দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
দিন ফুরোলে দীনবন্ধু আর শীত ফুরোলে বসন্ত! বসন্ত এলেই মনটায় রঙিন তরতাজা ভাব। দোল আসছে। প্রকৃতি তো নতুন পাতায়, রঙিন ফুলে সেজেছে। আমরা শিমুল পলাশের রঙে, আবিরের রঙে, নিজেদের রাঙিয়ে নিই না হয়।
কিন্তু কোনো কোনো জায়গার কোনো কোনো প্রজাতির মানুষের কাছে দোলই বসন্তের একমাত্র উৎসব নয়।
দোল বা আবিরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, এমন কিছু উৎসব পালিত হয় আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন জেলায় ও রাজ্যে। বিশেষ করে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসম এমনকি বাংলাদেশে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা এবং অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে।
সাঁওতালদের কাছে মাঘ মাস যদি বছরের শেষ মাস হয়, তবে ফাল্গুন মাসটিকে ‘নাওয়া সিরমা’ বা নতুন বছর ধরা যেতে পারে। আর নতুন বছরে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষেরও থাকে নতুন করে চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
প্রকৃতিতে ফুটে ওঠা ফুল, লতাপাতার সঙ্গে প্রাণী ও জীবকুলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে বসন্তকালে সাঁওতালদের মধ্যে 'বাহা' নামে এক উৎসব পালিত হয়। সাঁওতালি শব্দ 'বাহা' যার অর্থ ফুল। প্রকৃতির নতুন রূপকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে তাঁরা এই উৎসবটি নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ফাল্গুন বা চৈত্র মাসের কোনো একটা সময়ে পালন করে থাকেন। তাই এই অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট বার বা তিথি নেই।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র অবলম্বনে জানা যায় 'বাহা’ মূলত তিন দিনের অনুষ্ঠান।
১) 'উম্' অর্থাৎ অনুষ্ঠানের প্রথম দিন গ্রামের পুরোহিত 'নাইকে' বা 'নায়েকে' পরিষ্কার ধুতি পরে পুজোস্থল 'জাহের থানে' উপস্থিত হন এবং গ্রামবাসীরা মোড়লের সঙ্গে মাটির ঘটে পরিষ্কার জল নিয়ে ‘জাহের থান’ এ উপস্থিত হলে তাঁদের সামনে পুজো স্থল পরিষ্কার করেন। বসন্তদিনের গান, পুরাণাশ্রিত গানের সঙ্গে মাঙ্গলিক নিজস্ব সৃষ্টি ও শৈলীতে সমবেত নৃত্যে মেতে ওঠেন গ্রামবাসী।
২) 'সারদী মাহা' অর্থাৎ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে হয় মূল অনুষ্ঠান। পরবের সূচনায় গ্রামের দু’জন অবিবাহিত পুরুষ পবিত্র দেহ-মনে জঙ্গল থেকে শালফুল সংগ্রহ করে আনে। 'নাইকে'র হাতে কাঁসার থালায় থাকে নতুন ফুল। গ্রামের বেশ কয়েকটা বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা মুরগির ছানা বলিদান করে 'বাহা' দেবতা (বোঙ্গা)র আরাধনা করেন 'নাইকে'। পরে গোধূলি বেলায় ‘টামাক’ অর্থাৎ নাগাড়া, ধামসা, মাদল প্রভৃতি বাদ্যি বাজিয়ে 'নাইকে' গ্রামে প্রবেশ করেন। বাড়ির মহিলারা ছোট্ট বাটিতে সর্ষের তেল, একটা কাঁসার থালা অথবা কাঠের তৈরি পিঁড়ে এবং ঘটিতে জল নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। 'নাইকে' প্রবেশ করা মাত্র পরিবারের এক জন মহিলা তেল-জল নিয়ে 'নাইকে' এবং অন্যান্যদের পা থালায় রেখে জল দিয়ে ধুয়ে কাপড়ের সাহয্যে পা মুছে তেল মাখিয়ে পরিষ্কার করে প্রথা অনুয়ায়ী প্রণাম পর্ব সারেন। শেষে 'নাইকে' পবিত্র শান্তির শালফুল ও জল পরিবারের সদস্যদের শরীরে স্পর্শ করিয়ে আশীর্বাদ প্রদান করেন। এটা বিশ্বাস করা হয়, 'নাইকে বাবা' যেদিক দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে যান, সেই জায়গার প্রতিটি বস্তু পবিত্র হয়ে যায়।
এই দিন পুজো না হওয়া অবধি কোনো বাড়িতেই রান্না হয় না।
৩) 'সেন্দরা' বা শিকার অর্থাৎ অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন হল উপভোগ করার দিন। শিকারের সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া দাওয়া, নৃত্যগীত চলে সারা দিন।'বাহা' উৎসবের মতো, 'সারহুল' বা 'খাদ্দি' নামে আরেকটি উৎসব রয়েছে যেটি জঙ্গলমহলের 'কুড়মী' নামে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূমিজ, মাহালী, ওরাঁও, মুণ্ডা এই উৎসব পালন করে থাকেন। অনুষ্ঠান দু'টির প্রকৃতিগত পার্থক্য বিশেষ নেই। এই অনুষ্ঠানও ফাল্গুন বা চৈত্র মাসের কোনো একটা সময়ে পালন করা হয়।
'কুড়মী' সমাজের এই পুজো পরিচালনা করেন গ্রামের পুরোহিত 'লায়া'। গ্রামবাসী ও গ্রামের মঙ্গল কামনায় লায়া পুজো করেন। গ্রামের কোনো এক প্রান্তে শাল বা প্রাচীন কোনো গাছের নীচে 'গরাম থান' অর্থাৎ পুজো স্থলে মূলত এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামবাসীরা মানত হিসেবে মাটির তৈরি হাতি ঘোড়ার মূর্তি দিয়ে থাকেন। লোকবিশ্বাস, এই হাতি বা ঘোড়ার পিঠে বসে গরাম ঠাকুর দেশ প্রদক্ষিণ করেন, গ্রামবাসীদের ভালোমন্দ প্রত্যক্ষ করেন। সেই জন্য হাতি-ঘোড়ার বিগ্রহকেই মূলত পুজো করা হয়। আতপ চাল ও বাতাসা দেওয়ার রীতি রয়েছে। ওই দিন পুজোর শেষে ঝুমুর বা পাতানাচের অনুষ্ঠান হয়। এখন কোথাও কোথাও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
ওঁরাও জনজাতি বিশ্বাস করেন শালমঞ্জরী বিকশিত হলে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। শালের ডালে কলকাকলিতে তাঁরা মরসুমি বাতাসের আভাস পান। ধরিত্রীর বিবাহের আয়োজন হয়। পুজারির স্ত্রী উৎসব শুরুর এক পক্ষকাল আগে থেকে গ্রামবাসীদের ঘর-ঘর থেকে শস্য সংগ্রহ করেন। শস্যের বিক্রয় লব্ধ অর্থ দিয়ে কামার, কুমোর, বাদকের প্রাপ্য উপকরণ ক্রয় হয়। উৎসবের প্রাক্-পর্বে ‘সারনা’তে (শালফুলের পবিত্রকুঞ্জ) রেড়ির চারা ও শিমুল পল্লব রোপিত হয়।দু'দিনের এই পর্বের উপাস অর্থাৎ প্রথম দিনে কৃষিকার্য নিষিদ্ধ। ‘দাড়ি ছিটনা’ নামে অধিবাস সদৃশ এক অনুষ্ঠান হয়। পুরোহিত-বাড়িতে ‘ছিগরি গাড়া’ (পরবের পতাকা প্রোথিত করা), মধ্যরাত্রে পবিত্র কলস বারি ‘সারনা’তে স্থাপন ও জলপূর্ণকলসে জলের পরিমাপ নিরীক্ষণ ইত্যাদি নিষ্ঠা ভরে পালিত হয়।
দ্বিতীয় দিন হলো 'ছেংগনা কাটি’। এ দিন গ্রামীণ নারীদের ব্রত ও উপবাস। ‘পাহান’ (পুরোহিতকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয়) নিজ সম্প্রদায়ের প্রথা ও বিশ্বাস সহযোগে পূজা করেন গ্রামের মঙ্গল কামনায়। পুরোহিত ও তাঁর অনুগামীরা গ্রামে বিতরণ করেন ‘সগুন পানি’ বা মঙ্গল বারি, ‘সারনা’র ফুল। রাত জুড়ে প্রসাদ নৃত্য-গীতের আয়োজন। এই রাতকে বলে ‘খাদ্দি’।
ধর্মীয় মোড়কে উৎসবগুলি পালিত হলেও এসবের মধ্যে কোনো রকম অলৌকিকতা, কুসংস্কারের স্থান নেই বলেই দাবি করেন সমাজকর্মীরা। প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে মূলত 'বাহা', 'সারহুল' এর মতো আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের প্রচলন। এই অনুষ্ঠান চলাকালীন কোনো গাছের বিশেষ করে শাল মহুয়ার কোনো পাতা, ফুল বা কাঠ ব্যবহার নিষিদ্ধ। ফলে কিছুটা হলেও অরণ্য প্রকৃতি রক্ষা পায়।
(www.theoffnews.com - folk cultures rituals in spring)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours