ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

ছোটখাটো অস্ত্রের পর শুরু হলো ভারী অস্ত্রের ট্রেনিং। এলএমজির ট্রেনিং। এলএমজির পুরো নাম লাইট মেশিন গান। সামনে পেছনে কাতলা ফিট করা। কাতলার উপর অস্ত্রটি রাখা হয়। সামনের ব্যারেলে কাতলা থাকায় নিশানা করা সহজ হতো। প্রশ্বস্ত ব্যারেল। বড় বড় গুলি। ভয়ংকর শব্দ। কানে তালা ধরে আসে। তবে মজাটা হলো এলএমজি ফায়ার করার আনন্দ অন্যরকম। শরীরে কোন চাপ লাগে না। ক্রমাগত গুলি বেরুতে থাকে। আর অস্ত্র শুধু সামনে টানতে থাকে। মজাই মজা। বড় ধরণের একটি সমস্যা আছে সেটা জানলাম থিউরি ক্লাসের সময়। সমস্যা হলো, এলএমজির এক ম্যাগাজিন শেষ করার পর আর দেরি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে পজিশন চেঞ্জ করতে হবে। কারণ শত্রুপক্ষ এলএমজি ম্যানকে স্তদ্ধ করতে চারদিক থেকে এলএমজি ম্যানের দিকে গুলি করতে থাকবে। এই জন্যে তাকে দ্রুত পজিশন চেঞ্জ করতে হয়। না করলে নির্ঘাত মৃত্যু। আরও একটি বড় সমস্যা অস্ত্রটি একা চালানো যায় না। অস্ত্রের ম্যাগাজিন এবং গুলি বহনের জন্য একজন হেল্পার লাগে। মোদ্দা কথা, গায়ে গতরে রিষ্ট পুষ্ট হতে হবে। না হলে এই অস্ত্র চালাতে সে পারবে না। তিন ধরণের মেশিনগান যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এলএমজি [লাইট মেশিন গান], এমএমজি [মিডিয়াম মেশিন গান] এবং এইচএমজি [হ্যাভি মেশিন গান] আমরা এলএমজি এবং এমএমজি পর্যন্ত ট্রেনিং করেছি। এইচএমজি আমরা নাম শুনেছি মাত্র। চোখে দেখিনি। 

এলএমজির ৫ রাউনড ফায়ার করে কিছুতেই মন ভরলো না। ট্রিগারে চাপ দিতে না দিতেই ঠা-ঠা শব্দে মুহূর্তে সব গুলি বেরিয়ে গেল। ফায়ার করে এতো মজা সেই অস্ত্রের মাত্র ৫ রাউন্দ গুলি, তাতে কি মন ভরে? মনে হচ্ছিল ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি থাকবে আর লাইন পজিশনে আমি শুধু ট্রিগার চেপে থাকবো। তাহলে হয়তো মন ভরতো।

‘লাইন পজিশন’ এই কথাটা হয়তো আপনারা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। এটা যুদ্ধের একটি পজিশন। সাধারণতো তিন ধরনের পজিশনে যুদ্ধ চলে। দাঁড়ানো পজিশনকে স্ট্যান্ডিং পজিশন বলে। হাঁটু গেঁড়ে বসা পজিশনকে বলে নিলিং পজিশন আর শুয়ে শুয়ে পজিশনকে বলে লাইন পজিশন। যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় আমরা লাইন পজিশনেই পাকিস্তানি মিলিটারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। এলএমজিতো লাইন পজিশন ছাড়া ঠিক মতো ফায়ার করা যায় না। এই ভারী অস্ত্র মাটিতে রেখে গানের আগে পিছে কাতলার উপর রেখে শত্রুকে নিশানা করতে হয়। আমার বন্ধু আসগর এই ভারী অস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহার করতো। আমি ব্যবহার করেছি এসএলআর। পুরো নাম শেল্ফ লোডিং রাইফেল। এই অস্ত্র রাইফেলের চেয়ে হাল্কা। ম্যাগাজিনে ২০টি গুলি ভরা যায়। একবার লোড করলে পর পর ২০ বার ট্রিগারে চাপ দিলে দ্রাম দ্রাম করে গুলি বেরিয়ে যাইয়। রাইফেলের মতো বার বার লোড করতে হয় না। অস্ত্রটি রাশিয়ার তৈরি। সেই টেকনোলজি দিয়ে ভারত একই ধরণের এসএলআর তৈরি করেছে কিন্তু দুটি অস্ত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ভারতের এসএলআর দুতিন ম্যাগাজিন গুলি করার পর ব্যারেল জ্যাম হয়ে হঠাৎ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে হঠাৎ অস্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে নিজেকে কতটা অসহায় লাগে সেটা ভুক্তভুগি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। কত ধরণের টেনশন নিয়ে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে সেটা আমরা বুঝি। শত্রুর গুলির টেনশনতো আছেই। তার উপর অস্ত্র বন্ধ হওয়ার টেনশন আমাদের অনেকসময় মানসিকভাবে অনেকখানি দুর্বল করে রেখেছে। 

এলএমজি ফায়ার করার পর সেদিন খুব মজা করে অস্ত্র খোলা এবং জোড়া লাগানোর ট্রেনিং করলাম। দুপুরর ফিরে ঝর্ণায় গোসল শেষে খাওয়া পর্ব। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তারপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হতো ফেটিক অর্থাৎ পাহাড় পরিস্কার করার কাজে। সেটা আবার সবদিন হতো না। যেদিন ফেটিক হতো না সেদিন মন টানতো ঝর্ণার ওপার পাহাড়ি গ্রামে যাওয়ার। মেয়েটির হৃদয়ে ঢেউ তোলা হাসির কথা ভুলতে পারতাম না। চোখ বন্ধ করলে মেয়েটির মিষ্টি হাসি আমাকে আনমনা করে দিত। আমি আবার একদিন গেলাম। সেদিন বন্ধু আসগরকে ছাড়া একাই গেলাম। সেদিন দোকান গুলোতে তেমন ভিড় ছিল না। একটু পর আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকলো। আমি সোজা সেই চেনা দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখি মেয়েটি নেই। মনটা চুপসে গেল। কম বয়সী একটি ছেলে বসে আছে দোকানে। তাকেতো জিজ্ঞাসা করতে পারি না মিষ্টি হাসির মেয়েটি কোথায়? কি ভাববে সে? নাম জানলে না হয় জিজ্ঞেস করা যেত, অমুক কোথায়? ছেলেটি ইশারায় জানতে চাইলো আমার কিছু লাগবে কিনা। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ভাব করে দোকানের মালামালের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে রইলাম। ভাবখানা আমি যেন দামী কিছু খুঁজছি। আমি দু’প্যাকেট সিগারেট নিয়ে একটি জ্বালিয়ে দোকানের বাইরে এসে মেয়েটির অপেক্ষা করতে থাকি। চেনা অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। একজন ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য টানতে থাকে। তাকে বলতে পারি না আমি এখানে একটি মিশন নিয়ে এসেছি। অগত্যা মেয়েটির সঙ্গে দেখা না করেই ফিরে এলাম ক্যাম্পে। মনটা অকারণে বিষাদে ভরে গেল। মেয়েটির দেখা পেলেই বা এমন কি হতো। আমি কি তাকে বলতে পারতাম তোমাকে আমার ভাললাগে? সেও যদি তাই বলতো তাতেই বা কি হতো? প্রেম করার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি কি তখন আমাদের অনুকূলে ছিল? নিজের পাগলামির কথা ভেবে একা একাই হাসতে লাগলাম। যখনই ব্যাপারটা মনে উদয় হচ্ছে তখনই হাসি চড়ছে মুখে। লজ্জায় কথাটা কাউকে বলতে পারছি না। একা একাই পাগলের মতো হাসছি। 

দুদিন পর মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে আগের মতো হৃদয় কাঁপানো হাসি হাসলো সে। সিগারেট এবং কলা কেনার ফাঁকে আমাদের অনেক কথা হলো। নাম বললো ‘চানরিয়া’। নামটা মনে আছে কারণ ওকে নিয়ে এই নামে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম। চানরিয়া হিন্দি পাহাড়ি ভাষা মিলিয়ে আর আমি আধা হিন্দি আধা বাংলায় জগাখিচুড়ি ভাষায় দুজন আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। চানরিয়া জিজ্ঞেস করছিল, ‘আমরা কিসের ট্রেনিং নিচ্ছি? আমরা কি পুলিশ?’ 

ওর ধারণা ছিল আমরা ভারতেরই লোক। এখানে পুলিশের ট্রেনিং নিচ্ছি। আমি ওর ভুল ভাঙ্গিয়ে দিতে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কসরত করে ওকে বোঝালাম, ‘আমরা ভিন দেশের লোক। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। তোমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। আমাদের দেশ পাকিস্তানি মিলিটারিরা আক্রমণ করেছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে।  মেয়েদের ধরে নিয়ে বেইজ্জত করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এখানে ট্রেনিং নিচ্ছি। চানরিয়া চমকে আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকালো। ‘তোমরা যুদ্ধ করবে! যদি গুলি লাগে?’ আমি হেসে বললাম, ‘গুলিতো লাগতেই পারে। লাগলে লাগবে। আমরাতো মরার জন্যই যুদ্ধ করতে এসেছি। হয় মারবো না হয় মরবো। এছাড়া আমাদের বিকল্প কোন পথ নেই।’

আমার কথা শুনে অচেনা পাহাড়ি মেয়েটির মুখ বেদনায় বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার মৃত্যু যেন ওকে বেদনার্ত করলো। আমি অবাক চোখে তাকালাম। আমি ভিন্ন দেশের, ভিন্ন জাতের, ভিন্ন ধর্মের মানুষ। আমার জন্য ওর এতো মায়া কিসের? মায়া জিনিসটা আসলে অন্যরকম। তার জন্য ভিন্ন জাত ভিন্ন ধর্ম ভিন্ন দেশের কোন সম্পর্ক নেই। আমি হেসে বললাম, ‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমরা কি মরতে এসেছি। আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। যুদ্ধ করে আমরা আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীন করবো। আমরা আমাদের দেশের মানুষদের রক্ষা করবো। আমাদের মা বোনদের রক্ষা করবো।’

চানরিয়ার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করে কিন্তু কথা বলে মজা  পাচ্ছিলাম না। ভাষা না বুঝলে কি কথা বলে মজা পাওয়া যায়? চানরিয়া আমার ভাষা বোঝে না আমিও ওর ভাষা বুঝিনা। জোড়াতালি আর ইশারা ইঙ্গিতে কথা কি জমে? তবু অনেক কথা বলেছি আমরা। আরও অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি কথা বলছি আর সিগারেট ফুঁকছি। আমাদের কথা শুনতে আরও কয়েকজন পাহাড়ি ছেলেমেয়ে আমার চারপাশে জড় হয়েছে। ওদের চেহারা বলছে ওরা খুব মজা পাচ্ছে আমার কথায়। 

আমি চানরিয়াকে বললাম, ‘আজ যাই। আবার আসবো।’ চানরিয়া হেসে মাথা নাড়লো। ওর হাসি ভয়ংকর আলোড়ন তুললো আমার বুকে। ভাবতে ভাবতে আমি ক্যাম্পে ফিরে এলাম। 

দুপুরের পর আমাদের নিয়ে গেল গ্রেনেড নিক্ষেপের ট্রেনিংয়ে। পাহাড়ের ঢালুতে কোমর পরিমান গর্ত করা একটি স্থান। গর্তটি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ৫/৪ ফুট চওড়া। দুজন করে সেই গর্তে নেমে ঢালুর দিকে গ্রেনেড নিক্ষেপের কয়েক সেকেন্ড পর দ্রাম করে তা বিস্ফোরিত হচ্ছে। দুজনের সঙ্গে আমাদের ওস্তাদও সেই গর্তে আছেন। তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। একসময় আমার ডাক পড়লো। আমার সঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার সেই সহযোদ্ধার নামটা ভুলে গেছি। আমার মতোই সে হ্যাংলা পাতলা। তবে ভাইজান বেশ খানেয়ালা। তিনজনের খাবার একাই খেতে পারে। মাঝে মাঝে আমি তার খাওয়া দেখে ভীষণ অবাক হতাম। 

ওস্তাদ আমার হাতে একটি গ্রেনেড ধরিয়ে দিয়ে প্রাকটিক্যালি বোঝাতে লাগলেন, ‘দেখ, গ্রেনেডের গায়ে পাতলা একটি পাত আছে। পাত চেপে ধরো।’ ওস্তাদের কথা মতো পাত চেপে ধরলাম। তারপর তিনি বললেন, ‘এবার পিন খোলো।’ গ্রেনেডের মাথায় চিকন ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে চিকন দুটি স্টিলের তার ঢুকিয়ে দুইপাশে বাঁকা করে রাখা। দাঁত দিয়ে সেই তার সোজা করে তারের একপাশে ছোট রিং। সেই রিং ধরে টান দিলে পিন খুলে গেল। তারপর গ্রেনেড ছুঁড়ে দিলে তা ৬ সেকেন্ডের মধ্যে ভীষণ শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে অসংখ্য টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শত্রু সৈন্যদের জটলার মধ্যে অথবা বাংকারে এই গ্রেনেড খুবই কার্যকরী একটি অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। 

গ্রেনেড ছুঁড়ে গর্তের মধ্যে কান চেপে বসে পড়তে হয়। যেন গ্রেনেডের স্প্রিংটার কোনভাবে আমাদের আক্রান্ত করতে না পারে। ওস্তাদের কথা মতো আমি পিন খুলে দূরে ছুঁড়ে দিতেই আমরা তিনজনই কান চেপে গর্তে বসে পড়লাম। মাটি কাঁপিয়ে দ্রাম শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। ওস্তাদ আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, গুড। 

এবার আমার সহযোদ্ধার পালা। ওস্তাদ তার হাতে গ্রেনেড তুলে দিতে আমি খেয়াল করলাম আমার সহযোদ্ধার হাত কাঁপছে। ওর হাত কাঁপা দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ওস্তাদও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। তিনি ওকে সাহস যুগিয়ে চাঙ্গা করতে চেষ্টা করলেন। গ্রেনেডের পাত চেপে ধরতে বললেন। পিন খুলতে বললেন। এ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক ছিল। ওস্তাদ এবার গ্রেনেড ছুঁড়তে বললেন। ওর কি যে হলো, গ্রেনেড ছুঁড়তে গিয়ে হাত কেঁপে গ্রেনেড গর্তের মধ্যেই পড়ে গেল। এক মুহূর্তের ব্যাপার। আমার তখন দিক-বিদিক কোন জ্ঞান ছিল না। ওস্তাদ চোখের পলকে সেই পিন খোলা গ্রেনেড কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিলেন ঢালুর দিকে। তারপর কান চেপে গর্তে বসে পড়লেন। গ্রেনেডটা শূন্যেই বিস্ফোরিত হয়ে গেল। ওস্তাদ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গর্তেই বসে রইলেন হতাশ ভাবে। আমিও হকভম্ব মুখে অবশ হয়ে বসে আছি। ভাবছি, মৃত্যু দরজা পর্যন্ত এসে ফিরে গেল। আর একটু হলে বিদেশেই কবর হতো আমাদের। কি সৌভাগ্য আমাদের। আমরা বেঁচে গেছি। আমাদের অন্য সঙ্গীরা দূরে বসে খেয়াল করছিল। তারাও ছুটে এলো। সবাই একযোগে হামলে পড়লো আমাদের সেই সহযোদ্ধার উপর। নানা জন নানা কথা বলতে লাগলো। ততক্ষণে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখা গেল সহযোদ্ধাটি ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours