মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথে অভিজ্ঞতার ঝুলি ক্রমেই পূর্ণ হয়ে উঠছে। কর্মসুত্রেই হোক বা গার্হস্থ্য যাপনে, বেশ কিছু ছবি টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে ওঠে মানসপটে। সেগুলো সাজিয়ে নারীদের দেখি নিজস্ব আলোকে।

দৃশ্য এক

বাসন মাজা হয়ে গেলে আগে খেয়ে নে। গলা চড়িয়ে চল্লিশোর্ধ্ব গৃহবধু রিমা তার কর্মসহায়িকার উদ্দেশে এই কথাগুলো বলেই দ্রুত কড়াইতে সব্জি ঢেলে খুন্তি দিয়ে নেড়ে চলে। ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই চলে রোজকার রান্না, সংসারের খুঁটিনাটি। আজ তাকে দুবেলার কাজ একবেলায় সারতে হবে কারণ সন্ধ্যায় তার আমন্ত্রণ আছে এক বড় সাহিত্য সভায়, নারীদিবস উপলক্ষ‍্যে বিতর্ক সভায় অংশ নিতে হবে। দশভূজা হয়ে প্রতিদিনই সব সামলায়। আজও তার ব্যতিক্রম নেই। এসবের মাঝেই দ্রুতহাত চলে মোবাইলের কি বোর্ডে। সংসারের দশজনের ফরমায়েশ খাটতে খাটতে ভুলেই গিয়েছিল যে আর্টিকেলটা আজকেই সম্পাদকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। শত কাজেও এই লেখালেখিই তাকে বাঁচার রসদ যোগায়। সকলের সব দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে তার নিজের খিদেটা মরে যায় রোজ একটু একটু করে। মামনি খাওয়া সেরে মাথা নিচু করে নিজের বরের হাতে মার খাওয়ার কথা শোনায় আর পাঁচটা কাজের মেয়ের মতই। শাশুড়ির চোখ বাঁচিয়ে এককাপ দুধ এগিয়ে দেয় মামণির দিকে। তারপর বলে, "তুই রাজি থাকলে আমি তোর বরের জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।" মামণি জানে এই বৌদি অনেক বড় লেখক। অনেক বড় বড় লোকের সাথে সেই সুবাদে যোগাযোগ। তবুও বৌদি কেন সরকারি চাকরি ছেড়ে সারাদিন সংসারে সবার জন্য বেগার খাটে তা সে আজও বোঝেনি। মামনি মাথা নেড়ে বলে, "বাদ দাও বৌদি। মেয়েমানুষের সবই কপালের দোষ।" আবার কাজে লেগে পড়ে সে। রিমাও মনে মনে হয়ত তাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সেও মামণির মতই আবার কাজে লেগে পড়ে। 

দৃশ্য দুই

আজ সকাল থেকে নেট অফ রেখেছে তুলি। সব কাজের শেষে একটু ফেসবুক ও নেট সার্চ করে পড়াশোনা করা অভ‍্যেস তুলির। মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কদিন ধরেই আকাশের ক্রমাগত ব্যাঙ্গের ভার আর নিতে পারছে না সে। দুজনের সংসারে ও নিজের পেশাগত সব কাজ সেরে নিজের সময় বার করলেও আকাশ বলে, "করো তো ঐ বাংলা মিডিয়ামের প্রাইমারি স্কুলের চাকরি। আর একটু খুন্তি নাড়া। সারাদিন তো ফেসবুকেই চলে যায়। সংসারটা ঠিক করে করতে পারো না।" অপরাধ বোধে ভুগতে ভুগতে ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হয় তাকে আজকাল। 

দৃশ্য তিন

পাত্রী আমাদের পছন্দ, কিন্তু আমার ছেলে নিজেই এতবড় ডাক্তার। তাই আপনার মেয়ের রোজগারের কোন প্রয়োজন নেই। তাছাড়া মেয়েরা যদি চাকরী করবে তবে সংসার করবে কি করে? চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলি বলে পাত্রের মা। ইঞ্জিনিয়ার পাত্রীর বাবা চুপ। মা বলে, "না না দিদি, সে বিয়ের পর আপনারা যা বলবেন তাই শুনতে হবে। আমরাও তো শ্বশুরবাড়ির কথামতই চলছি এখনো। বলুন।" 

দৃশ্য চার

সকাল থেকেই আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে এখানের সব মেয়েরা। আজ মেয়েদের দিন নাকি। তাই আজ খবরের কাগজ, টিভির দাদা দিদিদের ভীড় লেগেছে। আর পার্টির নেতা গুলো সব ভালো ভালো কথা বলছে। কিসব অধিকার, কর্মী এসব বলছে। টুসুর কিন্তু বেশ ভালো লাগছে। ঘোর কাটল পামেলার ডাকে। পামেলা ফিসফিস করে বলে, "আজকের দিনটা, শুধু আজকের দিনটায় আমরা কেবল যৌন কর্মী। বাকি সব দিন ঘেন্নার চোখে দেখা বেশ্যা।" টুসু সব বুঝেও কেমন না বোঝার ভান করে।

এই সব দৃশ‍্য‍গুলো ঘুরে ফিরে ছড়িয়ে যায় ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর প্রতিটি অংশে দেশে বিদেশে সব নারীর যন্ত্রণার ক্যানভাসে।

স্থান, কাল আর নাম বদলে যায় শুধু। ধর্ষিতা মেয়ের কান্না আজও জাত পাত আর রাজনীতির চিৎকারে ঢাকা পড়ে। ছোট পোশাক পরার অপরাধে সমাজের চোখে দোষী হয় মেয়েবেলা। বংশে বাতি দিতে পুত্রসন্তানের আশায় আজও কন্যাভ্রুণ হত্যা হয়। তবুও যখন নিজের বিয়ে ভেঙে পড়াশুনো করার স্পর্ধা দেখায় নাবালিকা, শিকল ভাঙার শব্দ শোনা যায়। 

পাচার হওয়া মেয়েরা যখন উদ্ধার পেয়ে সম্মানের জীবন পায়, বুকের ভেতর ডানা মেলার শব্দ ওঠে।

সেনাবাহিনী থেকে ট্র্যাকচালক সব জায়গায় পুরূষদের সাথে সমানতালে এগিয়ে চলে মেয়েরা,

অর্ধেক আকাশ তখন ঢেকে যায় বিশাল ডানায়। মুক্তির গান গায় মানুষ। 

(www.theoffnews.com - international women's day)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours