সাজিয়া আক্তার, রেসিডেন্সিয়াল এডিটর (বাংলাদেশ), দ্য অফনিউজ:

লন্ডনের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম সুন্দরী ও আকর্ষণীয় নারী মেরি অ্যান ওয়েবস্টারের। তিনি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। পরিবার ও নিজের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন কাজে লেগে পড়েন মেরি। শুরুতে একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে চাকরি করেন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া মেরির স্বপ্ন ছিলো, ভালো পরিবারে তার বিয়ে হবে এবং সুখে সংসার করবেন। তার এই স্বপ্নটি সত্যি হয়েছিল ২৯ বছর বয়সেই। 

তিনি টমাস বেভানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সুখী জীবনযাপন করছিলেন তিনি। চার সন্তানের জন্মও দেন মেরি। সবকিছু ঠিকই চলছিলো, কিন্তু শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে থাকেন মেরি। মাইগ্রেন এবং পেশি ও জয়েন্টের ব্যথায় দিন দিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি।

এদিকে চিকিৎসকরা তার কোনো রোগই শনাক্ত করতে পারছিলেন না। পাশাপাশি মেরির মুখ অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যাচ্ছিলো। তার সুন্দর চেহারা বিকৃত হতে শুরু হয়। যেন রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছিলো তার চেহারা। অনেকটা প্রাণীর মতো চেহারা হয়ে যায় মেরির। চেহারা থেকে মেয়েলি ছাপ পুরোপুরি চলে যায়।

চিকিৎসকরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশেষে মেরির রোগ শনাক্ত করতে পারেন। তার যে রোগ হয় সেটি, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘অ্যাক্রোম্যাগালি’ নামে পরিচিত। এটি একটি নিউরোএন্ডোক্রাইন ডিসঅর্ডার। যার ফলে শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে হরমোনের বিকাশ ঘটে। যা হাড়, অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং নরম টিস্যুর বৃদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

এ রোগটির সাধারণ লক্ষণ হিসেবে শুধু প্রকাশ পায় মাথা ব্যথা এবং পেশি ব্যথা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাক্রোম্যাগালিটি টিউমারের কারণে ঘটে, যা পিটুইটারি অ্যাডেনোমা হিসাবে পরিচিত। যদিও বর্তমানে চিকিৎসকরা এ রোগটি সফলভাবে নিরাময় করতে পারেন। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিরল এ রোগটি মেরিকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী মেরি প্রাণীর মতো হয়ে যান।

মি. বেভান সর্বদা তার স্ত্রী মেরির সঙ্গে থাকলেও বিয়ের ১১ বছরের মাথায় মারা যান তিনি। চার সন্তান ও নিজের অসুস্থতা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মেরি। তার কাছে কোনো অর্থই ছিল না। চিকিৎসার পিছনেও অনেক অর্থ খরচ হচ্ছিলো।

এরপর শুরু হয় মেরির জীবন যুদ্ধ। তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত নারীর তকমা পান মেরি। কারণ যেখানেই তিনি চাকরির জন্য যাচ্ছিলেন; সেখান থেকেই তার চেহারার জন্য তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। রাস্তার লোকেরা তাকে অপমান করত।

এরপর মেরি জানতে পারেন ‘ওয়ার্ল্ডস ইউজালিস্ট নারী প্রতিযোগিতা’র কথা। যেখানে তার মতো হরমোনজনিত সমস্যার শিকার অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়ে মোটা অংকের অর্থ পুরষ্কার পান তিনি। এরপর গণমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ হয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে মেরির নাম ও তার দুর্ভাগ্যের করুণ কাহিনি। এ প্রতিযোগিতাটি এখনও ইংল্যান্ডে জনপ্রিয়। মেরির নাম-ডাক ছড়িয়ে পরলেও তিনি আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেননি।

যাইহোক, মেরি সেখানে উপস্থিত হন। শুধু তিনিই নন, তার পাশে আরও ছিলেন দাড়িওয়ালা নারী, বামন, দৈত্যের মতো মানব এবং সিয়ামিস যমজ- যাদেরকে দেখে উপস্থিত দর্শকেরা আনন্দ পেয়ে হাসি-ঠাট্টা ও করতালিতে শো জমিয়ে তুলেছিলেন। মেরি এ দলের অন্যতম ছিলেন। যদিও এটি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো মেরির; তবে সন্তানদের কথা ভেবে সব মেনে নিয়েছিলেন।

মা হিসেবে সন্তানদের প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন মেরি। তিনি বাকি জীবন একটি সার্কাসে কাটান। ১৯২৫ সালে তিনি যখন প্যারিসে একটি শোয়ের জন্য যান; তখন তিনি ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পান। দুর্ভাগ্যক্রমে, অ্যাক্রোম্যাগলিতে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষেরা বেশিদিন বাঁচেন না। মেরি ১৯৩৩ সালে ৫৯ বছর বয়সে মারা যান।

মেরি আজও ইতিহাসে একজন মমতাময়ী মা হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। শত কষ্টেও যে একজন মা তার সন্তানকে ছেড়ে দেন না; তারই উদাহরণ রেখে গিয়েছেন মেরি। তিনি রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে গিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত চেহারার নারী হয়েও মেরি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তার কর্মগুণে।

(www.theoffnews.com - Mary Ann Webster)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours