তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

প্রথম চিরুনি তৈরি করেছিলেন মিসরের মানুষ, ঐতিহাসিকভাবে এটাই সবাই দাবি করে। আবার কেউ বলে সুইডেনই প্রথম আবিস্কারক। চিরুনি যতদিন মানুষের হাতে আসেনি, ততদিন জটাধারী মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল, সন্দেহ নেই। বিদেশী পর্যটকের মতে একটা সময়ে সব মানুষকেই সাধু মনে হতো চিরুনির অভাবে।চিরুনির অভাবে প্রাচীন মানুষের মাথায় পোকা জন্মে রোগ হতো এবং মৃত্যুও ঘটতো- এগুলো জানা কথা।

মিসরে চিরুনির আবিষ্কার হয়েছিল খ্রীস্ট জন্মের কিছু আগে এবং ভারতে আধুনিক চিরুনি এসেছিল অনেক পরে। মোটামুটি খ্রীস্ট জন্মের ৫০০ থেকে ৭০০ বছর আগে। কিন্তু সেই চিরুনির সঙ্গে বর্তমান চিরুনির কোনও সম্পর্ক নেই।

যাই হোক  ভারতের ইতিহাস বিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা  বলছেন শিল্পকর্মে হাতির দাঁতের ব্যবহার খ্রীস্টজন্মের বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়েছে। প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতায় (খ্রী.পূ ২৩০০-১৭৫০) হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম জনপ্রিয় ছিল। ১৯২০ সালে খননকার্যের ফলে সেখানে হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর মুর্তি, খোঁপার কাটা, চিরুণি, বোতাম ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়। সিন্ধু এলাকায় হাতির বসতি না থাকলেও হাতির দাঁতের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। বিহারের চম্পানগরে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হাতির দাঁতের নারীমুর্তি ও খেলনা পাওয়া গেছে। 

ভারতে হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের প্রধান বাজার ছিল ইউরোপ। ব্রিটিশরা আফ্রিকা থেকে হাতির দাঁত আনিয়ে ভারতীয় কারিগরদের দ্বারা শিল্পকর্ম তৈরি করিয়ে সেগুলি ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করত। ভারতীয় জঙ্গলে এবং রাজা-মহারাজাদের পোষা মৃত হাতি থেকেও হাতির দাঁত সংগৃহীত হতো। এ সময় ভারতের লুধিয়াল, পালি, জয়পুর, কেরালা, মহীশূর, আসাম ও বাংলা এই শিল্পকর্মের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এ শিল্পকর্মে কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী বা শ্রেণী নিয়োজিত ছিল না। ব্রাহ্মণ সহ সব বর্ণের হিন্দু এবং মুসলমানরা এ কাজে নিয়োজিত ছিল। উল্লেখ্য, এই শিল্পে উপাদান হিসেবে শুধু হাতির দাঁতই নয়, অন্যান্য প্রাণীর দাঁত ও হাড় ব্যবহৃত হতো। এই দেশে খ্রীস্টের বহু বছর আগে যে সব চিরুনি তৈরি হতো এবং রপ্তানি হতো সেই সব চিরুনি দেখে বাড়ির শৈলীরুচি বোঝা যেত।

মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য, ভদ্রস্থ চিরুনি উপমহাদেশে এসেছিল ব্রিটিশ শাসনের আগে। সেগুলো ছিল কাঠ, পশুর হাড়, মোষের সিং, হাতির দাঁত, কচ্ছপের খোলা ও পিতলের তৈরি। আর সেগুলো ছিল রাজা-উজিরদের ব্যবহারের জন্য। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কলকাতা ও ঢাকায় পশুর হাড় থেকে সামগ্রী তৈরির কারিগরেরা চিরুনি বানাতো। কিন্তু তখনও চিরুনি শিল্প হিসেবে উঠে আসেনি।

১৮২৪ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ লাইন সাহেব ইংল্যান্ডে প্রথম রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে চিরুনি তৈরি করেন। সেই চিরুনি ১৯ শতকের মাঝামাঝি অবিভক্ত ভারতে আসে। তবে সেই সময় জার্মানির গাটাপার্চারের চিরুনি সারাবিশ্বে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯ শতকের শেষের দিকে সেলুলয়েডের চিরুনি জাপানে কুটিরশিল্প হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে তা ছড়িয়ে পড়ে চীন ও ইউরোপের দেশগুলোতে। তখনও ভারতীয় উপমহাদেশে চিরুনি শিল্প গড়ে ওঠেনি। অন্ততঃ ইতিহাসে এমন কোনও তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

চিরুনিশিল্পের সঙ্গে যে মানুষটির নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন মন্মথনাথ ঘোষ। যশোরের ঝিনাইদহের মথুরাপুরের মন্মথবাবু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে কারিগরি বিদ্যা শিখে স্বদেশী কারখানা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯০৬ সালে জাপানে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরামর্শ নিয়েছিলেন। বহু কষ্টে তিনি সেখানে চিরুনি তৈরির কৌশল শিখে ১৯০৯ সালে দেশে ফিরে যশোর শহরে ১৯১০ সালের মাঝামাঝিতে প্রথম চিরুনি কারখানা স্থাপন করেন। এই কারখানার সব যন্ত্রাদি এসেছিল জাপান থেকে। এই কাজে তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যশোরের জমিদার প্রমথভূষণ দেবরায়, কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ও বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাপ বাহাদুর মহাশয়। কারখানার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘যশোর কম্ব বাটন অ্যান্ড ম্যাট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড’। এলাকার প্রচুর যুবককে এ কাজে তিনি নিয়োগ করেছিলেন। এই চিরুনি সারাবাংলা, সারাদেশে জনপ্রিয়তা পায়। সেই সঙ্গে বিদেশের চিরুনি বিক্রি কমে যায়।

মন্মথবাবু কলকাতা, হাওড়াতে পরিচিত বন্ধুদের চিরুনি কারখানা গড়ায় উৎসাহ দিতে থাকেন। কিন্তু তার এই স্বদেশী কাজকে সহ্য করতে পারেননি দেশের অনেকেই। তার জাত গিয়েছে বলে, তাকে একঘরেও করা হয়েছিল তখন। ব্রিটিশ পুলিশও পিছনে লেগেছিল তার। শেষ পর্যন্ত ১৯১৯ সালে তিনি তার চিরুনি কারখানা নিজের ভাই ফনীভূষণের হাতে সঁপে দিয়ে কলকাতায় গড়পাড় রোডে চলে যান। কলকাতায় গিয়ে তিনি চিরুনি তৈরির মেশিন বানানোর কারখানা গড়েছিলেন। কিন্তু সেই কারখানায় উৎপাদন শুরুর আগেই তিনি ১৯৪৪ সালে প্রয়াত হন। তার সেই কারখানা আজও আছে মানিকতলার খালপাড়ে।

দেখুন এই মন্মথ ঘোষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন আবার একই সাথে কি করে বাঙালির ব্যবসা বাড়ানো যায় সেই ব্যাপারেও সচেতন, শুধু সচেতন ভুল হবে।অন্য বাঙালিকেও ব্যবসার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বলতে লজ্জা করছে। এই বাঙালি এখন সত্যি দুর্লভ।

(www.theoffnews.com - comb history)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours