পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

চারিদিকে গেল গেল রব। কয়লা পাচার, গরু পাচার, লোহা পাচার, তোলা আদায় নিয়ে হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। নির্বাচনের আগে প্রতিটি সভায় দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় মেজো সেজো সব বিজেপি নেতাদেরই উচ্চস্বর, ভাইপো তথা তৃণমূলের সঙ্গে কয়লা মাফিয়া বা বালি মাফিয়াদের যোগ প্রমাণে। বিজেপির অভিযোগ গোটা তৃণমূল দলটাই চলছে এই কয়লা বা বালি মাফিয়াদের টাকায়। এই অভিযোগ যে অসত্য তা আমি কোনওভাবেই বলছি না। কিন্তু কাচের ঘরে বসে যে ঢিল ছোড়া উচিৎ নয় তা নির্বাচনে জিততে মরিয়া বিজেপি নেতৃত্ব বোধ হয় ভুলেই গিয়েছেন। তাই তো নিজেরা কুখ্যাত কয়লা মাফিয়াকে দলে সাদরে বরণ করে তাকে পাশে বসিয়ে সেই মঞ্চ থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে কয়লা মাফিয়া যোগের অভিযোগ তোলেন। না, এই নির্লজ্জতা রাজনীতিতে নতুন নয়। কিন্তু কয়লা মাফিয়া লালার সঙ্গে তৃণমূলের যোগ যদি থেকেও থাকে তাহলেও একটা কথা অনস্বীকার্য লালা এখনও পর্যন্ত তৃণমূল দলের কোনও সদস্য বা কর্মকর্তা নয়। এটুকু পর্দা তৃণমূল রেখেছে। 

বিজেপি সেই রাখঢাকের প্রয়োজনীতাও অনুভব করছে না। তাই তো প্রকাশ্যেই রাজু ঝাঁ এবং তার এক ঝাঁক সহযোগীকে বিজেপি দলে স্বাগত জানিয়েছে। রীতিমত রোড শো করে এলাকা প্রদক্ষিণ করেছে রাজু ঝাঁ এন্ড কোং। দীর্ঘদিন শিল্পাঞ্চলে সাংবাদিকতা করবার সুবাদে রাজু ঝাঁ এবং তার কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আমার আছে। রাজুকে কয়লা মাফিয়া হিসেবে চেনেন গোটা শিল্পাঞ্চলের আট থেকে আশি সকলেই। তা স্বত্বেও রাজুকে প্রকাশ্যে দলে নেওয়াটাকে নির্লজ্জতা না বলে বেপরোয়া মনোভাব বলাই ভাল।

বিজেপি যে বেপরোয়া সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না, যখন দেখি পাঁচ রাজ্যে ভোটের ঠিক আগে দুঃসাহসিক ভাবে লাগাতার পেট্রো পণ্য এবং রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে চলে তারা। এত আত্মপ্রত্যয় বা আত্ম অহং আসে কোথা থেকে? এটাই চরম বিস্ময়ের। একটা গল্প আছে এর পিছনে। লালার উত্থান কিন্তু তৃণমূলের আমলে। রাজু বেড়ে উঠেছিল সিপিএমের ছত্রছায়ায়। এরপরে তৃণমূল পিছনে লাগায় রাজু দিল্লীতে বিজেপির সঙ্গে তার সেটিং শুরু করে। সেই সুযোগে লালা বেড়ে ওঠে এখানে। এবার লালা সিবিআই –এর শিকার। বাংলায় বিজেপি সরকার এলেও আসতে পারে এমন আবহে লালার অনুপস্থিতিতে কি ফের রাজুর সাম্রাজ্য বাড়তে পারে? এ প্রশ্ন মানুষের মনে, উত্তর রাজনৈতিক নেতাদের মগজে। 

বাংলাতে দশ বছরের শাসন কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ছেলেমেয়েদের সামান্য একটু সামলে সুমলে রাখলে কিন্তু ভোটের সময় তাকে একগুচ্ছ জনমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষততে প্রলেপ দিতে হত না। বিজেপিও এই বাড়বাড়ন্তের সুযোগই পেত না। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রায় সর্বোচ্চ স্তরের বিভিন্ন নেতার নামে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ। আলাদিনের জিনের কল্যাণে প্রায় সকলেরই টালি চালের বাড়ি আজ অট্টালিকা।  সামান্য প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক তৃণমূল নেতা হওয়ার দৌলতে এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক, একাধিক বহুজাতিক কোম্পানির ডিলার। এ সবই মানুষকে দূরে নিয়ে গিয়েছে হাওয়াই চটি, সরু পাড়ের সাদা শাড়ির মুগ্ধতা থেকে। নইলে বিজেপির মত একটি বেপরোয়া, অহংকারী, সর্বগ্রাসী, পরমত অসহিষ্ণু দলের পক্ষে বাংলা দখলের স্বপ্ন দেখাটা সম্ভব হত না।  

একুশে বাম কংগ্রেস বা আইএসএফের জোটের ব্রিগেডে জনজোয়ার দেখে অনেকেই আপ্লুত। কিন্তু মনে রাখবেন ২০০৫ বা ২০০৬ সালে ব্রিগেডে জনজোয়ার হওয়া স্বত্বেও তৃণমূল ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ব্রিগেডের জনজোয়ার ভোটের পরিচায়ক নয়। এক্ষেত্রে তো এই জনজোয়ারের ভিত্তি নিয়েই চাপান উতোর শুরু হয়ে গিয়েছে। আইএসএফের মতে ব্রিগেডের ভিড় সিংহ ভাগ তাদের। বামদের দাবি ব্রিগেডের মাঠ লালে লাল তাদের জন্য। অবশ্য কংগ্রেস এমন কোনও দাবি করবার সাহস করেনি।  সব মিলিয়ে এই সংযুক্ত ফ্রন্ট ব্রিগেড সমাবেশের পরে সামান্য আলোচনায় এলেও এখনও তাদের বিকল্প ভাবার জায়গা বাংলাতে তৈরি হয়নি। 

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে সূচ বলে চালনকে। কিন্তু সূচের পিছনে একটিই ছিদ্র, তাই এই উপমা বর্তমান রাজনীতিতে খাটে না। কারণ প্রত্যেকটি দলের এখন বহুছিদ্রে চালনের দশা। তাই তাদের সঙ্গে আরেক বহুছিদ্র যুক্ত ঝাঁঝরির উপমাই উপযুক্ত বলে মনে হয়। সব দলের সঙ্গেই মাফিয়া যোগ সর্বজ্ঞাত। তাই মাফিয়াদের নিয়ে ভোট বাজারে এই টানাটানিটা কি না করলেই নয়? মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপদে। দিনরাত চোখের সামনে এত অসত্য, এত মিথ্যা, এত নির্লজ্জতা দেখাটা যে কি চাপের তা কেবল তারাই বোঝেন।  অন্য রাজ্যে এক বা দুদিনে মিটে যাবে এই ঝঞ্ঝাট, কিন্তু আমাদের? মাসাধিক কাল ধরে চলবে নির্বাচন, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলবে এই মিথ্যাচার, নির্লজ্জতার পালা। তারপরেও রেহাই কি মিলবে? ২০২৩ এই আসছে ফের আর একটা নির্বাচন। ফের আসছে মিথ্যাচার, অত্যাচার, নির্লজ্জতার সুনামি।

(www.theoffnews.com - West Bengal politics coal mafia)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours