মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

সত্যিই কি মারমেড বা মৎস্যকন্যা বিষয়টি মিথ নাকি সবটাই কল্পনা নয়? ৭০০বছর আগে ডাচ্ কবি জ্যাকোব কল্পনা করেছিলেন, জল থেকে উঠে আসছে একটি মাছ আর সে মানুষের মত দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে ডাঙ্গার পাড়কে ---- যেন বলতে চাইছে আর সে জলে থাকবে না, শুরু করবে ডাঙ্গার জীবন যাত্রা। ডাচ্ এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে পাওয়া প্রাণী জগৎ সম্বন্ধে বোঝাতে গিয়ে আঁকা এই ছবিটি বারবার নাড়া দিয়েছে বিজ্ঞানীদের—তবে কি মাছের সামনের পাখনাই বর্তমানে মাটিতে থাকা প্রাণীদের বাহু? গ্রীক, রাশিয়ান, আফ্রিকান উপকথায় বারবার এসেছে কখনও মৎস্যকন্যা অথবা কখন মৎস্যপুরুষদের কথা। একই সময় বিভিন্ন দেশের উপকথায় কিভাবে যেন জায়গা করে নিয়েছে মৎস্যকন্যার দল। কখনও জল থেকে উঠে এসে সমুদ্রের মাঝের কোনো পাথরে বসে আছে আর রোদ পোহাচ্ছে আবার কখনও আনমনে গুনগুন করছে, একমাথা লম্বা সোনালী চুল থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে। আজকের যুগেও তো মুভি, কার্টুন, কমিকস্ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে মারমেড আর মারম্যানরা, ডিজনীর সুন্দর লাল চুলের এরিয়েল তো সবার জানা চরিত্র।

কথিত আছে খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে প্রাচীন সিরিয়ান সমুদ্রের দেবী আতারগাটিস পূর্বজন্মে ছিলেন এক ক্ষমতাশালী পুরোহিত কন্যা, যিনি এক  সাধারন যুবকের প্রেমে পরেন। কিন্তু সেই প্রচন্ড দৈবী শক্তির অধিকারী মেয়েটির সাথে সম্ভোগকালে যুবকটি মৃত্যুমুখে পতিত হন। সন্তানসম্ভবা আতারগাটিত স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে যান, শোকে দুঃখে কাতর হয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন।কিন্তু দেবতারা তার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে মৎস্যকন্যায় রূপান্তরিত করে দেন। তিনি হয়ে ওঠেন বন্ধ্যাত্ব মুক্তির এবং সাংসারিক সুখের দেবী। এরপর আসি মৎস্যপুরুষ ইয়ার কথায়, মেসোপটেমিয়ায় তিনি পূজিত হতেন সমুদ্রের দেবতা জ্ঞান, সৃষ্টি আর ম্যাজিকের দেবতা রূপে। তিনি বন্যার দেবতা এনিলিলের হাত থেকে রক্ষা করছেন মানব সভ্যতাকে। ব্যবিলনীয় মিথ অ্যাত্রাহাসিস আর তাদের মহাকাব্য গিলগামেষ অনুসারে মানুষদের চীৎকারে ঘুম নষ্ট হওয়ায় বন্যার দেবতা এনিলিল পুরো মানব সভ্যতাই ধ্বংস করতে চাইলে মারম্যান দেবতা ইয়াই তাদের রক্ষা করেন।

এরপর আসা যাক জাপানী উপকথায়। সেখানে আছে নিনগিও যে আসলে দৈত্যাকৃতি মাছ, যার শরীরের অর্ধেক মাছের আর অর্ধেক মানুষের মত কিন্তু মুখটি বানরের মত। ভয় না পেয়ে খাদ্যাভ্যাসে এই মাছকে রাখতে পারলে সৌন্দর্য আর চির যৌবন সুনিশ্চিত। আফ্রিকান উপকথায় আছেন দেবী মামী ওয়াটা ইংরাজীতে মমি ওয়াটার, যার সুনজরে থাকলে প্রচুর সৌভাগ্যের অধিকারী আর কুনজরে থাকলে মাছে পরিণত হওয়া ভাগ্যে লেখা থাকবে।আয়ারল্যান্ডের মৎস্য কন্যারা ভারী সুন্দরী আর একঢাল সবুজ চুলের অধিকারিনী। মৎস্যপুরুষরা যদিও সুন্দর নন কিন্তু এক অদ্ভুত ম্যাজিক টুপি পরেন যার নাম কোহুলিন ড্রুইথ যা তাদের জলের নীচে থাকতে সাহায্য করে। রাশিয়ায় আছে রুশালকা নামে দয়ালু মৎস্যকন্যার কথা। যারা জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করেন কিন্তু সময় বিশেষে অত্যাচারিত মেয়েদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে দোষীকে জলে ডুবিয়ে মেরেও দেয়। নরওয়ে আর স্কটল্যান্ডে আছেন ‘ফিনফোক’ মৎস্যরমণীর দল  যারা রৌপ্য প্রেমী আর মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখে। ইনকাদের মাঝেও ছিলেন সেডনা নামে এক মৎস্যকন্যারূপী দেবী, যিনি সামুদ্রিক জন্তুদের রক্ষা করেন। এছাড়া  ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আর আমেরিকায় আছে সামুদ্রিক আত্মা লাসিরন যার উৎস ফ্রেঞ্চ শব্দ লা সিরেন অর্থ মৎস্যকন্যা।

এছাড়াও গ্রীক মাইথোলজিতে আছে যে অডিসিয়স তাঁর নাবিকদের কানের ছিদ্র মোম দিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন যাতে সুন্দরী কিন্তু কুহকিনী মৎস্যকন্যাদের সম্মোহিনী গানের সুর তাদের সমুদ্রে দিক্ভ্রান্ত না করে দেয়। ১৪৯৩ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস লিখেছেন মারম্যান মানে দাড়ি-গোঁফ সমেত এক মৎস্যপুরুষকে তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রানী ম্যনিটিকে দুর থেকে দেখলে ঠিক মানুষের মতই লাগে আর তার মুখের চারপাশের লোমশ অংশকে দাড়ি গোঁফ ভেবে ভুল হতেই পারে। এছাড়াও সত্যি মিথ্যের দোলাচালে থাকা মানুষকে আরও ঘেঁটে দিতে আছেন আরও কিছু ভুলভাল মানুষ আর মিডিয়া। যেমন পি টি বারম্যান জানালেন ফিজি মারমেডকে পাওয়া গেছে ফিজি আইল্যান্ড থেকে। আসলে একটা হনুমানের ওপরের অংশ আর মাছের নীচের পার্ট নিজেই জুড়ে তৈরী করেছিলেন নকল মৎস্যপুরুষটিকে। আর এক সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ডুগংগের কঙ্কালকেও বিজ্ঞানীরা প্রথমে মৎস্যকন্যা ভেবে ভুল করেছিলেন। ২০১৩ সালে অ্যানিমাল প্ল্যানেট  মৎস্যকন্যা পাওয়া গেছে এমন একটি ভুয়ো ভিডিও দেখিয়ে বেশ এক আলোড়নের সৃষ্টিও করে। এরপর অবশ্য কিছু বিজ্ঞানীরা ভেবে নেন হয়ত সী কাউ, ম্যানিটি বা ডুগংগকেই মানুষ ভুল করেছে বারবার  মৎস্যকন্যা ভেবে। কিন্তু ২০২১ এসে হঠাৎই এক চমকপ্রদ তথ্য হাতে এল বিজ্ঞানীদের --- সেটা জানাতেই আমার এই ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়া।

এতকাল বিজ্ঞানীরা ভাবতেন হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়ার অথবা পাখনা থেকে হাত বা পা তৈরী হওয়ার মত কোনো জিনই তো নেই মাছের শরীরে।জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে চার হাত পায়ে চলা জন্তুদের পূর্বপুরুষরা কি মাছ কখনও হতে পারে—সেট অফ জিন যে সম্পূর্ণ আলাদা, প্রমাণ কই?

কিন্তু গত সপ্তাহে ‘সেল’ নামের ম্যাগাজিনে এম ব্রেন্ট হকিন্স যিনি এককালের হাভার্ডের ছাত্র বর্তমানে একজন পোস্ট ডক্টরেট, জানালেন তারা  জেব্রাফিশের জিনের ওপর মিউটেশন করতে করতে হঠাৎই দেখেন কিছু জিন মিউটেশনের পর হুবহু মানবদেহের জিনের মতই কাজ করছে। শুধু তাই নয় জেব্রাফিশের বক্ষপাখনার জায়গায় হাড় এবং পেশীও তৈরী হয়েছে। হকিন্স দেখালেন দুটি জিন ভ্যাব ২ আর ওয়াস এল বি এর জন্য দায়ী  কারণ এরা এমন প্রোটিন বানাতে পারে যে তারা হক্স ১১ এর অ্যাকটিভিটি নিয়ন্ত্রণ করছে আর মানুষ বা যে কোনো স্তন্যপায়ীদের সামনের হাত তৈরীতে এই  হক্স১১ এর মস্ত বড় ভূমিকা থাকে।  তবে এই জিনের অ্যাক্টিভিটি মাছের শরীরে চাপা থাকে। দেখা যাচ্ছে এছাড়াও মাছের শরীরেও সেই একই ১১টি জিন আছে যা মানব শরীরে ফুসফুস তৈরী করে। তবে কোনোভাবে তাদের কার্যকারিতা চাপা পড়ে থাকে। বর্তমানে ক্রিসপার টেকনোলজির সাহায্য মানে অনেকটা একজায়গা থেকে কিছু জিন কাঁচি দিয়ে কেটে আর এক জায়গায় জুড়ে হকিন্স দেখালেন জেব্রাফিশের শরীরে ডাঙ্গায় উঠে মানিয়ে চলার সব সরঞ্জামই মজুত আছে তাদের শরীরে তা সে ফুসফুস তৈরী করাই হোক কি উন্নত স্নায়ুতন্ত্রই হোক অথবা হাত পা। আর এসবই মজুত আছে ৪৫০ লক্ষ বছর আগে থেকেই মানে যখনও ডাঙ্গায় ওঠা প্রাণীদের সৃষ্টিও হয়নি। এছাড়া আরও একটি  প্রমাণ হল লোব ফিনড ফিশের জীবাশ্ম --- যা দেখায় তাদের শরীরে মাংসল পাখনার নীচে একক হাড়ের উপস্থিতি।

বিশাল মহাসমুদ্রের কতটুকুই বা আর আমরা জানতে পেরেছি! ভবিষ্যতে  হয়ত আরও কত কিছুই জানা যাবে --- ঠিক আজ যেমন বিজ্ঞান কবি কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করল। যে মৎস্যকন্যাদের মিথ বলে এতদিন উড়িয়ে দিয়েছি,  কে বলতে পারে হয়তও আজও তারা কোনো গভীর সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপের চারপাশে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে।

(www.theoffnews.com - marmaid marman)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours