পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
“কেউ কিন্তু কিছুই লিখছে না, আমি শুধু বকে যাই , কেউ কিছুই লেখে না। “অথবা“ এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ এটা অবশ্যই লিখে নাও”। এটুকু শুনে মনে হচ্ছে ক্লাসরুমে দিদিমণির বকুনি বুঝি? খানিকটা ঠিকই বুঝেছেন। দিদিমণির বকুনি তো বটেই তবে ঘটনাস্থল ক্লাসঘর নয়, নবান্নের সাংবাদিক সম্মেলন। সাংবাদিক সম্মেলনের মাঝে সামনে বসে থাকা ছোট বড় মেজো সেজো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের নবীন প্রবীণ বিভিন্ন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর এই উক্তি। সাংবাদিকরা নোট নেওয়ার সময় কি লিখবেন, কতটা লিখবেন বা আদৌ লিখবেন কিনা, তাও নেত্রীই ঠিক করে দেবেন। এ থেকে কি খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যায়, সাংবাদিকতার একছত্র নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতার সেই সোনালী দিনগুলি এখন মেঘাচ্ছন্ন।
প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের কলম থামাতে সর্বদা তৎপর শাসক বা অত্যাচারীরা। বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তানে ঘটে চলা নানান অনভিপ্রেত ঘটনার প্রতিবাদী ব্লগারদের নির্বিচারে খুন করা হয়েছে। প্রতিবাদ করলেই দেশদ্রোহীতার তকমা এঁটে তাকে বন্দী করাটাও চেনা সরকারী নীতি। আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও দেখেছি, কোনও সংবাদ তাঁর ভাল না লাগলেই সেই সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকের বাপ বাপান্ত করতেন প্রকাশ্যেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ব্যতিক্রম নয় এই রাজ্য, এই দেশও। রাজ্যের ক্ষেত্রে মাওবাদী, কেন্দ্রের ক্ষেত্রে শহুরে নকশাল, এটাই প্রতিবাদ থামানোর চেনা তকমা। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কৃতি, চিন্তাশীল ব্যক্তি সরকারের কোনও কাজের সামান্য প্রতিবাদ করলেই তড়িঘড়ি তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বন্দি করা হয়েছে। এভাবে এদেশে প্রচুর মানুষ বন্দি, বন্দিদশায় মারা গিয়েছেন কেউ কেউ। যে কোনও প্রতিবাদের পিছনেই উগ্রপন্থীদের হাত থাকার অজুহাতও ভীষণ চেনা আমাদের।
এ রাজ্যেও সাংবাদিকদের উপরে নিগ্রহ অত্যাচার নতুন কিছু নয়। বাম আমলেও তা ভাল মতই ছিল। আমার বহু সতীর্থ আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশ দিয়ে পেটানো হয়েছে তাদের। আমি নিজে সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছি বাম কর্মীদের হাতে। একবার তো গোটা দিন আমাকে একটি ক্লাব ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল, মন মত খবর করিনি বলে। বর্তমান আমলেও এমনটা ঘটেছে, ঘটছে।
কৃষকদের প্রতিবাদের খবর করা বিভিন্ন সংবাদ কর্মীদের গ্রেফতার তাই খুব একটা অবাক করে না আমাদের। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যেমন সাংবাদিক সম্মেলন করে কি লিখতে হবে, কখন লিখতে হবে বলে দেন, তার ঠিক উল্টো এ দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সাংবাদিক সম্মেলনেই বিশ্বাস করেন না। তার এযাৎকালে আমি বোধহয় মাত্র দুবারই সাংবাদিক সম্মেলন দেখেছি। বাকি তিনি করে থাকলেও আমার জানা নেই। এর মধ্যে আবার একটি সম্মেলনে দুটি কথা বলেই অমিত শাহকে দায়িত্ব দিয়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলন মানেই নানা প্রশ্ন, তার মধ্যে কিছু বেয়াড়া, অপ্রিয় সত্য প্রশ্নও থাকতেই পারে, তাই কি তার সম্মুখীন না হওয়া? এ প্রশ্ন ঘুরতেই থাকবে, কিন্তু তার জবাব দেওয়াটা জরুরী নয় এ দেশে। প্রধানমন্ত্রী শুধু ভাষণে বিশ্বাসী, বাণী প্রচারেই আগ্রহ তাঁর।
ব্যাপারটা বিপরীত ধর্মী হলেও একটা বিষয় পরিস্কার, দুজনের কাছেই সাংবাদিকতা কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায় না। যে কোনও দেশের পক্ষে বা দেশের নাগরিকদের পক্ষে এ এক বিষম চিন্তার সময়। ঘটা করে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে যাকে অভিহিত করা হয় সেই স্তম্ভ নড়বড়ে হলে কিন্তু গণতন্ত্র অশক্ত, অসহায়। মানছি কিছু সংবাদকর্মীও এই অবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ দায়ী। তারাই মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা নিয়ে সরকারের চোখে সাংবাদিকতার সম্মানকে ধুলায় মিশিয়েছেন। কিন্তু সকলেই তো খারাপ নয়, সকলে খারাপ হতে পারেন না। সাংবাদিকতাও প্রয়োজনীয়তা, আবশ্যকতা এবং নিজস্বতার জোরে তার নিজের জায়গায় এখনও দাঁড়িয়ে।
জনগন এখন পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও সুযোগ পেলেই খুব গালমন্দ করেন। কিন্তু একটা বিষয় ভেবে দেখা দরকার কয়েকটা পচা ফলের জন্য গোটা ফলের ঝুড়িটাই ফেলে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। নাগরিকের গালমন্দ তাদের থেকে সাংবাদিকদের আরও দূরে নিয়ে যেতে পারে। যেমন নিয়ে গিয়েছে পুলিশকে। গাল দিই আর যাই বলি পুলিশকে কিন্তু আমাদের অহরহ প্রয়োজনে লাগে। তেমনই সংবাদ ছাড়া আমাদের পক্ষে একমুহুর্তও চলা মুশকিল। কয়েকজন সাংবাদিকের জন্য সাংবাদিকতার পেশাকে অশ্রদ্ধা করাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। নাগরিকদের সংবাদ বৈরিতার সুযোগটাই লুফে নেবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। তারা তাদের মত করে চালাবার চেষ্টা করবে সাংবাদিক তথা সংবাদ মাধ্যমকে। যেটা অনভিপ্রেত তো বটেই বিপদজনকও। জনগণের প্রকাশ্য সমর্থন পেলে, জনতার প্রশংসা পেলে তবেই মেরুদণ্ড সোজা রেখে কলম ধরবেন সৎ সুস্থ মানসিকতার সাংবাদিকেরা। হুকুম দেওয়ার আগে, অবহেলা করবার আগে তখন দশবার ভাববেন রাজনীতির কারবারিরা।
(www.theoffnews.com - Indian and state politics journalist)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours