তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
কলকাতার ইতিহাস সম্পুর্ন জানতে গেলে, ফেলে আসা চিৎপুরের ইতিহাস জানা আবশ্যক। আধুনিক কলকাতার জন্ম এই চিৎপুরের গর্ভ থেকেই।
তাই আমার পাঠকের জন্য এই লেখনীর মাধ্যমে প্রাসঙ্গিকতার তথ্য জানাবার দায়িত্ব এড়াতে পারলাম না।
কলকাতার অলি গলির ইতিহাসে চিৎপুরের নাম সর্বাগ্রে। প্রাচীনত্ম ও ঐতিহ্যের দিক থেকে আজও কৌলিন্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে।চিৎপুরের রাস্তাটি কবে প্রথম তৈরী হয়, তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল। প্রাচীন মঙ্গলকাব্য, ১৪৯৫-৯৬ সালে রচিত বিপ্রদাস পিপিলাই এর মনসাজিও কাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ আছে। তবে ওই অংশটুকু প্ৰক্ষিপ্ত বলে অনেকের ধারণা। এরপর আজ থেকে ৩৫০ বছর আগে ষোড়শ শতাব্দীর শেষে রচিত কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর "চন্ডীমঙ্গল" কাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ পাই। সেখানে দেখি সাধু শ্রীপতির নৌকো ভাগীরথীতে তরতর করে ভেসে চলেছে- ত্বরায় চলিত তরী তিলেক না রয়। চিৎপুর শালিখা এড়াইয়া যায়। শুধু জলপথে নয়, স্থলপথেও মোঘল আমল থেকে রাস্তাটি কালীঘাটে যাওয়ার প্রধান পথ। অর্থাৎ চিৎপুর রোডই হল তীর্থযাত্রার পথ। কাশিপুর অঞ্চলে শাক্তদের আরাধ্যা চিত্রেশ্বরী অথবা চিত্তেশ্বরী দেবীর নাম থেকেই চিৎপুর নামের উৎপত্তি। ঐতিহাসিকরা এই মত প্রকাশ করেছেন যে, টোডোরমোল্লের রাজেশ্বর মুহুরী মনোহর ঘোষ এই চিত্তেশ্বরী মুর্তি স্থাপন করেন। এক কালে চিৎপুর ডাকাত ও কাপালিকদের আড্ডা ছিল। ওই দেবীর সামনে নাকি বহু নরবলি হত। ১৮২৫ সালের সমাচার দর্পণে তার উল্লেখ আছে। চিৎপুর অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ বহু গুণী ও বাইজির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তারই দৌলতে চিৎপুরে বাইজিদের বসবাস শুরু হয়। চিৎপুরের গরান হাটা অঞ্চলে কীর্তনের একটি বিশেষ ধারার (গরান হাটি) উৎপত্তি। শুধু গানবাজনা নয়, চিৎপুরকে কেন্দ্র করে শোভাবাজার বট তলাতে কবিগান, যাত্রা, হাফ আখড়াই এর এবং শখের থিয়েটার এর চর্চা শুরু হয়। চিৎপুরের মধুসূদন সান্যাল এর বাড়ির উঠোনে ন্যাশনাল থিয়েটরিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক নীলদর্পন অভিনয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে সাধারণ রঙ্গালয় এর সূত্রপাত হয় ১৮৭২ সালে। তবে যাত্রার ইতিহাস অনেক পুরোনো। পরে বিশদে আসছি। হিন্দু কলেজ প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় এই চিৎপুরে। আদি ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রপাতও হয় এইখানে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত একসময় চিৎপুর রোডের এক বাড়িতে বাস করেন। তার অনেক সাহিত্যকীর্তি ওই বাড়িতে রচিত হয়। চিৎপুরের প্রাচীন বিদ্যালয় ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন ছাত্র ছিলেন। ওই সময় চিৎপুরের ঐতিহ্য ও জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার একসাথে একাকার হয়ে গিয়েছিল।চিৎপুরের বটতলা ছিল বই বাজারের কেন্দ্রবিন্দু।হিন্দুদের নানা মন্দির, মুসলমানদের নাখোদা মসজিদ, ইমামবাড়া, দিগম্বর জৈন মন্দির চিৎপুরে অবস্থিত। আর হিন্দুদের মহাতীর্থ কাশিমিত্র এবং নিমতলা ঘাটে যেতে হয় চিৎপুর পেরিয়ে। চিৎপুরে আজও নানা ধর্মের ও নানা জাতির মানুষ বসবাস করছে। কালের গতিতে তার জৌলুস ম্লান হলেও চেহারার আভিজাত্য চাপা পড়ে নি।
চিৎপুরের বটতলা নামটি শোভাবাজার-চিৎপুর এলাকার একটি বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে উৎপত্তি হয়। উনিশ শতকে বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প এখানেই শুরু হয়েছিল। এই বটগাছ এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠেছিল, তা প্রধানত সাধারণ ও অর্ধশিক্ষিত পাঠকের চাহিদা মেটাত। তাদের রুচি অনুযায়ী গ্রন্থ, যেমন পুথি, পাঁচালী, পঞ্জিকা, পুরাণ, লোককাহিনী ইত্যাদি এখান থেকে প্রকাশিত হতো। বটগাছের চারপাশের অলি-গলি সমূহও সাধারণভাবে বটতলা নামে পরিচিত ছিল।
‘বটতলার বই’ ব্যাপারটা বাঙালি মাত্রেই জানেন। কেচ্ছার বই মানেই নাকি বটতলা সাহিত্য। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন হরিপদ ভৌমিক। তাঁর কথায়, বটতলার ছাপা পঞ্জিকা সেই আমলে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় ঝাঁকায় করে বিক্রি করে বেড়াত ফেরিওয়ালারা। সেই পঞ্জিকার ফাঁকেই অন্তঃপুরে ঢুকে পড়ত তখনকার নানা কেচ্ছা-কাহিনি।
কিন্তু এটি ধারণা মাত্র। সুকুমার সেন থেকে গৌতম ভদ্র অনেকেই তালিকা দিয়ে জানিয়েছেন, উনিশ শতকে বটতলা প্রেসে কৃষ্ণদাস কবিরাজ থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনেকের লেখাই ছাপা হতো। ছিলেন গিরিশচন্দ্র থেকে বঙ্কিমচন্দ্র অনেকে। ছাপা হতো ভারতচন্দ্র, মুকুন্দরামও। "পুরাণ, পাঠ্যপুস্তক থেকে আয়ুর্বেদ, গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য, সচিত্র রামায়ণ, মহাভারত সবই বটতলায় ছাপা হতো। বেরোত জনসংস্করণ, সচিত্র সংস্করণ, শোভন সংস্করণ ইত্যাদি হরেক এডিশন,’’ বলছেন গৌতমবাবু।বটতলা নিছক কেচ্ছা-প্রকাশক নয়, সেটা আসলে বাংলার ঐতিহ্য।
চিৎপুর, মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের বিভিন্ন প্রকাশন নিয়ে যে ‘বটতলা’, সেখানে কাঠ খোদাই করে আঁকা হত দেবদেবীর ছবি, সেখানে ছিল না ধর্মীয় ভেদাভেদ। বটতলা নিঃসন্দেহে বঙ্গ সংস্কৃতির প্রবহমান ঐতিহ্য, কোনও কেচ্ছা বা খেউড়ের প্রকাশনা নয়। বই আগে বটতলাতেই ছাপা হত। কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়া এসেছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’র হাত ধরে।
চিৎপুরের যাত্রা শিল্পের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। চিৎপুরের যাত্রার ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের। ইতিহাস বলছে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের হাত ধরেই যাত্রা শিল্পের আবির্ভাব। কৃষ্ণপালা দিয়ে শুরু লোকশিল্প যাত্রার পথচলা। শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের প্রধান দুই অস্ত্র ছিল যাত্রা আর কীর্তণ।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল ব্যক্তি জীবনেই যাত্রা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, তাদের সাহিত্যকর্মেও ছিল যাত্রার উজ্জল উপস্থিতি। যাত্রাশিল্পী ও গবেষকরা মনে করেন, যাত্রা কেবল বিনোদন মাধ্যম নয়, লোকশিক্ষার বাহনও। নিরক্ষতার অনগ্রসর সমাজে যাত্রা পালন করছে ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়ের ভূমিকাও।
অনেকেই দাবি করেছেন, ১৫০৯ সালে যাত্রার সঙ্গে অভিনয় যুুক্ত হয় শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে এবং রুক্ষিণী হরণ প্রথম যাত্রাপালা। চৈতন্য দেব রুখিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তবে আর একজনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক।আগের শখের যাত্রা হতো কিন্তু যাত্রা শিল্প পেশাধারী হলো গোপাল উড়ের হাত দিয়ে।
আসুন পুরো গল্প তা শুনে নিন। কলা বিক্রেতা থেকে গায়ক হওয়ার গল্প। অন্য ইতিহাস। অলস দুপুর। বৌবাজার অঞ্চলের বাড়িটায় বৈঠকখানায় তখন তুঙ্গে আলোচনা। যোগ দিয়েছে মতিলাল গোষ্ঠী, বাঁড়ুজ্যে গোষ্ঠী, ধর গোষ্ঠী। রাতেই যাত্রার মহড়া। সে সবে ছেদ টানল এক সুরেলা কণ্ঠ, ‘চাই চাঁপাকলা’। কে যায়? বিশ্বনাথ মতিলালের তলবে ধরে আনা হল ফেরিওয়ালাকে।
নাম কী? গোপাল উড়ে। কোথায় বাড়ি? বয়স কত?... চলল প্রশ্নবাণ। খানিক বিব্রত হয়ে উত্তর দিতে থাকলেন ওড়িশার জাজপুরের সদ্য কৈশোর পেরনো সেই যুবক। আড্ডায় উপস্থিত রাধামোহন সরকার সকলের সামনেই আগামী বিদ্যাসুন্দর যাত্রায় মালিনী চরিত্রের জন্য মাসিক দশ টাকায় গোপালকে বেছে নিলেন। সম্ভবত সেটাই কলকাতার প্রথম শখের যাত্রা।
বাকিটা ইতিহাস। বাবুদের ওস্তাদ হরিকিষণ মিশ্রের তত্ত্বাবধানে চলল তাঁর সঙ্গীতশিক্ষা। এক বছরেই গোপাল আয়ত্ত করলেন ঠুংরি। বছর খানেক পরে ১৮৪২ সালে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে বিদ্যাসুন্দর প্রথম মঞ্চস্থ হল। গান-নাচ-অভিনয়ে সাড়া ফেলে দিলেন গোপাল। তাঁর মাইনে এক লাফে হল পঞ্চাশ টাকা। রাধামোহনের মৃত্যুর পরে নিজেই দল গড়েন গোপাল। শোনা যায়, সহজ বাংলায় গান লিখে এবং সুর দিয়ে বিদ্যাসুন্দর যাত্রাকে আরও জনপ্রিয় করেন তিনি। সেভাবে কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও সম্ভবত সেটাই ছিল চিৎপুরের একটা অংশের যাত্রাপাড়া হয়ে ওঠার সূচনা।
যাত্রা শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়, মজিয়ে দিয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকেও। গোপাল উড়ের পালা দেখে ঠাকুরবাড়ি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাতে তিনি লেখেন, ‘গোপাল উড়ের যাত্রা থেকেই আমরা থিয়েটার করার প্রেরণা পেয়েছি।’ সেসব গানের চলনবলন আজও মুগ্ধ করে। তাছাড়া ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার...’ গানটির সঙ্গে আশ্চর্য মিল পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে গানটির। চলন প্রায় এক।
বাংলায় কীর্তনের ইতিহাসে গোপাল উড়েকে বাদ দিয়ে লেখা যাবে না। গোপাল উড়ে শুধু কিংবদন্তি নয়, একটা ভালোবাসার নাম। বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাস পড়লেই বোঝা যায় গোপাল যে কত জনপ্রিয় ছিলেন বাংলায়। তাঁর গলায় ছিলো লড়াই ও কান্নার ধনি, মানব প্রেম, তাই বাংলার ইতিহাস তাঁকে ভোলেনি, অনেক যত্নে আগলে রেখে দিয়েছে এই ক্ষণজন্মা প্রতিভাকে। গোপাল উড়ের লেখা দুটো গান।
(১) হায়, রসিক সুজন, নারীর মনোরঞ্জন।
প্রিয়া সনে সঙ্গোপনে করেন সুখ-আলাপন।
ছলে বলে কৌশলে, মালিনীরে ফাঁকি দিলে,
উভয়ের প্রেম অন্তঃশীলে, বহে ফল্গুনদী যেমন।
কি সুন্দর শুনিতে বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যান,
মাটির ভিতর আনাগোনা, আর কার সাধ্য বলনা,
বিনা দৈব্যেরই ঘটনা, না হয় ঘটন।
যেমন রতিপতি, তার চেয়ে বিদ্যাপতি,
মাটির ভিতর একি রীতি, উভয়ে গমনাগমন
বতসর পনর ষোল হইল বয়ঃক্রম।
ভবে মরে রাজা রাণী হইবে কেমন।
(২) হায় হায়, বিষম বিষম চিন্তা, ভেবে প্রাণ যায়,
মরি হায় হায়।
বিপত্তে সম্পত্ত হয়, এতে যদি মান রয়,
সেই মোক্ষ এ সময়, যদি তারে পায়;-
হায়, কেন মাটি খেয়ে পড়ালাম বিদ্যায়।
দিবানিশি ঐ কথা, কারে কব মর্ম্ম ব্যথা,
যেই দুঃখ সর্ব্বদা হতেছে আমায়।
কবে এ কুদিন যাবে, সুপ্রভাত রজনী হবে,
বিদ্যা বিদ্যায় হারাবে, পাবে কে কোথায়।
গুণসিন্ধু-রাজসুত, রূপে গুণে অদ্ভুত,
সর্ব্বগুণে গুণযুত, সকল বার্ত্তায়।
হায়, বর আনিতে গঙ্গাভাট গেছে কাঞ্চীপুর,
সে আসিলে তবে মম দুঃখ দূরে যায়।
হায়, দিবসে না হয় তৃপ্তি করিলে ভোজন।
হায় হায়, নিশিতে না হয় নিদ্রা করিলে শয়ন।
হায় হায়, লাজ বাজে,
লোকমাঝে কহা নাহি যায়।
তথ্যসূত্র:
বাঙালীর গান- দুর্গা দাস লাহিড়ী,
রমাপদ চৌধুরী,
কলিকাতার রাজপথ: সমাজে ও সংষ্কৃতিতে- অজিত কুমার বসু।
(www.theoffnews.com - history Chitpur Kolkata)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours