনী-ভ্রমরের বিরহ, ভেক-ভৃঙ্গদ্বন্দ্ব— এগুলিতে সামাজিক উপাদান যৎকিঞ্চিৎ থাকলেও এই রঙ্গপালাগুলি লীলাচ্ছলে রচিত হয়েছে। দাশরথি রঙ্গকৌতুক সৃষ্টির জন্য এবং তারই সঙ্গে কথার রূপকের সাহায্যে চাবুক চালিয়েছেন। এর পিছনে স্পষ্ট ভাবে লোকশিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, তারও চেয়ে ছিল শ্রোতাদের স্থূল অনুভূতির কেন্দ্রে মোটা হাতের সুড়সুড়ি দেওয়া।’

পুরাণ থেকে কাহিনী নিলেও দাশরথি সে কালের যুগবৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ‘লোকরঞ্জন’-কে কোনওভাবেই উপেক্ষা করেননি। ফলে তাঁর পালায় এক দিকে যেমন সংস্কৃত শব্দের ঝঙ্কার শোনা গিয়েছে, অন্য দিকে তেমনই দেখা গিয়েছে প্রচলিত লোকশব্দের সার্থক ব্যবহারে অনুপ্রাস ও যমক সৃষ্টির প্রয়াস। লোকরঞ্জনের জন্য তিনি তাঁর পালায় এমন কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, যাকে আজকের যুগে ‘অশালীন’ বলে মনে হতে পারে কিন্তু সেই কালের জনরুচিকে তৃপ্ত করতে অন্য কোনও পথ অবলম্বন করার উপায় তাঁর সামনে ছিল না।

সব শেষে বলতে হয় দাশরথি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিটিই বড় বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়— ‘দাশুরায়ের পাঁচালী দাশরথির ঠিক একলার নহে;— যে-সমাজ সেই পাঁচালী শুনিতেছে, তাহার সঙ্গে যোগে এই পাঁচালী রচিত। এইজন্য এই পাঁচালীতে কেবল দাশরথির একলার মনের কথা পাওয়া যায় না— ইহাতে একটি বিশেষ কালের বিশেষ মণ্ডলীর অনুরাগ-বিরাগ, শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-রুচি আপনি প্রকাশ পাইতেছে।’(সাহিত্যসৃষ্টি, সাহিত্য)।

তথ্যঋণ: ১) বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (চতুর্থ খণ্ড): অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ২) বাংলার সাহিত্য-ইতিহাস: সুকুমার সেন, ৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (দ্বিতীয় পর্যায়): ভূদেব চৌধুরী, ৪) বঙ্গভাষা ও সাহিত্য: দীনেশচন্দ্র সেন।

বাঙালির গান। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি।পৃষ্ঠা: ২০৭-২৫১।

সংসদ বাংলা চরিতাভিধান,  প্রথম খণ্ড। সাহিত্য সংসদ। জানুয়ারি ২০০২।

আনন্দবাজার।

(www.theoffnews.com - Dasharathi Roy Panchali)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours