সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। আপনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ক একাধারে। আপনি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে গিয়ে গতকালে তাদের সুবর্ণজয়ন্তী স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে বলেছেন, সেই দেশের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য আপনি ভারতে সবান্ধব সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সামিল হয়ে জেলে গিয়েছেন। তখন আপনি বছর বাইশের যুবক।

এই ঘটনার সত্য মিথ্যা প্রকৃতই আমার বা আমাদের অনেকের জানা নেই। এদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ও স্যোসাল প্ল্যাটফর্মে আপনার মন্তব্য ঘিরে শুরু হয়ে গিয়েছে তুমুল পোস্ট ট্রোল। যা একটু পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় দেশবাসী আপনার মন্তব্য প্রসঙ্গে যথেষ্ট কৌতুহলী। কেউ কেউ তো টিপ্পনিও কাটতে শুরু করে দিয়েছেন এই ইস্যুতে।

প্রধানমন্ত্রীজী আপনি নিজের দেশের অভ্যন্তরে কোনও রাজনৈতিক নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে কোনও আলটপকা মন্তব্য যে করেননি এটা আমরা সবাই জানি। আবার কোনও বিরোধী দেশীয় নেতা এটা অতীতের কবর থেকে খুঁচিয়ে বের করে এনে আপনাকে বিব্রত করতে চাইছেন, তেমনটাও নয়। অন্যদিকে বর্তমানে সারা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আপনি পরিচিত। তাই আন্তর্জাতিক প্রোটোকলের নিখুঁত খুঁটিনাটি আপনার যে নখদর্পণে তা আপনার পরম রাজনৈতিক শত্রুও মানতে বাধ্য। সুতরাং এহেন দক্ষিণ এশীয় আন্তর্জাতিক মঞ্চে আপনি এই অবাক করা মন্তব্য যে অত্যন্ত সচেতন ভাবে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই দুই দেশের মানুষের কানে ভাসিয়ে দিয়েছেন এটা কিন্তু জলের মতোই পরিস্কার। অন্তত এমন আবেগঘন যুৎসই পরিমন্ডলে। প্রেক্ষাপটে কি পাটিগণিত আছে তা সময়ই বলবে। তবে অবশ্যই লক্ষনীয় এবং আরও মজার ঘটনা হল, আপনি যখন এই চমকে দেওয়া বক্তব্য রাখছেন পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে তখন সেখানেই চেয়ারে বসে বাংলাদেশের আপনারই কাউন্টারপার্ট শেখ হাসিনা আপনারই কথা শুনে মাথা নাড়াচ্ছিলেন। আশা করি এই সামগ্রিক আবহটা আপনার নজর এড়াবে না। এড়াবার কথাও নয় অনন্ত আপনার মতো ধুরন্ধর জনসংযোগীয় নেতার পক্ষে। দীর্ঘ সাত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে থেকেও যে কথাটি কোনও ভাবেই একদিনের জন্য আপনি উচ্চারণ করেননি দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, সেই অতীত জীবন উপাখ্যান তথ্যটি আপনি টুক করে সোনার বাংলার সাউন্ডবক্সে টুক করে ছেড়ে দিলেন শুধুমাত্র খেয়ালের বসে, এটাও অন্তত আপনার ন্যায় চৌখস হিসেবমুখী চতুর নেতার চরিত্রের সঙ্গে মিল খায় না।

দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের একাধিক প্রথম শ্রেণির সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি করার সুবাদে ও নিজস্ব ওয়েবনিউজের বাংলাদেশ এডিসনের সম্পাদনা করার ফলে আমার একটা অভিজ্ঞতা খুব সুস্পষ্ট। সেটি হল, বাংলাদেশের সিংহভাগ নাগরিক তা তাঁরা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু যেই হোন না কেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের আবেগ প্রশ্নাতীত ভাবে স্বর্গতুল্য। এই একটি ইস্যুতে তাঁদের ধমনীতে সবার একই হৃদয়মন্ডিত রক্ত একই গতিতে বইছে। দুনিয়ার সবকিছু বাংলাদেশীরা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে কিন্তু কোনও মূল্যে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আবেগের সঙ্গে আপোষ করতে রাজি নন। এমনই উচ্চমার্গীয় ভাবাবেগকে অত্যন্ত সুচারু ভাবে যে আপনি তালুবন্দি করতে চান এই সফরকালে তা কিন্তু আপনার এই নতুনতর মন্তব্যে পরিস্কার। আসলে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের নিঃশ্বাসসম-আবেগের সঙ্গে আপনার ভারতে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে (?) ট্যুইস্ট করে দিতে চেয়েছেন একই সরণিতে, অনন্ত যাতে আপনার ভাষণের মার্কশিটে ফার্স্ট বয়ের শিলমোহরটা অবশ্যই পড়ে, তাই না?

কিন্তু এই মার্কশিট প্রসঙ্গে একটা গভীর আস্থার প্রশ্ন অনেকটা লতানো গাছের মতো জড়িয়ে ফেলেছে দুই দেশের জনগণকে। তাই প্রধানমন্ত্রীজী এই প্রসঙ্গ যখন বিদেশ ভূঁইয়ে এসে আপনি নিজেই উত্থাপন করেছেন, তখন সেই বক্তব্যের সত্যতা প্রমানের পূর্ণ দায়িত্বও কিন্তু আপনার উপরেই বর্তায়। সুতরাং আশা করবো আপনার হোমওয়ার্কের সযত্নের ঝুলিটি আপনি নিজেই খুলে দেবেন অন্তত দুই দেশের জনগণের মধ্যে একটা আস্থা ও বিশ্বাসের সেতু বন্ধনের স্বার্থে।

বাংলাদেশে কিন্তু বর্তমানে সরকার বিরোধী আন্দোলন হামেশাই মাথা চাড়া দিচ্ছে। মৌলবাদের দাপট ক্রমেই উর্ধমুখী। আপনার সফর ঘিরেও কিছু অসন্তোষ বাংলাদেশের সরকারকে বিরম্বনায় ফেলেছে ইতিমধ্যেই। তবু শেখ হাসিনা আপনাকে তাঁর দেশে যথার্থ রাজকীয় মর্যাদা দিতে কার্পন্য করেননি। স্বাভাবিক ভাবেই অবিলম্বে আপনার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বাস্তব ঘটনার সঠিক বিবরণ প্রকাশ্যে আনুন। অন্যথায় আপনার কারণেই বাংলাদেশ নেত্রী তাঁর দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত জেহাদের অযথা শিকার হয়ে যেতে বাধ্য। কারণ বহুবিধ আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে মূলতঃ তাঁরই আমন্ত্রণে সোনার বাংলায় আপনি দুই দিনের সফরে গেছেন। ফলে আপনার সফরের নৈতিক দায় শেখ হাসিনা নিজের অবস্থান থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, পারবেনও না। মুক্তিযুদ্ধের আবেগের পুঁজি কুরোতে গিয়ে পরোক্ষে যাতে সেই দেশে আপনার নিশ্চুপিতার সৌজন্যে জেহাদি আগুন না লেগে যায়, সেই দায়িত্বটি কিন্তু আপনাকেও নিতে হবে প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। 

একইসঙ্গে ভারতের স্বভিমানের প্রশ্নটিও হাল্কা ভাবে দেখা উচিৎ নয়। আপনি এই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বক্তব্য রাখছেন যে ইস্যু নিয়ে সেই ইস্যুতে আজ আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারে সমগ্র ভারত। এটা কিন্তু কাম্য ছিল না ভারতবাসীর কাছে। কারণ দেশের বৃহত্তর অংশের জনগন আপনাকেই বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পদে অনেক দাবিদারের মধ্যে। ফলে আজ আপনি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। অতএব দেরি অনেক হয়ে গেলেও আজ কিন্তু প্রত্যাশার সময় আপনার দোড়গড়ায় কড়া নাড়ছে। আপনার বাইশ বছর বয়সের জেল খাটার নথি, তদানীন্তন পুলিশ থানার তথ্য ও প্রামান্য ছবি জনসমক্ষে দ্রুত প্রকাশ করুন। দুই দেশের জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই কাজটা কি কষ্টসাধ্য আপনার পক্ষে? নিশ্চয় নয়!

তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক। আপনারা রাজনৈতিক নেতা বলে কথা। আপনাদের তো একটা কথা দারুণ বিশ্বাস করেন, জনগন সব দ্রুত ভুলে যায়। ওষুধ হিসেবে শুধু কয়েকটা নিত্যনতুন বার্নিং ইস্যু সামনে তুলে নিয়ে আসো। ব্যাস তাতেই কেল্লা ফতে। বিস্মৃতির হিম ঘরে পাঠিয়ে দাও মুক্তিযুদ্ধের মোদী ইস্যু।

কিন্তু মোদী সাহাব, সরকারি কাঁটাতারের সীমান্তে সোনার বাংলা আর রূপসী বাংলা দুটি খন্ডিত রাষ্ট্র হলে কি হবে, প্রকৃতই দুই বাংলার এখনও একটাই আত্মিক পরিচয়- তারা সবাই যে একত্রে মনে প্রানে বাঙালি। এই বাঙালিয়ানার পরিচয়ের শিকড়টা আবার হাজার বছরের পুরনো। তাই আগত বার্নিং ইস্যুর অপেক্ষায় না থেকে ঝুলি থেকে সত্য কাহানিয়ার বেড়ালটা বের করেই ফেলুন এবার। আসলে দুই বাংলার বিশ্বাসের প্রদীপে ইতিমধ্যেই সিএএ'এর সলতে পাকতে শুরু করেছে আপনার সরকারেরই নীতিগ্রহণের সৌজন্যে, তার উপর যদি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ফের আপনারই তোলা 'মুক্তিযুদ্ধ ইস্যু' স্রেফ খেলা হবে হয়ে ওঠে, তবে সার্বিক বাঙালিয়ানার অন্তরে আপনি অবশ্যই ঠাঁই করে নেবেন এক বিশ্বাসহন্তা পরিচয়ে।

বল এখন আপনার কোর্টে। ৫৬ ইঞ্চির চওড়া শিনা ফুলিয়ে আপনার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রমান দাখিল করবেন নাকি অন্যথায় দুই দেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবেন? সিদ্ধান্তটা আপনার!

(www.theoffnews.com - Modi addressing Bangladesh recalled satyagraha muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours