মস্তিষ্ক হলো দেহের প্রধান নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ, মাথার খুলির অভ্যন্তরে যার বসবাস। প্রাপ্তবয়স্ক মানব মস্তিষ্কের আয়তন ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার, গড় ওজন ১.৩৬ কেজি। মেনিনজেস নামক পর্দা দ্বারা আবৃত এই মস্তিষ্কে থাকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন। ধরুন নিউরনগুলো যদি টাকা হতো? অর্থাৎ একটি নিউরন=১ টাকা। তার মানে আপনার মাথার উপর ১০,০০০ হাজার কোটি টাকার খনি। কল্পনাটি আসলেই চমকে চিন্তায় ডোবার মতো।
পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য আদৌ আছে কি না তা নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা যথাযথা করছেন৷
দুই লিঙ্গের শারীরিক গঠনে পার্থক্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷ কিন্তু দেখার বিষয় হবে আধুনিক স্নায়বিক গবেষণা পুরুষ ও নারীর ভাবনাচিন্তা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে দুই লিঙ্গের পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা দিতে পারছেন কি না?
মস্তিষ্কের সাবকর্টিকাল অঞ্চলগুলোতে কেবলমাত্র ১৪টি অঞ্চলে পুরুষদের মস্তিষ্কের পরিমাণ বেশি এবং ১০টি অঞ্চলে নারীদের পরিমাণ বেশি।
কর্টিকাল পুরুত্ব পুরুষের মধ্যে নারীদের তুলনায় বেশি থাকার প্রবণতা দেখা দেয় যা স্মৃতি, আবেগ, আনন্দ এবং হরমোন উৎপাদনের মতো জটিল কাজে জড়িত।
অপরদিকে নারীদের পুরু কর্টেক্স থাকার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় বেশি যা মনোযোগ, উপলব্ধি, সচেতনতা, চিন্তাভাবনা, স্মৃতি, ভাষা এবং চেতনায় মূল ভূমিকা পালন করে।
যদিওবা নারী মস্তিষ্কের চেয়ে পুরুষের মস্তিষ্ক ১০ শতাধিক বড়। আকারের পার্থক্য থাকার সত্ত্বেও এটি বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে কোন প্রভাব ফেলে না। তারা মস্তিষ্কের তুলনায় বেশ আলাদা।
একটি ক্ষেত্রের মধ্যে তারা পৃথক হন তা হলো “ইনফেরিয়র প্যারিটাল লোবুল”, যা পুরুষের মধ্যে বড় হতে থাকে। মস্তিষ্কের এই অংশটি গাণিতিক সমস্যার সাথে যুক্ত, সময় নির্ধারণ এবং গতি বিচারের জন্য। হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলটি নিয়েও পূর্বে বহু বিতর্ক হয়েছে, যা স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় জানা যায়, উভয় লিঙ্গেই হিপ্পোক্যাম্পাসের কোন পার্থক্য দেখা যায়নি।
তবে প্রমাণিত যে নারী মস্তিষ্কে অধিক গ্রেয় ম্যাটার বিদ্যমান। গ্রেয় ম্যাটার কোষ দেহ ধারণ করে যা আমাদের দেহকে মস্তিষ্কে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কের এমন অঞ্চলগুলোর সাথে অবস্থিত যা পেশী নিয়ন্ত্রণ এবং সংবেদনশীল ধারণার সাথে জড়িত। কিন্তু দুসংবাদ হলো সেসব মায়েদের জন্য যারা মা হতে ইচ্ছুক- গর্ভাবস্থায় গ্রেয় ম্যাটারের পরিমাণ হ্রাস পায়। যা অবশ্যই গর্ভাবস্থা মস্তিষ্ককে ব্যাখ্যা করতে সহায়ক। ফলে মহিলারা আরও বেশি ওয়াট ম্যাটার ব্যবহার করেন যা প্রক্রিয়াকরণের কেন্দ্রগুলোকে সংযুক্ত করে। পুরুষরা গ্রেয় ম্যাটার ব্যবহার করেন যা ব্যাখ্যা করতে পারে যে পুরুষরা এক্সেল টাস্ক ফোকাসড অর্থাৎ কোন বিশেষ কাজে মনোযোগী হওয়া। যেখানে মহিলারা ভাষা এবং মাল্টিটাস্কিং অর্থাৎ একত্রে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে পারদর্শী হন।
২০১৩ সালের একটি গবেষণা আরও একটি পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়৷ মস্তিষ্কের বাম ও ডান অংশের মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান নারীদের ক্ষেত্রে আরও দ্রুত ঘটে কারণ নারী মস্তিষ্কের সংযোগগুলো পাশাপাশি খুব শক্তিশালী যার ফলে নারীরা স্বজ্ঞাত চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত আঁকতে পারেন।
অন্যদিকে পুরুষের মস্তিষ্কের সামনে ও পিছনের অংশের মধ্যে সংযোগ তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী৷ ফলে উচ্চতর উপলব্ধি এবং শক্তিশালী পেশী সঞ্চালন সংক্রান্ত দক্ষতা দেখা যায়। এর মাধ্যমে লিঙ্গ অনুযায়ী ক্ষমতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন নারীদের মধ্যে সহমর্মিতা অথবা পুরুষদের উন্নত দিকনির্ণয়ের ক্ষমতা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী দুই লিঙ্গের মস্তিষ্কের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই। বরং সবার মস্তিষ্কের মধ্যেই বিভিন্ন অনুপাতে পুরুষ ও নারী উপাদান রয়েছে।
ড. সুসানে ভাইস বলেন, ‘‘দুই লিঙ্গের মধ্যে নয়, বরং একই লিঙ্গের মধ্যে বেশি পার্থক্য পাওয়া যায়। প্রায়ই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলা হয়, নারীরা আরও দক্ষভাবে ভাষা শিখতে পারেন বা পুরুষদের ‘স্পেশিয়াল' বা স্থান সংক্রান্ত জ্ঞান বেশি। তবে প্রায়ই স্বল্প পরিসরের গবেষণায় এমন সিদ্ধান্ত উঠে আসে। মাত্র ২০, ২৫ অথবা ১০০ জনের স্যাম্পল থেকে সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় না৷''
তাছাড়াও সেরিবেলাম ঐতিহাসিকভাবে কেবল গতিবিধি সমন্বয়ের সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়। এটি লিঙ্গভেদে আলাদাও হতে পারে।
মস্তিষ্ক প্রক্রিয়াকরণের নিদর্শন দ্বারাও পুরুষ এবং মহিলাদের মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন রসায়ন রয়েছে। উভয়য়েই একই স্নায়বিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া করার সময় তারা তাদের আলাদাভাবে প্রক্রিয়া করে। উদাহরণস্বরূপ- সেরোটোনিন যা সুখ এবং হতাশার সাথে যুক্ত। এটি মহিলাদের ক্ষেত্রে পুরুষের মতো একই প্রক্রিয়া করে না। এর মাধ্যমেই নারীরা কেন উদ্বেগ এবং হতাশার জন্য বেশি সংবেদনশীল তা বুঝিয়ে জানাতে সহায়তা করে।
জার্মানির ইয়ুলিশ শহরে হেল্মহলৎস গবেষণা কেন্দ্রে ড. সুসানে ভাইস-সহ বিজ্ঞানীদের এক দল মস্তিষ্কের কাঠামো খতিয়ে দেখছেন৷ যুগান্তকারী এক প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে তাঁরা মস্তিষ্কের পাতলা ফালি প্রস্তুত করছেন৷ এভাবে তাঁরা স্নায়ুর গতিপথ ও অন্যান্য কাঠামো তুলে ধরতে চান৷ পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্কের মধ্যে একটি পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। ড. ভাইস বলেন, ‘‘মস্তিষ্কের আয়তনের পার্থক্য সবচেয়ে স্পষ্ট। পুরুষদের মস্তিষ্ক নারীদের তুলনায় বড় হলেও সেটি আরও দ্রুত বা আরও উন্নতভাবে চলে, এমন কোনো প্রমাণ নেই৷''
তাহলে আসল ঘটনা কী? হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পুরুষ ও নারীদের বোঝার ক্ষমতার পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল অনুযায়ী দুই লিঙ্গের মস্তিষ্কের মধ্যে কার্যত কোনো পার্থক্যই নেই। অমিলের তুলনায় মিলই অনেক বেশি। তাহলে কি আমাদের আচরণের মধ্যে পার্থক্য আমরা জন্মের পর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে আয়ত্ত করছি?
এমনটাও হলফ করে বলা যায় না । মস্তিষ্কের কাণ্ডের সবচেয়ে পুরোনো অংশে গঠনগত পার্থক্য রয়ে গেছে। সেখানেই ‘মিডিয়ান প্রিঅপটিক নিউক্লিয়াস' নামের কয়েক মিলিমিটার চওড়া পরিচালন কেন্দ্র রয়েছে । সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর পুরুষের মস্তিষ্কে এই অংশটি অপেক্ষাকৃত বড়। মানুষের ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণ৷।
এই স্নায়বিক কেন্দ্র কর্তৃত্ব, আগ্রাসী মনোভাব ও যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে এগুলি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, নারীদের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন৷ আমাদের আচরণেই তার প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন সম্পর্কের বন্ধনের বাইরে যৌন সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষা নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বেশি। পুরুষদের মধ্যে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশও বেশি দেখা যায়।
স্বাস্থ্য ঝুঁকির কি কোন উপায় আছে? এই প্রশ্নের উত্তরটি একটু চিন্তাজনক কারণ
জেনেটিক মেকআপ অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের কাছ হতে পাওয়া জিনগত পার্থক্যগুলো কিছু নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করেই থাকে। যদিও এটি গবেষণার একটি ধারাবাহিক ক্ষেত্র।
টেস্টোস্টেরন বা এস্ট্রোজেন এবং নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যের অবস্থার মতো হরমোনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকতে পারে। হতাশা, মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ যা সবগুলিই নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, সেগুলো অন্যান্য স্ট্রোকের মতো অতিরিক্ত স্বাস্থ্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতেই পারে।
(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)
(www.theoffnews.com - Bangladesh brain male female)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours