ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

মিন্টু চলে যাবার পর আমাদের মধ্যে উদাসীনতা পেয়ে বসে। কিন্তু যুদ্ধের নিয়ম না মানলে চলবে কেন? আস্তে আস্তে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে যায়। দুদিন যেতে না যেতে আমাদের মধ্যে বড় ধরণের ভাঙ্গন দেখা দেয়। আমাকে এবং আসগরকে ডেকে নিয়ে সুকুর মামু বললেন, এমপি সৈয়দ হায়দার আলী [সিরাজগঞ্জ] তিনি নিজে একটি ক্যাম্প করছেন। ওই ক্যাম্প থেকে খুব তাড়াতাড়ি হায়ার ট্রেনিংয়ে জন্য বড় ক্যাম্পে পাঠানো হবে। আমরা তিনজন সেই ক্যাম্পে যাব। 

‘ওরা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমরা তিনজন ছাড়া আরও আছে মোস্তফা, খোকন এবং রাজ্জাক। জহুরুল বাড়ি গেছে। তাকে বাদ দিয়ে আমাদের যাওয়া কি ঠিক হবে? 

সুকুর মামু বললেন, ‘সবাইকে নেওয়া যাবে না। বেছে বেছে নিতে বলেছে। সেখানে কমান্ডার হবে তৌহিদ। 

‘ওরা আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য কি?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম। সুকুর মামু বললেন, আগে আমরা গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। তারপর ওদের নেওয়া যাবে।’ 

সুকুর মামুর এই সিদ্ধান্ত আমার ভাল লাগলো না। ভেতরে ভেতরে খচ খচ করতে লাগলো। কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদও করতে পারলাম না। খুব খারাপ লাগছিল খোকন রাজ্জাক এবং মোস্তফার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়। ওরাও বুক ভরা অভিমান নিরবে হজম করে আমাদের বিদায় জানালো। আমরা তিনজন সুকুর মামু আসগর এবং আমি নয়াবন্দর থেকে মাইনকাচর মরনটিলা পাহাড়ে এসে আশ্রয় নিলাম।

এই প্রথম কাছে থেকে আমার পাহাড় দেখা। পাহাড়ে ওঠা। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনটা দিগন্ত ছোঁয়া আকাশের মতো বিশাল হয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দেখে মনে হচ্ছিল কোথাও সমতল ভূমি নেই। দূরে মাইনকারচর নদীর পাড়ে বাঁধা বজরা নৌকাগুলোকে ডিঙি নৌকা আর মানুষজনকে বীরবামন মনে হচ্ছিল। 

আমরা ৫০/৬০ জনের একটি দল পাহাড়ের চূড়ায় তাবু ফেলে অবস্থান নিলাম। যাদের অধিকাংশের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। এখানে এসে আবার তৌহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখানে তাঁর অন্যভাব লক্ষ্য করলাম। সবসময় তাঁকে কমান্ডার-কম্যান্ডার ভাব করতে দেখতাম। খানিকটা গম্ভীর ভাবও লক্ষ্য করতাম। তাঁর মুখেই জানলাম খুব তাড়াতাড়ি আমাদের নাকি উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমার বার বার শুধু খোকন, মোস্তফা এবং রাজ্জাকের কথা মনে পড়তে থাকে। সবাই একসঙ্গে থাকলে কত আনন্দ হতো। মনে সাহস পেতাম। বেশি মনে পরে জহুরুলের কথা। ও ফিরে এসে যদি দেখে আমরা নেই, তখন? ওর সমস্যা হবে না? কি দরকার ছিল ওর যাওয়ার? না গেলে কি হতো? অন্যদের যা হয়েছে আমাদেরও তাই হতো। আর কিছু না হোক অন্তত একসঙ্গে থাকা যেতো। 

দুদিন কেটে গেল নানান ভাবনায়। পরদিন সন্ধ্যার একটু পর জহুরুল, রাজ্জাক, খোকন এবং মোস্তফা আকস্মিকভাবে আমাদের ক্যাম্পে এসে হাজির। জহুরুলকে পেয়ে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু জহুরুলকে দেখলাম নিরাসক্ত। হতে পারে আমাদের দল ভাঙ্গার কারণে ওর মন খারাপ। অথবা অন্য কোন কারণ। আমি শাজাহানের খবর জানতে চাইলাম। জহুরুল এবার হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, ‘দিব্বি বাড়িতে গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ 

‘জিজ্ঞেস করলি না, না বলে পালিয়ে গেলো কেন?’ 

জহুরুল বললো, ‘করবো না মানে-অবশ্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলে কি, বললে নাকি আমরা যেতে দিতাম না। ভিতু বলে ঠাট্টা মসকরা করতাম।’ 

একবাক্যে সবাই যে কথাটা বললো, তাহলো শাজাহান ভালভাবে বাড়ি ফিরে গেছে তাতেই আমরা খুশি। যাজগে। ও চ্যাপ্টার এখন ক্লোজ। অন্য কথা বল। 

জহুরুল বাড়ি থেকে আনা বাবা-মায়ের দেওয়া টাকা সব হিসেব করে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। তারপর আমাকে তাবুর বাইরে এনে বলে, ‘একটা খারাপ খবর আছে। কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।’ 

আমি বললাম, ‘খারাপ খবর চেপে রাখতে নেই। ঝটপট বলে ফেল।’ জহুরুল যা বললো, শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমিও বুঝে উঠতে পারছিলাম না জহুরুলকে কি বলবো এবং সুকুর মামুকে এই খবর কিভাবে জানাবো।

‘কিন্তু জানাতেতো হবেই’। জহুরুল জোর দিয়ে বললো। 

‘তাতো জানাতে হবে।’ আমিও সমর্থন দিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে?’ 

জহুরুল বললো, ‘না। ওরা ঘরে আগুন দিয়ে চলে গেছে। মনে হলো ওরা ত্রাস সৃষ্টি করতে এসেছিল। ওরা প্রথমে কৃষকগঞ্জ বাজারে ফুপার রাইস মিল জ্বালিয়ে দেয়। তারপর বোর্ড ঘরে আগুন দেয়।

‘কাউকে মেরে ফেলেনিতো?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। জহুরুল বললো, ‘ফুপা মিয়াকে [কছিরউদ্দিন ভূঁইয়া] ধরার চেষ্টা করেছিল। ধরতে পারেনি। অবস্থা বুঝে ফুপাজান আত্মগোপন করেছিলেন। ওরা কৃষকগঞ্জ বাজার হয়ে শেখপাড়া গ্রামে ‘শান্তি কমিটির আরেক মেম্বর’ কাদের দারোগার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তার আগে ওরা বাজারে গিয়ে শেখপাড়ার তোজাম্মেল হাজীকে চোখ বেঁধে নৌকায় তুলেছিল। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অনুরোধে লতিফ ভাই [লতিফ মীর্জা] তাকে ছেড়ে দেন।

প্রতিরোধ যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর লতিফ ভাই দেশের ভেতর থেকে বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। তার বাহিনির নাম ‘পলাশডাঙ্গা যুবশিবির’। আমার দুজন কাছের বন্ধু ওই বাহিনীর অধীনে যুদ্ধ করেছে। 

পাকিস্তানি বাহিনী পুরো দেশ কব্জা করার পর বাঙালিদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য পাড়ায় মহল্লায় শান্তি কমিটি করার ফরমান জারী করে। এই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শটি জামাতে ইসলামির আমীর গোলাম আজম জেনারেল রাও ফরমান আলীকে দিয়েছিল। তার ঢেউ আমাদের অঞ্চলেও এসে পড়ে। আমাদের অঞ্চলে তখন অদ্ভুত একটি কান্ড ঘটছিল। আমাদের পাশের গ্রাম হাবিবগঞ্জে একজন অবাঙালি নাম পরিচয় গোপন করে বিয়ে করে শশুর বাড়ী অবস্থান করছিল। আমরা যখন নৌকার মিছিল করতাম সেও আমাদের সমর্থন করতো। ব্যাপারটা বোঝা গেল পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় আসার পর। ওই লোকটা স্বমূর্তিতে আবির্ভুত হলো। সেই মিলিটারিদের ডেকে এনে গ্রামবাসীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে। তখন এলাকার মুরুব্বিরা সাবেক পুলিশ ইন্সপেক্টর কছির উদ্দিন ভূঁইয়াকে অনুরোধ করে শান্তি কমিটি গঠন করতে। তিনি ভালো ইংরেজি জানতেন, উর্দু ভালো বলতে পারতেন। এই কারণে তাকে এগিয়ে আসতে সবাই অনুরোধ করে। অগত্যা তিনি রাজি হলেন। তিনি সুকুর মামুর বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ইন্সপেক্টর কছির উদ্দিন ভূঁইয়া। তবে তিনি নিজে থেকে এমনটা করবেন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। তিনি ছিলেন সরল প্রকৃতির আত্মভোলা স্বভাবের মানুষ। 

এক বিকেলে গ্রামের স্কুল মাঠে শান্তি কমিটি গঠনের জন্য আশে পাশের গ্রামের গুটি কয়েক মানুষ জমায়েত হয়। ব্যাপারটা ছিল আমাদের জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর। সুকুর মামুর জন্য ছিল আরও ভীষণ রকম অস্বস্তিকর। জমায়েতে আমরা কেউ উপস্থিত ছিলাম না। শুনেছি আমার চাচা মোকাররম হোসেন খান তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন শান্তি কমিটির ব্যাপারে। তিনি বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন রণাঙ্গনে আমাদের ছেলেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আর আমরা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব? তাহলে ভবিষ্যৎ বংশধর কি আমাদের এই অপরাধ কোনদিন ক্ষমা করবে?’ 

এর জবাবে সবাই বলেছিল, আমরা বাধ্য হয়ে এই কমিটি করছি। আমরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা চাই। মোকাররম চাচা আর কারও সমর্থন না পেয়ে জমায়েত বয়কট করেন। পরে সর্বসম্মতি ক্রমে কমিটির সভাপতি হন কছির উদ্দিন ভূঁইয়া। সদস্য হলেন, মৌলানা বেলাল হোসেন [কানসোনা], তোজাম্মেল হাজী, কাদের দারোগা [শেখ পাড়া], ধনী ফকির [হাবিবগঞ্জ]। [কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। 

যারা সেদিন ভূঁইয়া সাহেবকে সামনে ঠেলে দিয়েছিলেন তারা আজ কোথায়? আর এই ভালো মানুষটার এখন উভয় সংকট। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে খুঁজছে। আবার পাকিস্তানি বাহিনীও তাঁকে সন্দেহ করছে। এখন তার জীবন নিয়ে টানাটানি। মানুষের ভালো করতে গিয়ে তিনি সত্যি ফেঁসে গেছেন। অথচ এই নিয়ে তিনি পাকিস্তানি মিলিটারির কাছে কোন অভিযোগ করেননি। তাদের ডেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেননি। 

সমস্যা বাঁধল কথাটা সুকুর মামুকে কিভাবে বলবো? আমাদের ঘুসুর ঘুসুর ফুসুর ফুসুর দেখে সুকুর মামু খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। অল্পতেই তিনি বুঝে ফেলেছেন। শুনে মন খারাপ করে গুম মেরে বসে রইলেন সুকুর মামু। আমরাও স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। চারপাশ গুমোট ভাব। কারও মুখে কোন কথা নেই। 

রাত বাড়ছে। একসময় ওরা ওদের ক্যাম্পে যাওয়ার কথা তুললো। এই সুযোগে আমি কথাটা তুললাম। বললাম, ‘ওদেরকেও আমাদের দলে নিলে কেমন হয়?’ ভাল হয়। একবাক্যে বললেন সবাই। কিন্তু ওরা রাজি হলো না। ওদের মনে তীব্র অভিমান। ওদের রেখে আমরা আলাদা দলে চলে এসেছি। ওদের অভিমান ন্যায়সঙ্গত। এরপর কথা আর তেমন জমছিল না। ওরা তারপর দেরি না করে রৌমারী ক্যাম্পের উদেশ্যে চলে গেল। আমরা বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। 

দুদিনপর ভোরবেলা আমাদের প্রস্তুত হয়ে নিচে নামার নির্দেশ দেওয়া হলো। আমাদের উচ্চতর ট্রেনিংযের জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হবে। নির্দেশ পেয়ে আমরা ব্যাগ গুছিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নামার জন্য লাইন ধরলাম। পাহাড়ে একটি মাত্র ওঠা নামার পথ। পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামার কষ্ট দ্বিগুণ। যারা পাহাড়ে ওঠা নামা করেছেন তারা ভাল বুঝবেন। ভোর রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে তাতেই পথ ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পাহাড়ের মাটির এমনই বৈশিষ্ট্য। সামান্য বৃষ্টিতে মাটি থ্যাক-থ্যাকে কাদা। আবার সামান্য কড়া রোদ পেলেই মাটি খড় খড়ে শুকনো। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কোন কারণে পা হড়কে গেলে আর উপায় নেই। ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিচে টেনে নিয়ে যাবে। তখন জীবন নিয়ে টানাটানি। সাবধানে পা ফেলতে-ফেলতে নিচে এসে দেখি ৫টি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে আমাদের নিয়ে যেতে। আমরা সুবিধে মতো সামনের ট্রাকে উঠে পড়লাম। 

হর্ন বাজিয়ে ট্রাকগুলো ছুটতে শুরু করলো। শুরু হলো পাহাড়ি পথে আমাদের প্রকৃতি দর্শন। [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours