ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

কামালপুর যুদ্ধের পর দুদিন আরাম আয়েশে কেটে গেল। দুদিন পর এক সকালে নাস্তা করার পর জানতে পারলাম, আজই আমাদের নীলফামারি মহকুমার হাতিবান্ধা থানায় যেতে হবে। ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি হাতিবান্ধা একটি চর এলাকা এবং মুক্ত এলাকা। জায়গাটির তিন দিকে যমুনা নদী। একদিকে শুকনো পথ। যে পথ চলে গেছে উত্তরের দিকে ভারত অভিমুখে। নদী পথে পাকিস্তানি মিলিটারি এসে হাতিবান্ধার গ্রামগুলোয় আক্রমণ করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। নারীদের তুলে নিয়ে যায়। এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার দায়িত্ব দিয়ে আমাদের পাঠানো হয় হাতিবান্ধায়।  

দশটার দিকে রওনা দিয়ে আমরা বারটা নাগাদ হাতিবান্ধা পৌঁছে যাই। সীমান্ত থেকে পাঁচ/ছয় মাইল দূরত্ব। একমাত্র ব্যবস্থা পায়ে হাঁটা। তবে আমাদের রসদ আর গোলাবারুদ নৌপথে পৌঁছে যায় হাতিবান্ধায়। আমরা হাতিবান্ধা হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করি। 

সেখানে পৌঁছেই আমরা টেন্স খুঁড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। সৈনিকদের কোন কাজ ফেলে রাখার অবকাশ নেই। যখনকার কাজ তখন তখনই করতে হয়। যুদ্ধের ব্যাপারটাতো আরও সিরিয়াস। যুদ্ধ যে কোন মুহূর্তে বাঁধতে পারে। তাই সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে হয় সৈনিকদের। কোন একটি মুহূর্ত হেলাফেলা করার সুযোগ নেই।

ঘুমানোর জন্য আমরা অভিনব ব্যবস্থা করলাম। প্রতিটি ক্লাসের বেঞ্চগুলো একসঙ্গে করে নিজেদের কম্বল বিছিয়ে ভাগ ভাগ করে শুয়ে পড়লাম।  

তখনও স্কুল গুলোতে টয়লেট সিস্টেম করা হয়নি। আমাদের সেখানে পৌঁছে টয়লেটের স্থান আগে চিহ্নিত করতে হলো। ব্যবস্থা সেই পুরনো। কাছাকাছি ঝাড় জঙ্গলে কাজ সারতে হবে। 

পরদিন কমান্ডার পান্নাভাই অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য যমুনার পাড় পরিদর্শনে গেলেন অন্যান্য কমান্ডারদের সঙ্গে নিয়ে। সেইসময় যমুনার পাড়ে পাহারার ডিউটি ছিল আমার এবং আরও একজন সহযোদ্ধার। আমরা পর্যবেক্ষণ দলের সঙ্গে মিশে গেলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে যমুনা নদী। হাতিবান্ধার তিনদিক বেষ্টন করে আছে। 

এলাকা পরিদর্শন কালে কমান্ডার অন্যান্য কমান্ডারের কাছে বলেই ফেললেন, ‘এই বিশাল এলাকা আমরা এই ক’জন যোদ্ধা কিভাবে সামাল দেব?’ 

কথাটা আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুললো। আমরা মাত্র ১২৬জন যোদ্ধা। পুরো দলে আমাদের ভারী অস্ত্র বলতে মাত্র একটি এল-এম-জি। আর সব থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। সামান্য এই অস্ত্র দিয়ে এতবড় অঞ্চল পাহারায় আমাদের কেন পাঠানো হলো আমি এর কারণ খুঁজে পেলাম না। আমার সেইসময়ের ভাবনায় ব্যাপারটি অবিবেচনা প্রসূত মনে হলো। সেক্টরের নেতৃত্বে ছিল সব বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। তাদের ভাবসাব কেমন যেন সহজ ছিল না। আমরা যারা অনিয়মিত বাহিনী অর্থাৎ ছাত্র-জনতা, তাদের প্রতি একধরণের বিরূপ মনোভাব লক্ষ্য করেছি আমাদের সেনা অফিসারদের মধ্যে। আমাদের সঙ্গে তাদের আচরণে যেন মনিব চাকরের ব্যাপারটা তীব্রভাবে ফুটে উঠতো। ১১ নম্বর সেক্টরের অফিসারদের আচরণের কথা বলছি আমি। অন্য সেক্টরের সেনা অফিসারদের আচরণ এমন ছিল কিনা জানি না। 

পরদিন দুপুরবেলা ঘটলো চরম বিপর্যয়। আমাদের সেনা অফিসারদের সিদ্ধান্ত যে অবিবেচনা প্রসূত ছিল সেটা আমরা হাতে-নাতে প্রমাণ পেলাম। 

দুপুরে আমরা মাত্র খেতে শুরু করেছি। খাওয়ার মেনু ছিল ডালে-চালে খিচুড়ি। কোন রকমে জীবন বাঁচানো। আমরা নিজেরাই রান্না করেছি। ভাল মন্দ তেমন বিবেচনায় নিচ্ছিলাম না আমরা। প্লেটে খিচুড়ি নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খাচ্ছি আর গল্প করছি। খাওয়ার মাঝপথে দেখলাম যমুনার পাড়ে যে দুজন যোদ্ধা পাহারায় ছিল তারা ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে এসে তারা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। অনেকগুলো গানবোট এবং লঞ্চ নিয়ে পাকআর্মি এসে চারদিক ঘিরে ফেলেছে। 

কমান্ডার পান্নাভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা সংখ্যায় কত?’ 

‘অনেক। কয়েকশ।’ বললো দুজন। 

পান্নাভাই গর্জে উঠলেন, ‘সবাই প্রস্তুত হও।’ 

আমরা প্লেট ছুড়ে ফেলে ছুটে গিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ততক্ষণে পাকআর্মির গোলা বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। তারা গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। অস্ত্র হাতে বাইরে এসে দেখি আমাদের কেউ কেউ পালাতে শুরু করেছে। পান্নাভাই তাদের চিৎকার করে ডেকে ফেরাতে চেষ্টা করলেন। তাতে কাজ হলো না। যারা পালানোর মতলবে ছিল তারা ঠিকই পালিয়ে গেল। 

কমান্ডার পান্নাভাইয়ের সঙ্গে আমরা টেন্সে ঢুকে পজিশন নিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম পাকআর্মি গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। কমান্ডারের ফায়ারের নির্দেশ পেয়ে আমরা ফায়ার করতে শুরু করলাম। আমাদের ফায়ারের শব্দ পেয়ে পাক আর্মি থেমে পড়লো এবং তারা লাইং পজিশন নিয়ে ফায়ার করতে শুরু করলো। 

আমাদের সবেধন একটি মাত্র এল-এম-জি। সেটি চালাতো বাবলু। সবাই তাকে পাঞ্জাবি বাবলু বলে ডাকতো। দীর্ঘকায় ফর্সা চেহারা। পাঞ্জাবিদের মতো দেখতে বিধায় তার নাম হয়ে যায় পাঞ্জাবি বাবলু। বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবান্ধিতে। 

বাবলু একবার মাত্র এক ম্যাগাজিন এল-এল-জি ফায়ার করেছে। তারপর এল-এম-জির আর কোন খবর নেই। ব্যাপার কি জানতে সবাই উৎসুক হয়ে বাবলুর দিকে তাকায়। বাবলু বলে, ‘এল-এম-জি জ্যাম হয়ে গেছে। ফায়ার হচ্ছে না।’ 

সবাই এই কথা শুনে আঁতকে ওঠে। সেই ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে বাবলু এল-এম-জি খুলে গামছা দিয়ে মুছে তারপর অস্ত্র জুড়ে ফায়ার করতে শুরু করলে আমাদের মধ্যে স্বস্তিভাব ফিরে আসে। আমাদের একমাত্র ভারী অস্ত্র এল-এম-জি কাজ না করলে আমরা যুদ্ধ করবো কিভাবে? একজন সৈনিকের বড় সাহস তার অস্ত্র। সেই অস্ত্র যদি যুদ্ধের ময়দানে অকেজো হয়ে পড়ে তাহলে সেই সৈনিকের অসহায়ত্ব কতটা ভয়াবহ সেটা শুধু সেই সৈনিকই অনুমান করতে পারে। বাবলুর এই দুঃসাহসিক কর্মের কথা আমি কোনদিন ভুলবো না।

এল-এম-জি চালাতে যেমন সাহস এবং শক্তির দরকার তেমনি আছে সমূহ বিপদের আশংকা। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী ভারী অস্ত্রের সৈনিককে স্তব্ধ করা সবার দায়িত্ব এবং যুদ্ধের কৌশল হিসেবে বিবেচিত। হাতিবান্ধা যুদ্ধেও তাই হলো। সমস্ত আক্রমণ বাবলুর উপর শুরু হলো। তাকে স্তব্ধ করতে হবে। ঘন ঘন এল-এম-জি ম্যানকে পজিশন পরিবর্তন করতে হয়। না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। 

একটু পর বাবলুর উপর শেলিং শুরু হলো। আমাদের টেন্সের আশে-পাশে মর্টারের শেল এসে পড়তে লাগলো। শেলের শব্দ আমাদের হতোদ্যম করে দেয়। একটি শেল টেন্সের মধ্যে পড়লে আমাদের ভবলীলা মুহূর্তে সাঙ্গ হয়ে যাবে। ক্রমাগত শেল এসে পড়তে থাকায় আমাদের আরও কয়েকজন যোদ্ধা পজিশন উইথড্র করে পালিয়ে যায়। অবশেষে আমরা জনা পঞ্চাশেক মুক্তিযোদ্ধা মাটি কামড়ে পজিশন আঁকড়ে আছি। আমি পান্নাভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার অসহায়ত্ব দেখে ভেঙ্গে পড়লাম আরও। কি করবো বুঝতে পারছি না। কমান্ডারকে বিপদের মধ্যে একলা ফেলে পালিয়ে যেতে কিছুতেই মনে সায় দিচ্ছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল যুদ্ধের ময়দান থেকে যে পালিয়ে যায় সে কাপুরুষ। সে দেশপ্রেমিক যোদ্ধা নয়। আমি পালাবো কেন? ওরা এসেছে আমার দেশ দখল করতে আর আমি আমার মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। আমরা হাসতে হাসতে দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। 

আমাদের মনোবল বাড়াতে পান্নাভাই গলা ফাটিয়ে জয়বাংলা বলে ধ্বনি দিয়ে উঠলে আমরাও পাল্টা বার কয়েক জয়বাংলা বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। এই ফাঁকে বাবলু খানিক সরে গিয়ে পজিশন বদলিয়ে আবার এল-এম-জি ফায়ার শুরু করলে আমরাও তাকে সাপোর্ট দিতে রাইফেল ফায়ার করতে থাকি। আবার সেইমতো মর্টারের শেলিং শুরু। এবার একাধিক মর্টার থেকে শেলিং শুরু হলো। বোঝা যাচ্ছে আজ ওরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। 

ক্রমাগত শেলিংয়ে কোনভাবেই টেকা যাচ্ছে না। এখানে থাকলে আমরা নির্ঘাত মারা পড়বো। দ্রুত উপায় বের করতে হবে। শেষপর্যন্ত পান্নাভাই নিজেই বললেন, ‘পজিশন উইথড্র করতে হবে। সবাই প্রস্তুতি নাও।’ 

পজিশন উইথড্র মানে এখান থেকে চলে যেতে হবে। সোজা কথায় এখন আমাদের পালাতে হবে। সেই পালানোর একটা বিশেষ নিয়ম বা কৌশল আছে। ট্রেনিংয়ে সেটাও সেখানো হয়। ইচ্ছে করলেই যুদ্ধের ময়দান থেকে পুরো বাহিনী পালাতে পারে না। সেটারও নিয়ম কানুন আছে। সামনে থেকে কয়েকজন ফায়ার দিয়ে ওদের ব্যস্ত রাখবে। পেছন থেকে ক্রলিং করে ময়দান থেকে অন্যরা সরে যাবে। আমরা তাই শুরু করলাম। কমান্ডারের নির্দেশে আমরা কয়েকজন অবিরাম ফায়ার শুরু করলাম। যাতে আমাদের সঙ্গিরা নিরাপদে সরে যেতে পারে। শেষে আমরা হাতে গোনা কয়েকজন রয়ে গেলাম। দেখলাম সেখানে বন্ধু আসগরও রয়েছে। ওকে দেখে একই সঙ্গে সাহস এবং আস্থা ফিরে পেলাম। সবশেষে কমান্ডারের সঙ্গে আমরা কয়েকজন উবু হয়ে স্কুলের পেছন দিয়ে পালানোর চিন্তা করলাম। স্কুলের পেছনে একটি জলাশয় আছে। কোমর সমান পানি। সেই পানি ভেঙ্গে আমরা উত্তর দিকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের দিকে ছুটলাম। [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours