ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

সারারাত হেঁটে ভোর রাতের দিকে নতুন শেল্টারে উপস্থিত হলাম আমরা। কলেজ ছাত্রটি যে গ্রামের কথা বলে সঙ্গে গাইড দিয়েছিল সেই শেল্টারে এসে আমরা বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম। গ্রামের লোকগুলো ভীষণ আন্তরিক। তারা আমাদের সহজভাবে গ্রহণ করলো। 

অনেক গ্রামে আমাদের জোর জবরদস্তি করে শেল্টার নিতে হয়েছে। কাউকে কাউকে ভয় দেখিয়ে ধমক দিতে হয়েছে। ‘বউবাচ্চা নিয়ে বের হ ঘর থেকে। একরাত কষ্ট করতে এতো আপত্তি কেন? আমরা যে রাতের পর রাত কষ্ট করছি তা তোদের চোখে পড়ে না?’ 

তবে এমন নিষ্ঠুর আচরণ আমাদের বেশি করতে হয়নি। বেশিরভাগ গৃহকর্তা আমাদের পরম আত্মীয়ের মতো তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। মাছমাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে গ্রামের সাধারণ কৃষকরাই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে মুক্তিযুদ্ধে। যারা একটু আধটু ওজর আপত্তি করেছেন তার জন্যে তাদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে মিলিটারি সেই বাড়িগুলো আক্রমণ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। বাড়ির লোকদের গুলি করে মেরেছে। 

গ্রামের মানুষ ছিল উভয় সংকটে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিলে তাদের অন্তর যেমন দগ্ধ হয় আবার আশ্রয় দিলে মৃত্যু এসে হানা দেয়। 

রাতে খেতে বসে জানা গেল কাল ত্থেকে রোজা শুরু। রোজার সঙ্গে অনেক স্মৃতি আমার। বলতে গেলে সে স্মৃতি আমাদের সবারই। 

আমি রোজা থাকতে পারতাম না। কিন্তু সেহরি খেতাম ঠিকই। শীতের রাতে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে খুব মজা লাগতো। মধ্যরাতে পশ্চিম আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা দেখা যেত। মা তাখন ভাত রান্না শুরু করতেন। তখন গ্রামে সেইরি খাওয়ার জন্য সাইরেন বাজতো না। মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হতো না। রেডিও টেলিভিশন সম্প্রচার করে সময় বলে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ওই উজ্জ্বল তারাটি ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের রোজা পালনের একমাত্র দিক নির্দেশক। সেই উজ্জ্বল তারা দেখে মা আমার শীতের রাতে মাটির চুলোয় খড়ি, পাটসোলা কিংবা গরুর গোবর শুকিয়ে ঘসি দিয়ে সবার জন্য ভাত তরকারি রান্না করে তারপর বাড়ির সবাইকে ডেকে তুলতেন। সব কষ্ট মাকে একা করতে হতো। মায়ের কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো। অনেকদিন আমিও উঠে মায়ের সঙ্গে চুলোর পাশে বসে থাকতাম মাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। মা আপত্তি করে বলতো, ‘সোনা আমার, তোমার এখানে বসে কষ্ট করার দরকার নাই। তুমি গিয়ে লেপের নিচে শুয়ে থাকো। রান্না হলে আমি ডাকবোনে।’ 

আমি বলতাম, ‘চুলার আগুনের আঁচে বসে থাকতে আমার ভাল লাগছে।’ মা আর কিছু বলতো না। 

রোজার কথা শুনে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মা কি আজও মধ্যরাতে সেই উজ্জ্বল তারা দেখে চুলোয় রান্না তুলে দেবে? রান্না করতে গিয়ে আমার কথা মনে পড়বে কি? মা কি তখন নিঃশব্দে চোখের জল ফেলবে আমার কথা মনে করে? ‘মাগো, তুমি আমাকে নিয়ে ভেব না। আমার জন্য দোয়া করো। তারচেয়ে বরং তুমি আমাকে মাতৃভূমির জন্য উৎসর্গ করে দাও। তোমার আর কোন কষ্ট থাকবে না।’ 

‘রোজার সেহরি খাবে কে কে?’ অর্থাৎ কে কে রোজা থাকবে? প্রশ্ন করলেন কমান্ডার আশরাফভাই। দেখা গেল সবাই রোজা থাকবে। এমনকি মলয় সেও রোজা থাকবে। যেহেতু তার নাম শফিক। সে এখন নামমাত্র মুসলমান। যেহেতু মুসলমান তাই তার রোজা থাকতে বাঁধা নেই। 

আমি আর মলয় একই তরিকার রোজাদার। সেইরি খাই। দিনের বেলা সুযোগ পেলে কিছু না কিছু খেতাম। আর কিছু না পেলে লুকিয়ে পানি এবং সিগারেট খেতাম। সন্ধ্যায় কিন্তু সবার সঙ্গে বসে ইফতারি করতে ভুল করতাম না। 

ইসলাম পূর্ব থেকে রোজার প্রচলন। তখন এই সময়টাকে সবাই পবিত্রজ্ঞান করতো। এই সময় তারা কোন যুদ্ধ বিগ্রহ করতো না। অলিখিত যুদ্ধ বিরতি চলতো রমজান মাসে। আর পাকিস্তানের জানোয়ার মুসলমানগণ ইসলাম রক্ষা করতে এসে রমজান মাসকে পরোয়া করছে না। রমজানেও তাদের পৈশাচিকতা থামছে না। গ্রাম থেকে জোর করে আমাদের মা-বোনকে তুলে নিয়ে সম্ভ্রমহানি করছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ হত্যা করছে। অথচ আমাদের আলেম মৌলানা পীর মাশায়েগগণ মুসলমান বলে তারা পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগিতা করছে। তারা নাকি ইসলাম রক্ষা করছে। এর মধ্যে শরসিনার পীর এবং চরমোনাইয়ের পীর এই দুই জানোয়ার বাঙালি নারীদের মালে-গনিমত হিসেবে পাকিস্তানিদের সেবায় প্রেরণ করা ইমানী দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানি জানোয়ার আর আমাদের এই পীর জানোয়ারদের হত্যার জন্য আমরা রক্ত শপথ নিয়ে পথে নেমেছি। 

একরাতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় একটি প্রাইমারি স্কুলে আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি। দেখলাম দুজন যুবকের চোখ এবং হাত বাঁধা। খবর নিয়ে জানলাম যুবক দুজন রাজাকার। আমাদের খবর নিতে এসেছিল। আমাদের গোয়েন্দারা টের পেয়ে পাকিস্তান প্রেমিক দুই রাজাকার ভাইজানকে কৌশলে ধরে চোখ হাত বেঁধে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে নেওয়া রিস্কি। আমাদের নিজেদেরই অবস্থানের নিশ্চয়তা নেই। ওদের নিয়ে আমরা কোথায় যাব? পরিকল্পনা হলো নদীর মধ্যে ওদের বিশ্রামে রেখে আমরা আমাদের পথে চলে যাব। কয়েকজনের উপর দায়িত্ব পড়লো তাদের বিশ্রামে ব্যবস্থা করার। সেই কয়েকজনের মধ্যে আমি এবং মলয়ও পড়লাম। বলা হলো গুলি নষ্ট করা যাবে না। এর পর আমাদের কি করণীয় বাকিটা আর বলার দরকার আছে কি? 

চোখ বাঁধা লোক দুজনকে ধাক্কিয়ে গুঁতিয়ে নদীর পাড়ে এনে দাঁড় করানো হলো। তারা কিন্তু বুঝতে পারছে না এখন তারা কোথায়? তবে ঠিকই বুঝেছিল পৃথিবীতে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না তারা। কিছুক্ষণপরই ভবলীলা সাঙ্গ হবে তাদের। 

মৃত্যুর বিভীষিকা নেমে এলো দুজন কুখ্যাত রাজাকারের জীবনে। আমি এবং মলয় ঠায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধের নির্মমতা লক্ষ্য করলাম নিরবে। আমাদের দলনেতা হালিম আমাদের দুজনকে বার বার আহবান করছিল হত্যায় অংশ নিতে। আমরা বিনয়ে এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে গেলাম। রাজাকার দুজনকে পাকিস্তান রক্ষার শাস্তি নিশ্চিত করে আমরা আবার দলের সঙ্গে মিলিত হলাম। 

১৯৭১ সালটা এই উপমহাদেশে জুড়ে শুধু মৃত্যুর হাতছানি। যার বেশিরভাগই বাঙালি। পাকিস্তানিরা বাঙালি মেরেছে। রাজাকার আলবদররা বাঙালি মেরেছে, মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাঙালি উভয়কেই মেরেছে। অসুখে বিসুখে শরণার্থী শিবিরে বাঙালি মরেছে। এক কথায় মৃত্যুর হলিখেলা চলেছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি জীবন দিয়েছে। তারপরও বাঙালি স্বাধীনতা চায়। আর সেই স্বাধীনতার জন্য বাঙালি মরছে এবং মারছে।

আমরা ক্রমশ সিরাজগঞ্জ শহর মুখী হচ্ছিলাম। যে গ্রামে আশ্রয় নিলাম সেখানে খুব গোপনীয়তা রক্ষা করতাম আমরা। শুনেছি এই গ্রামে পাকিস্তানিদের সাপোর্টার আছে কয়েকজন। এর মধ্যে একজন তরুণকে ধরে নিয়ে এলো আমাদের দলের লোকজন। তার অপরাধ সে পাকিস্তানিদের ঘোষিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পাকিস্তানিরা রেডিও টিভিতে সবসময় বলে যাচ্ছে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক। কিছু ভারতীয় চর দুষ্কৃতিকারী দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা কায়েম করতে চায়। কিন্তু তারা সে সুযোগ পাবে না। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার আলবদর বাহিনী এব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ। যারা ভারতে পালিয়ে গেছে তাদের দেশে এসে সবাভাবিক জীবনে ফেরার আহবান জানানো হয়। দুজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্রাভিনেতা ফতেহ লোহানী এবং চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতা ঢাকা রেডিও থেকে নিয়মিত কথিকা পাঠে এই কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেন। 

পরীক্ষার্থী তরুণকে নানাভাবে জেরা শুরু হলো। তাকে বলা হলো তোমার মতো হাজার হাজার তরুণ সব ছেড়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছে। আর তুমি পরীক্ষায় অংশ নিলে পাস্কিস্তানিদের কথায়? বলো, কাজটা কি ঠিক করছো? 

একসময় সেই তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়ে কমান্ডারের পা ধরে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগলো। বার বার বলতে লাগলো, ‘আমি ভুল করছি। আমাকে মাফ করে দিন।’ 

কমান্ডার গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ওকে যেতে দাও। ওকে মাফ করা হলো।’

সবাই থমকে গেল। সেটা কমান্ডার বুঝতে পেরে বললেন, ‘ওর অপরাধ  সামান্য না হলেও খুব বড় নয়। এর জন্যে ওকে বড় কোন শাস্তি দিলে সেটা অন্যায় হবে।’ [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours