পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

‘কাহানি’ ছবির নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকিকে মনে আছে? সিবিআই অফিসার রূপে কি হম্বিতম্বিই না করছিলেন। কলকাতা পুলিশের কর্মী থেকে আধিকারিক সকলেই কেমন ভিজে বেড়াল তার সামনে। যখন তখন চাকরি খেয়ে নেওয়ার ভয় দেখানো, চোটপাট, এ সব দেখে আমআদমির মনে হতেই পারে সিবিআই অফিসারের না জানি কত ক্ষমতা। তবে সিনেমা বা সিরিজে সিবিআই এর যে প্রতাপ বা কুশলতা দেখা যায় বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও আছে বলে মনে হয় না। পুলিশ আমাদের কাছেই থাকে, নজরেই থাকে তাই তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের বেশ জানা আছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতার সামনে পুলিশের ক্ষমতা আমাদের বিশেষ জানা। কিন্তু সিবিআই? সিনেমা দেখা সাধারণ মানুষের কাছে সে তো স্বপ্নের নায়ক। 

এই স্বপ্নের নায়কেরাই গেলেন কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে গ্রেফতার করতে। শুনেই রক্ত টগবগ করে উঠল। এই তো চাই, বাঘের বাচ্চা। দুর্নীতি করলে কমিশনারকেও ছাড়ে না সিবিআই। ওমা তারপরে এ কি কাণ্ড, সিবিআই অফিসারদেরই আটকে রাখল পুলিশ। কমিশনার তো দূরে থাক, একটা কনেস্টবলকেও ধরতে পারল না তারা। নিজেরাই কোনও মতে ছাড়া পেল, জানা গেল কমিশনার পদমর্যাদার কাউকে ধরা এত সহজ নয় নাকি! ব্যস বোঝা গেল সিবিআইয়ের ক্ষমতা। নেট বলছে ভারতীয় তদন্তকারী এই সংস্থার সাকসেস রেট ৬৫%। তা হতে পারে, কিন্তু সিবিআই এর ব্যর্থতার তালিকাও বেশ লম্বা এবং হতাশাদায়ক।

২০০৪ সালের  ২৫ মার্চ বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন থেকে চুরি যায় নোবেল পদক। কিছুদিন পর এই নোবেল পদক চুরির তদন্তভার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তুলে দেন সিবিআইয়ের হাতে। নোবেল চুরির তদন্ত আমার সামনে দেখা। সিবিআই কর্তারা গাড়ি চেপে এসে কি তদন্ত করেছিলেন তা জানি না কিন্তু মনে আছে খাওয়ার দাওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েক হাজার টাকার ডাবের জলের বিল করা হয়েছিল। সে খবরও করেছিলাম। খুব আশা ছিল এর একটা বিহিত হবেই।  শেষমেশ সিবিআই ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বোলপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত শেষে এক রিপোর্টে জানিয়ে দেয়,  তারা চুরির কিনারা করতে পারেনি। হয়ে গেল, কিন্তু হল না। পরের বছর আবার সিবিআই আবেদন করে জানায় তারা ফের এই তদন্ত করবে। আদালত তাতে অনুমতি দেন। কিন্তু কার্যত সিবিআই আবারও ব্যর্থ হয় নোবেল চুরির কিনারা করতে। সিবিআইয়ের ব্যর্থতার ইতিহাসে নোবেল চুরির কিনারা করতে না পারাটা বাঙালি হিসেবে আজও বড় ব্যথা দেয়।

এছাড়াও সিবিআই-এর বিভিন্ন তদন্তের সাফল্যের হার খুবই হতাশা জনক। বড় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের ব্যর্থতার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমেই আসি ২জি কাণ্ডে। প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার ২জি কেলেঙ্কারি কাণ্ড থেকে বেকসুর খালাস হন প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা ও ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি। কারণ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয় সিবিআই। আদালতে বিচারকের কাছে তাদের অপদার্থতার জন্য ভর্তসিত হন সিবিআই আধিকারিকেরা। এখানেই শেষ নয় রয়েছে আরুষি হত্যা কাণ্ড, কয়লা কেলেঙ্কারি, কর্ণাটকের বেল্লারিতে অবৈধ খনি কেলেঙ্কারি সহ একাধিক তদন্তের ব্যর্থতা। সারদা, রোজভ্যালি বা অন্যান্য চিট ফান্ড তদন্তগুলির কথাই যদি ধরি তাহলে সেখানেও তো অগ্রগতির কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, প্রায় সাত বছরের পরেও। আমি রাজনীতির লড়াই নিয়ে কোনও প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার মত সাধারণ মানুষের একটাই কথা যে, সিবিআই-এর কাছ থেকে তেমন কিছু প্রত্যাশা না করাই ভাল। মাঝে মধ্যে কোনও কোনও তদন্ত কোনও একটা বিশেষ কারনে জেগে ওঠে আবার তা ঘুমিয়ে পড়ে বিশেষ কোনও কারনেই।

এই যে ভোটের আগে হঠাৎ তৎপর সিবিআই। কয়লা পাচার, বালি পাচার রোধে ব্যপক ধরপাকড়। সারদা সহ নানা চিটফান্ড কাণ্ডে হঠাৎ ঢেউ উঠেছে। অজ্ঞাত শীতঘুম ভেঙে সিবিআই আধিকারিকেরা বিভিন্ন নেতাদের ডেকে পাঠাচ্ছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, এসব কি আমজনতা বোঝেন না? বোঝেন সবই, হাসাহাসি করেন, টিটকারিও দেন। কিন্তু এই নাটক চলতেই থাকে। এতেই আরও প্রকাশিত হয়ে পড়ে সিবিআইয়ের অসহায়তা। যে মামলায় কেন্দ্রের বিরোধী দলের নেতাদের ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তৎপর সিবিআই, সেই একই মামলাতে শাসক দলের নেতারা বসে থাকেন নিশ্চিন্ত মনে। বড্ড চোখে লাগে।

এবারের ভোট যুদ্ধও ব্যতিক্রম নয়। ভোট আসার কিছুদিন আগে থেকেই প্রত্যাশিত ভাবে নড়েচড়ে বসেছে সিবিআই। না, আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে এই সিবিআই তৎপরতাকে মোটেই খাটো করতে চাইছি না। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো মনে জাগে এতদিন ধরে সারদা, নারদা, রোজভ্যালি সহ এক ঝাঁক চিটফান্ড মামলা চলছে সিবিআইয়ের ভূমিকা ঠিক কি? ভোট মিটে গেলেও কি এই কর্মচঞ্চলতা বজায় থাকবে? কয়লা, গরু, বালি পাচার তো এ রাজ্যে নতুন কিছু নয়। তাহলে এত দিন এ নিয়ে কেন হৈচৈ হয়নি? ভোট মিটে গেলে কি এই হৈচৈ আবার থেমে যাবে? এখানেই গতি হারায় আমার প্রশ্নটা। তাহলে বার বার এই নাটক কেন? আসলে আমরাও জেনে গিয়েছি একান্নবর্তী পরিবারের সুখী স্বপ্নের মত সিবিআই এর দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আধিকারিকেরাও বেঁচে থাকেন শুধুমাত্র সিনেমা সিরিজের পর্দায়। বাস্তবে এই পুতুল সিবিআই শুধুই খেলার সাথী কেন্দ্রের শাসকদলের।

(www.theoffnews.com - CBI)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours