পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। বিকেল তিনটেয় বিজেপি তাদের সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলন করছে। সাংবাদিকদের সামনে রাখা একটি বড় পর্দায় নারদা নিউজের স্টিং অপারেশনের ছবি বা ভিডিও দেখানো হচ্ছে। সেই ছবি বিজেপির সৌজন্যে বলে সরাসরি প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে। প্রসঙ্গত বলি, এই ভিডিওটি কিন্তু বিজেপিই প্রথম দেখাচ্ছে তা নয়। নারদা ডট কমে তা সকাল থেকেই দৃশ্যমান। প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমের কর্তারাই তা দেখেছেন, জানেন। কিন্তু তা নিয়ে টুঁশব্দটিও কাড়েননি কেউই। ছোটখাটো মিডিয়াদের সমস্যা ছিলই। তাদের অধিকাংশ মালিকই ব্যবসা করেন, শাসক দলের তাবড় তাবড় নেতাদের প্রকাশ্যে টাকা নেওয়ার ছবি দেখানোর মত বুকের পাটা তাদের ছিল না। কিন্তু বড় বড় সংবাদ মাধ্যম, যাদের নিরপেক্ষতার বাণী বিজ্ঞাপনে যত্রতত্র, তারাও কেউ সাহস করেনি এ নিয়ে প্রশ্ন করতে। বলা যায় এগিয়ে থেকেও মানুষকে এগিয়ে রাখেনি সেদিন অনেকেই। ভাগ্যিস বিজেপি সেদিন সাংবাদিক সম্মেলন করেছিল, নাহলে সাধারণ মানুষের কাছে নারদা কাণ্ড অধরাই রয়ে যেত। কারন সিংহ ভাগ মানুষই নারদা ডট কমের নামই জানতেন না। তাই সেই ওয়েবসাইট খুলে এই কেলেঙ্কারির খবর তাদের জানা হত না।

যাই হোক বিজেপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে এবার বাংলা সংবাদ মাধ্যমের গুলি ছোটানো শুরু হল। বাংলার মানুষ জানতে পারলেন, দেখতে পেলেন তাদের প্রিয় নেতাদের কীর্তিকলাপ। সেই দিন এবং তার পরে প্রায় দু সপ্তাহ ধরে বিজেপি লাগাতার সাংবাদিক সম্মেলন করে নারদা ভিডিওতে দৃশ্যমান সব নেতাদের নামে বিষোদ্গার করেছে। তাদের শাস্তির দাবী জানিয়েছে। দুর্নীতির কারণে তৃণমূল সরকারের না থাকার কথা বলেছে। সেই সব দিনের ভিডিও ইউটিউবে এখনও পাবেন আপনারা। সেখানে যে যে নেতাদের দুর্নীতিগ্রস্থ বলে তৎকালীন বিজেপি নেতৃত্ব শাস্তির দাবী করেছিলেন। আজ সেই নেতাদের অধিকাংশই তাদের দলের সম্পদ। তাদের কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরেন দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। কারোর ঘাড়ে হাত রেখে আদুরে আলাপ করেন স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী। 

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন দাবী করেছিলেন এই ভিডিও ফেক। সেটা তিনি করতেই পারেন, দলের ভাবমুর্তি ঠিক রাখতে এটাই কিছুটা স্বাভাবিক। ফেক শুনে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। আজ তারাও কি বলবেন, সেদিনের এই ভিডিওটা ফেক ছিল। একজন নেতাও কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে পারেননি যে তারা কোনও টাকা নেননি। কারণ স্পষ্ট দেখা গিয়েছে তাদের টাকা হাতে নিতে। সেই টাকা ঘুষের কিনা তা নিয়ে এখনও চর্চা চলছে। কিন্তু এটা তো অনস্বীকার্য, সেই নেতাদের বেতন বা অন্যান্য প্রাপ্য কিছু এভাবে নেওয়ার চল নেই। তারা কেউ সুদের ব্যবসাও করেন বলে শোনা যায়নি, যে প্রকাশ্যে নোটের বান্ডিল দেওয়া নেওয়া করছেন। তাদের নীরবতাই বলে দেয় সেই টাকা কোনও সাধু উপায়ে প্রাপ্য অর্থ নয়। আবার নিন্দুকদের মতে ২০১৪ সালে করা এই ভিডিও কেন ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশ পেল তার ব্যাখ্যাও দিতে পারেন বিজেপি নেতৃত্বই।  

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কলকাতা পুলিশ এই কাণ্ডের তদন্ত শুরু করে। অভিযুক্ত নেতা বা মন্ত্রীদের কতটা কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তা তারাই জানে কিন্তু নারদা কাণ্ডের মূল মাথা ম্যাথিউ স্যামুয়েলের হয়রানি সর্বজন বিদিত। ম্যাথিউ সত্যিই দোষী কিনা, তার এই স্টিং অপারেশনের পিছনে কোনও অন্য উদ্দেশ্য আছে কিনা তা এখনও তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এমন তদন্ত মূলক খবর করাটা যে মোটেই ঠিক নয় সেটা বেশ বোঝা গিয়েছে প্রশাসকের ম্যাথিউ দমনের তৎপরতায়। 

আসলে খবর করেও তো কিছুই হয় না। মানুষ ভুলে যায়। প্রশাসক দেখেও দেখতে পায় না। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই এক স্টিং অপারেশনের কারণে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের ইস্তফা দাবী করেছিলেন। নিজে এমন অসাধু মন্ত্রীসভায় থাকবেন না বলে পদত্যাগ করেছিলেন। সেই মমতাই তার দলের সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রীদের টাকা নিতে দেখেও চুপ থাকেন। ফেক ভিডিও বলে দায় এড়িয়ে যান। পরে সেই তিনিই আবার দলবদলের পর সেই নেতাদেরই ঘুষখোর, পচা ফল বলে ভিডিওটির মান্যতা দেন। সবটাই কেমন যেন গোলমেলে, ঘোলাটে, অস্বচ্ছ।

আজ পাড়ার দেওয়ালে যখন সততার প্রতীক হিসেবে ওই টাকা নেওয়া এক নেতার ছবি দেখি, মনটা উদাস হয়ে যায়। আমরা কত সহজে সব ভুলে যাই। অবলীলায় এই দুর্নীতি, এই প্রতারণা, এই অস্বচ্ছতাকে গ্রহণ করে নিই। আজ নারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা, একই কাণ্ডে অভিযুক্ত দলবদলু বিজেপি নেতাকে ঘুষখোর বলে প্রকাশ্য সভায় গালি দিচ্ছেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তা শুনছে, হাততালি দিচ্ছে, মজা নিচ্ছে। সেই নেতাও আরও উদ্দীপিত, উজ্জীবিত হয়ে সুর চড়াচ্ছেন। সেই নেতাটি যত নিচে নামছেন, তার গলা উঠছে উপর থেকে আরও উপরে। বলতে পারেন, আর কতটা নিচে নামলে তবে নির্লজ্জ বলা যায়?

(www.theoffnews.com - West Bengal politics narada)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours