ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

শারীরিক পরীক্ষার পর তুরা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বিশাল গেট আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হলো। ভেতরে ঢুকে আমরা বিস্ময়ে হতবাক। ভেতরে এলাহি কাণ্ড। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ভারতীয় আর্মিদের থাকার জায়গা। তারপর বড় একটি মাঠ। মাঠ পেরিয়ে পূর্ব দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসস্থল। নতুন আসা হাজার খানেক যোদ্ধাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হলো। আমাদের কোম্পানিতে আমরা ১২৬জন। পাঁচ নম্বর শিবির আমাদের জন্য বরাদ্দ করা হলো। আমাদের আগে একটি দল প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে গেছে। আমরা রেডিমেট তাবু এবং থাকার জন্য বাঁশের তৈরি মাচাল পেয়ে গেলাম। রাতে ঘুমানোর জন্য উত্তম ব্যবস্থা। বসবাসের জন্য আমাদের কোন পরিশ্রম করতে হলো না। 

আমাদের শিবিরটি বড়মাঠ লাগোয়া। অন্যদল গুলোর শিবির আরও পূর্ব প্রান্তে। পরিবেশ এবং খোলামেলার দিক দিয়ে আমাদের শিবির অনেক বেশি সুন্দর। অন্যগুলো অসমতল স্থানে। এবড়ো থেবড়ো জায়গায়। চমৎকার পরিবেশ পেয়ে আনন্দে আমরা উল্লসিত ছিলাম। আমাদের তাবুর সামনে ভলিবল খেলার মাঠ এবং দুপাশে খুঁটির সঙ্গে নেট টানানো। অনেকেই তাতে মহাখুশি। পারলে তখনই কেউ কেউ ভলিবল খেলতে নেমে যায়।

সব মিলিয়ে আমরা তখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। সেইসময় বাঁশি বেজে উঠলে আমরা তাবুর সামনে খোলা জায়গায় লাইন ধরে দাঁড়ালাম। কয়েকজন ভারতীয় আর্মি কয়েক বস্তা ব্যবহারিক জিনিস নিয়ে এসে আমাদের সবার সামনে রেখে দিতে লাগলো। যার সামনে যা রাখছে সেগুলো তার। সেই জিনিসের মধ্যে ছিল একজোড়া ফুলপ্যান্ট, একজোড়া হাফপ্যান্ট, দুইজোড়া গামবুট, সার্ট একজোড়া, গেঞ্জি একজোড়া, কম্বল একজোড়া, প্লেট, বড় একটি মগ, সূই সুতা আরও ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিস। মজার ব্যাপার হলো প্যান্ট সার্ট যা দিয়েছে কারও সেগুলো সেটিং হচ্ছে না। আমাকে যে প্যান্ট দিয়েছে তার মধ্যে আমার মতো চারজন নির্ঘাত ঢুকে যেতে পারবে। এগুলো দিয়ে আমরা কি করবো? আমাদের এই কথাগুলো ভারতীয় আর্মিকে জানালে তারা বললো, ‘ক্যাম্পের ভেতরে দর্জির দোকান আছে। সেখানে গিয়ে সেটিং করে নিতে হবে।’         

তাবুর ভেতরে বাঁশের মাচাল দিয়ে শোবার জায়গা করা হয়েছে। সেটা আমাদের আগের প্রশিক্ষণার্থীরা করে গেছে। আমরা শুধু সেখানে কম্বল বিছিয়ে নিলাম। এক মাচালে দুজনের আবাসস্থল। আমি আর বন্ধু আসগর উত্তর পাশের একটি মাচাল দখল করে দু’টো কম্বল বিছিয়ে মাথার নিচে প্লেট দিলাম। প্লেটের উপর একটি কম্বল ভাঁজ করে বালিশের ব্যবস্থা করা হলো। শুরু হলো উন্নত প্রশিক্ষণ।

এর আগে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে খাওয়া-দাওয়ার যে কষ্ট ছিল সেটা দূর হয়ে গেল। রাতে আমাদের জন্য খাসির মাংস আর ভাত আমরা তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। খেয়ে ফিরে গেলাম তাবুতে। 

সমস্যা বাঁধলো সকালবেলা টয়লেট সারতে গিয়ে। পাহাড়ের পাশে খোলা জায়গায় কয়েকটি গর্ত। গর্তের সামনে একটি বাঁশের লাঠি পোঁতা।  সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে গর্তের সামনে লাঠি ধরে নিরাপদে কাজটি সারতে হবে। একজন কাজ সারছে সামনে লাইন দিয়ে অন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুব মজা পেলাম একটি দৃশ্য দেখে। বসে বসে কাজ সারছেন একজন আর বিড়ি ফুঁকছেন। সামনের দাঁড়ানো মানুষটি বসা কর্মরত লোকটির বিড়ির আগুন চেয়ে নিয়ে তার নিজের বিরি ধরালেন। এই দৃশ্য দেখে আমি হাসি অবদমন করতে ব্যর্থ হলাম। উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। আমার উপচানো হাসির শব্দে অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। উন্মুক্ত গর্তে কাজ সেরে কাছেই ঝর্ণা। সেই ঝর্ণায় প্রক্ষালন করতে হবে। প্রায় একশত গজ চওড়া কলকলে ছুটে চলা ঝর্ণায় গিয়ে লাইন ধরে প্রক্ষালন পর্ব শেষ করতে হয়। বন্ধু আসগর বললো, ‘এভাবে আমার পক্ষে টয়লেট করা সম্ভব না।’

‘তাহলে কিভাবে করবি? বিকল্প ব্যবস্থা কি?’ 

‘সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাতত চল।’ 

প্রাকৃতিক কাজ না সেরেই আমরা ফিরে এলাম। এসে প্রমাণ সাইজের দুটো পরোটা ভাঁজি দিয়ে মেরে দিলাম। তারপর একমগ দার্জিলিঙয়ের চা। ডেকচি ভর্তি চা। যার যত ইচ্ছে খেতে বাঁধা নেই। দারুণ টেস্টি চা। আমরা কেউ কেউ দুতিন কাপও খেয়েছি।  

একটুপর হুইসেল। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের কোম্পানিকে চারটি প্লাটুনে ভাগ করা হলো। একটি প্লাটুনের সদস্য সংখ্যা ত্রিশজন । বাড়তি যে ৬ জন থাকলো তাদের চার প্লাটুনে ভাগ করে দেওয়া হলো। চার প্লাটুনের চারজন প্রশিক্ষক। একজন সাদা হাফপ্যান্ট এবং সাদা টিসার্ট পরা ত্রিশ/বত্রিশ বছরের যুবক চারজন প্রশিক্ষককে এটা সেটা নির্দেশ দিচ্ছেন। তার পরিচয় দেওয়া হলো তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। দেখতে ভারী সুদর্শন। তার পরিচয় পেয়ে আমরা একই সঙ্গে অবাক এবং ভীষণ খুশি হলাম। ক্যাপ্টেন সাহেব কলকাতার বাঙালি। যেন আমাদের প্রতিবেশি ভাই এই ভেবে আমরা ভেতরে ভেতরে ভীষণ উল্লসিত। 

আমাদের প্লাটুনের ওস্তাদের বাড়ি ভারতের উত্তরপ্রদেশে। তার ভাষা হিন্দি। তাঁর নামটি ভাওয়ালা। ভাওয়ালার আগে আরও একটি শব্দ আছে। সেটা ভুলে গেছি। 

এবার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর থেকে প্লাটুন এবং কোম্পানি কমান্ডার নিয়োগ দেওয়ার পালা। আমাদের প্লাটুন কমান্ডার হলেন তারা ভাই, পুরো নাম শাজাহান আলী তারা। সিরাজগঞ্জ শহরে বাড়ি। দারুণ রসিক মানুষ। দুর্দান্ত মঞ্চাভিনেতা। স্বাধীনতার পর সম্রাট ‘শাজাহান’ নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। তারা ভাইয়ের আরও একটি বিশেষ কাজ ছিল থিউরি ক্লাসে ওস্তাদ যা বলতেন তিনি সেটা আমাদের বাংলায় অনুবাদ করে বুঝিয়ে বলতেন। 

মজাটা বাঁধলো কোম্পানি কমান্ডার নিয়োগ নিয়ে। যারা কোম্পানি কমান্ডার হতে আগ্রহী তাদের সামনে ডাকা হলো। আগে গিয়ে দাঁড়ালেন তৌহিদ ভাই। তিনি বরাবরই কমান্ডার ভাব নিয়ে আমাদের সঙ্গে মিশতেন। আমরাও তাঁকে কমান্ডার মনে করে সমীহ করতাম। তার সঙ্গে আরও তিনজন গিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। তাদের প্রাইমারী টেস্ট নেওয়া হবে। 

একে একে কমান্ড করতে বলা হলো তাদের। ‘এটেনশন’ ‘স্ট্যান্ডআপ’ ‘মার্কটাইম’ এই শব্দগুলো কমান্ডিং ভয়েজে বলতে হবে। যে চারজন সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা সবাই ফেল। তাদের কমান্ডিং ভয়েজ ক্যাপ্টেনের পছন্দ হলো না। তারপর আমাদের লাইনে দাঁড়ানো শামীম ভাইকে ডাকা হলো এবং আগের শব্দগুলি কমান্ডিং ভয়েজে বলতে বলা হলো। শামীম ভাই বললেন এবং তিনি পাস করলেন। তিনি আমাদের কোম্পানির কমান্ডার হলেন। তার পুরো নাম টি এইচ শামীম। ডাক নাম পান্না। আমরা তাঁকে পান্নাভাই বলে ডাকতাম। বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবান্ধিতে। খুবই সজ্জন একজন মানুষ। মিষ্টি স্বভাব। ৬ ফুটের মতো লম্বা। পেটা শরীর। না চাইতে তিনি আমাদের কোম্পানির কমান্ডার হয়ে গেলেন। আর তৌহিদভাই কমান্ডার হতে চেয়েও পারলেন না। তার মুড অফ হয়ে গেল।  কমান্ডার নিয়োগের পর আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো একটি রাইফেল এবং পাঁচ রাউন্ড গুলি। প্রথম দিনই আমাদের অস্ত্রের ট্রেনিং। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি পাহাড়ের কাছে। পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো বোর্ডে আঁকা মানুষের চিত্র সারি করে রাখা। ওই বোর্ডের অঙ্কিত মানুষকে টার্গেট করে ফায়ার করতে হবে। আমাদের থেকে ছবি দূরত্ব দুইশ গজের মতো হবে। আমি কখনও রাইফেল চালাইনি। রাইফেল সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। রাইফেল হাতে নিয়ে বুঝলাম, এই ভারী অস্ত্র দিয়ে আমার পক্ষে যুদ্ধ করা অসম্ভব। আমি জানতাম না, রাইফেলের ট্রিগার চাপার পর রাইফেল একটু সামনে এগিয়ে পেছনে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দেয়-সেটা জানা না থাকলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেটা ঘটেছিল আমার। 

রাইফেলের বাট কাধের নিচে হাড়ের পাশে মাংসের সঙ্গে চেপে ধরতে হয়। না জানার কারণে আমি রাইফেলের বাট কাধের নিচে গলার পাশে হাড়ে বাট ঠেকিয়ে যেই ফায়ার করেছি অমনি খটাস শব্দে বাট আমার হাড়ে এমন ধাক্কা দিল মুহূর্তে আমার শরীর অসাড় হয়ে গেল। মনে হলো আমার হাড় গুড়ো হয়ে গেছে। আমি কাত হয়ে মাটিতে শুয়ে আছি। দ্বিতীয় গুলি ফায়ার করার মতো আমার কোন এনার্জি ছিল না। আমি ডান হাতে কোন বল পাচ্ছিলাম না। এইসময় আমার ওস্তাদ এসে আমাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলন, ‘কি হয়েছে? তুমি পড়ে আছো কেন?’ আমি তাঁকে ঘাড়ের পাশে হাড় দেখিয়ে সব তাঁকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। ওস্তাদ আমার আঘাত পাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে তারপর রাইফেলের বাট বসানোর স্থান এবং কৌশল দেখিয়ে বললো, ‘সামনে, উদার টার্গেট করো।’ আমি ভয়ে ভয়ে টার্গেট করে ফায়ার করলাম। এবার আর সমস্যা হলো না। ওস্তাদ আমার পিঠ চাপড়ে সাহস জুগিয়ে অন্যদের কাছে চলে গেলেন। আমি তখন মনের জোর ফিরে পেয়েছি। পরের তিনটি গুলি একদম টার্গেট করে ফায়ার করলাম এবং ওস্তাদের অনেক বাহবা পেলাম। আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘গুড।’ [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours